অনাহারে মৃত্যুই ভারতের গরিবের নিয়তি! মুনাফার প্রদীপের নিচে অসহ্য অন্ধকার
Global Hunger Index: চার সেকেন্ডে একজন না খেতে পেয়ে মরছেন এদেশে, অন্যদিকে ওই চার সেকেন্ডে সাড়ে সাত লক্ষ টাকার মুনাফা হচ্ছে আদানির
বহু বছর আগে শোনা একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। এক রাজা জানতে পারেন, তাঁর রাজ্যের মানুষ নাকি খিদেতে অসুস্থ হয়ে পড়েন, মারা-টারাও যান। এখন রাজা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, খিদে বিষয়টা কী! তিনি তার মন্ত্রী-পারিষদদের হাঁক দিলেন এই বিষয়ে জানার জন্য। এদিকে কেউই আর রাজাকে তার শাসনে প্রজাদের এই অবস্থার কথা ভয়ে বলতে পারছে না। অবশেষে এক মন্ত্রী জানান যে- খিদে হলো একটি 'রোগ'। রাজামশাই তো বেশ উৎসুক হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন এই রোগের লক্ষণ কী, কী তার প্রতিকার! মন্ত্রী বলেন, এই রোগে পেট কামড়ায়, পেট ব্যথা করে, মাথা ঝিমঝিম করে। এই রোগ হলে অনেকটা খেতে হয়। খেলেই এই রোগ সেরে যায়। তা এই ঘটনার কিছুদিন পর রাজা গেছেন এক ভোজবাড়িতে। প্রচুর খাওয়াদাওয়াতে তার পেট ব্যাথা শুরু হয়। মাথাটা ঝিমঝিম করে। রাজা বুঝতে পারেন তার খিদে রোগ হয়েছে। তিনি আরও খেতে থাকেন। এবং খেতে খেতে একসময় তিনি মারা যান।
এটা নিছকই এক গল্পকথা। বাস্তবে বেশি খেলেও রাজা-মন্ত্রীর মৃত্যু নেই। অরুন্ধতী রায় একটি সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন, তা মোটামুটি এরকম, এই মুহূর্তে দেশটাকে বেচে খাচ্ছেন চার জন গুজরাতি। দু'জন বেচছেন, আর দু'জন কিনছেন। সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট বলছে, যাঁরা কিনে খাচ্ছেন, তাদের মধ্যে এক রাজা, অর্থাৎ আদানি-র একদিনের উপার্জন ১৬১২ কোটি! এক বছরে সম্পত্তি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এত খেয়েও তিনি শুধু সুস্থই নন, চলতি বছরে বিশ্বের ধনীতমদের তালিকায় দু’নম্বরে উঠে এসেছেন তিনি। আরেক দেশীয় রাজা আম্বানি রয়েছেন প্রথম দশের মধ্যে। সমস্ত জাতীয় সম্পত্তি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, আদিবাসী ভূমি, খনিজ সম্পদ, জনগণের অর্থ লুঠ করে থালার পাশে বাটি সাজিয়ে বীভৎস খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে এ-দেশে, এ-রাজ্যে।
আরও পড়ুন: দেশজুড়ে অপুষ্টি, অনাহার! দারিদ্র কমার শুকনো পরিসংখ্যান হাসি ফোটাবে ভারতীয়দের মুখে?
সাম্প্রতিক আরও একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালে বিশ্বের ক্ষুধা সূচকের তালিকায় ১১৬ দেশের মধ্যে ভারত ১০৭ নম্বরে। ২০১৪ সালে এই তালিকায় ভারত ছিল ৫৫ নম্বরে। মাত্র আট বছরে দেশে 'খিদে' রোগে আক্রান্তর সংখ্যা বহু বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সামাজিক অসাম্য, সম্পদের অসম বন্টন, বিভিন্ন সরকারি নীতির ব্যর্থতাই ভারতে খিদে রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির আসল কারণ। তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে না খেতে পেয়ে প্রতি ৪ সেকেন্ডে মৃত্যু হয় এক জনের, খাদ্যসