মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, রাতের আলোটা বরং জ্বালানোই থাক
আদুরে উমা নয়, দশপ্রহরণধারিণী হয়ে ওঠ। প্রতিমা নয়, পুজো কর মৃন্ময়ীর হাতে থাকা প্রতীকী অস্ত্রের
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাবা: একটা জবা ফুল আর চারটে প্যাড়া। ছবিটার গায়ে সিঁদুর লেপটে। সঙ্গে লেখা, ‘মা কামাখ্যার প্রসাদ। কেউ এড়িয়ে যাবেন না।’ এই লেখায় কোনও হুঁশিয়ারি নেই। এড়িয়ে গেলে কী ক্ষতি হতে পারে সরাসরি বলাও নেই। কিন্তু ভয় দেখানো কি নেই! সেই ভয়-ভক্তিতেই তো ফেসবুকের ছবিটা আড়াই ‘কে’ লাইক পেয়ে যায়। সেই ভয়েই তো এত বিক্ষোভ, এত মিছিল।
আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মিছিলে ‘মা কামাখ্যার প্রসাদ’ দেখে আমরা যাঁরা লাইক দিই তাঁরা হেঁটেছি। মা কামাখ্যার কাছে রক্ষার প্রার্থনা তো রইলই, মিছিলে হেঁটেও সেই আশ্রয় খোঁজা। মিছিলকে এড়িয়ে যাইনি। ভয়ে। মেয়ের হাত ধরে হাঁটার সময়ে আমি দেখেছি, আমার চারপাশে অনেক বাবা-মায়ের চোখে মুখে সেই ভয়। হাঁটুর ব্যাথায় যিনি রান্নাঘর থেকে বাথরুমে যেতেও চোখ কুঁচকে ফেলেন তিনিও হাঁটছেন। মিছিল তাঁর জন্য স্লথ হচ্ছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চাইছে ‘ভীতু’ মানুষের মিছিল। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ কিংবা ‘দাবি এক, দফা এক’ স্লোগান তোলা তারুণ্যের মনের কথা আমি জানি না। ওই বয়সটায় আমি মিছিলে হেঁটেছি এক বার। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে শোকমিছিলে। তার পরে এই। ভয়ে ভয়ে মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে, আর্থারাইটিসের যন্ত্রণাকাতর পা নিয়ে এই প্রথম বার।
এই প্রথম বারটা নিয়ে এসেছে আরজি কর। হাথরসে আমি কখনও যাইনি। উন্নাও আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। মণিপুর সম্পর্কে রাজধানীর নাম ইম্ফল ছাড়া আর কিছুই তেমন জানা নেই আমার। কিন্তু আরজি কর-টা চিনি। ওই তো শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে যেখানে ঘোড়ায় চাপা নেতাজির মূর্তি, তার কাছেই। গোলবাড়ির কষা মাংসের গন্ধও হয় তো পাওয়া যায় হাসপাতালের জানলায় দাঁড়ালে। অনেক প্রিয়জনকে দেখতে গিয়েছি তো ওই হাসপাতালে। কত মানুষ, কত ভিড়। এক বার রাতেও গিয়েছিলাম এক জনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। সেই মধ্য রাতেও অনেক মানুষ দেখেছি বাইরেটাও। অনেক আলো। রাতভর খোলা চায়ের দোকান। ডিম সেদ্ধ, পাউরুটি, বাটার টোস্ট। সবই আমার চেনা জগতের মতো। সেখানেই মেয়েটাকে এমন করে মরতে হল!
আমি মুখেও আনতে পারব না যা যা শুনেছি, পড়েছি। আমার হোয়াটস্অ্যাপে চলে আসা নীল (সম্ভবত) চাদরে ঢাকা মেয়েটার ছবি মুহূর্তে ডিলিট করেছি। ওর মুখটাও কি নীল হয়ে গিয়েছিল? আমি দেখতে পারিনি। দেখতে চাইনি। কারণ, আমিও যে মেয়ের বাবা। একটি মাত্র মেয়ের বাবা। যে মেয়েকে আমি মা এবং বাবা হিসাবে একটু একটু করে বড় করছি, তার কী হবে? এই ভয় হাথরস, উন্নাও আনতে পারেনি আমার মনে। এল, এই প্রথম বার। আমরা মিছিলেও হাঁটলাম এই প্রথম বার।
দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের সময়ে রাগ হয়েছিল। দেশের রাজধানীর বুকে আলোকময় রাস্তার মধ্যে একটা মেয়েকে প্রাণ দিতে হল কতগুলো দুর্বিনীতের হাতে! কিন্তু ভয় হয়নি। হল, এই প্রথম বার। নিজের যৌনাঙ্গের দিকে তাকিয়ে পৌরুষকে প্রশ্ন করেছি— কীসের এত খিদে তোর? আরজি কর থেকে হাঁটা পথে খিদে মেটানোর সোনাগাছি তো! চলে যেতে পারতিস! পয়সা ছিল না তোর পকেটে? কীসের পৌরুষ রে তবে? অনেকে বলছে, যৌনতা আসল কারণ নয়। মেয়েটা নাকি অনেক অন্যায়, অনাচার জেনে ফেলেছিল। সেই রাগই চরম নির্যাতন করেছে। ক্ষত বিক্ষত করেছে একটা কোমল শরীরকে। রক্তে স্নান করেছে এক কাপুরুষের উত্থিত পৌরুষ। ভয় করছে। এই প্রথম বার, এত ভয় করছে।
মেয়েকে কি তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখাব না? মেয়ে কি সব মেনে নেওয়ার কথাই বোঝাব? মেয়েয়ে কি এটাই বলব, নিজে বাঁচিস, কাউকে বাঁচাতে হবে না। কারও ভালো চাই না। আমার সন্তান হয়ে তুই একা দুধে-ভাতে থাকিস!
এই প্রথম বার আমার ভীতু মন ‘না’ বলেছে। ভিড়ে মিশেছে আমার পা, আমার মন। আরও অনেক অনেক ভীতু পা আর মনের সঙ্গে।
বিশ্বাস করুন, এই সরকারের উপরে পুরনো কোনও রাগ, ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা আমার নেই। বড় হওয়া থেকে দেখা সব সরকারই আমায় সহনশীল হতে শিখিয়েছে। খারাপ খারাপ পরিষেবা মেনে নিতে শিখিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তা, নিরাপত্তা অনেক কিছু নিয়েই আমার বিরক্তি রয়েছে, কিন্তু রাগ নেই। ভয় নেই। যাঁরা বলছেন, সরকারের উপরে অনেক দিনের অনেক রাগ, ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে মিছিলে মিছিলে তাঁরা কিচ্ছু জানেন না। চাকরিতে দুর্নীতি, নেতাদের কাড়ি কাড়ি টাকা এ সব সহ্য করার, মেনে নেওয়ার
ইমিউনিটি মানুষের মধ্যে অনেক দিন আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোনও কিছুতেই যাঁদের কিছু আর যায় আসে না, তাঁরা হেঁটেছেন, হাঁটছেন মিছিলে। এই প্রথম বার। শ্রীভূমির প্যান্ডেল দেখার ভিড়ে থাকা মানুষ আর সেই ভিড়কে যাঁরা দূর থেকে প্রণাম করেন, সবাই রয়েছেন একই ভিড়ে। এই প্রথম বার।
আমার থাকার শহরটায় অনেক সমস্যা। রাস্তায় জল জমে যায় একটু বৃষ্টিতেই। সে জল নামতে নামতে লেগে যায় গোটা একটা বেলা। এ শহরের সবাই মেনে নেন যে, বৃষ্টি হলে জল তো জমবেই। আমিও তাই। নিকাশি নিয়ে প্রশ্ন তুলি না। সেই জমা জলের আড়ালে চলে যায় রাস্তার খানাখন্দ। তাতেই থাকে বিপদের ভয়। কোথায় পা দিলে দুর্ঘটনা, বোঝা দায়। কিন্তু তাতেও যে খুব অসুবিধা হয়, তা নয়। স্থানীয় কেউ না কেউ ওই গর্তে গাছের ডাল গুঁজে দেন। সবাই যেন বুঝতে পারেন, ওইখানটায় লুকিয়ে আছে ভয়। সবাই যেন বিপদ এড়িয়ে এক পথে হাঁটেন, চলেন। আরজি করের ঘটনা কি ওই গুঁজে দেওয়া ডাল? সেই কি বিপদের ভয় চিনিয়ে সবাইকে এক লাইনে নিয়ে এসেছে?
পথ নয়, হাসপাতাল তো মেয়েটার ঘর ছিল। যে ঘরে ও পড়ত, শিখত, কাজ করত। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গিয়েছিল। রাত জেগে লেখার সময় দেখছি, আমার মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা একটা হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটে। হাতে করে চেপে ধরে রাখা আমার বিকেলের ছেড়ে রাখা টি-শার্ট। এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। একলা বড় হতে গিয়ে বাবার গায়ের গন্ধ মাখানো পোশাককেই বাবা ভেবে কাছে রাখে। কিন্তু ওই মেয়েটাকে আমি কী শেখাব? আমায় কেউ সাহায্য করতে পারেন! চুপ করে থাকতে, মেনে নিতে শিখিয়ে দিতেই পারি। সেটাই ভেবেছিলাম আরজি করের পরে পরে। কিন্তু সে দিন ভীতুদের মিছিলটায় নিয়ে গেলাম। চিপস কিনে দেওয়ার মতো আব্দারের গলাতেই মিছিলে যেতে চেয়েছিল মেয়ে। কিন্তু ফোনের সেই আব্দার আমার কান ‘নির্দেশ’ শুনেছিল। ওই ভিড়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। শক্ত করে ধরে ছিলাম হাতটা। অনেকটা পথ হাঁটার পরে জল আনতে গিয়ে হাতটা ছেড়ে দিতে হয়। ভয় করেনি। ওই ভিড়টাকে ভরসা হচ্ছিল। ভীতুদের বলে নয়, ভিড় তো নিরাপদই। সেখানে এক যে অনেক হয়ে থাকে। আমার এক মেয়ে অনেক মেয়ে হয়ে হাঁটছিল মিছিলে। ওদের সবার জন্য আমি জল আনতে গিয়েছিলাম।
কিন্তু সব সময়ে ভিড় কোথায় পাব? সেমিনার রুমের নিশ্চিন্তে ঘুমানোর বিছানার পাশে কোন ভিড় পাহারা দেবে? আমার মেয়েকেও তো যেতে হবে একা। এগোতে হবে একা। তাই অনেক প্রশ্ন। কী করে নিরাপদে রাখা যায়? কোনও জ্যোতিষী কি বলে দিতে পারবেন! বললে আমি, একুশ সপ্তাহ বজরঙ্গবলীর ব্রত রাখতে পার। সাতাশ সোমবার উপোস করতে পারি। আচ্ছা, ওর ব্যাগে কি একটা মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ রেখে দিলে ধর্ষক কাছে ঘেঁষতে পারবে না? প্রবাল কিংবা মুক্তো ধারণ করালে কাজ হবে? না কি ওকে একটু একটু করে প্রতিরোধ গড়তে শেখাব? মনে, শরীরে তৈরি করে রাখব? না কি, মেনে নিয়ে আমাকে ‘বাবা’ বলে ডাকার জন্য প্রাণটা যাতে থাকে সেটা শিখিয়ে দেব? বলব, ভিড়কে বারবার কাছে পাওয়া যায় না রে সোনা! না কি তুই প্রতিরোধ গড়ে তোল, চিৎকার করে নিজের মধ্যেই অনেক তৈরি কর। মিছিল হয়ে ওঠ মা।
কী করা উচিত আমায় বলে দেবেন কেউ? কেমন করে বেছে নিতে বলব দু’টো পথের যে কোনও একটা? আমি যে ‘কন্যাদয়গ্রস্ত পিতা’ হতে চাই না। মা দুর্গা হয়ে বেঁচে থাকুক। আদুরে উমা নয়, দশপ্রহরণধারিণী হয়ে ওঠ মা। প্রতিমা নয়, পুজো কর মৃন্ময়ীর হাতে থাকা প্রতীকী অস্ত্রের।
মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। ওর চোখের পাতা দু’টো বুজে রয়েছে এক নিরাপদ আশ্রয়ে। গায়ের চাদরটা সরে গিয়েছে। ডান হাতে এখনও ধরা আমার ছেড়ে রাখা টি-শার্ট। বালিসের পাশে উপুর করে রাখা মোবাইল ফোন। সেই তো ওকে অনেক কিছুর মতো শ্যামবাজার, গোলবাড়ি, আরজি কর আর সেই রাতের অন্ধকার, চিনিয়ে দিয়েছে। ভয় দেখিয়েছে ওকেও। এমন ভয়, এই প্রথম বার। যাই, গায়ের চাদরটা টেনে দিই। রাতে আলোটা বরং জ্বালানোই থাক।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)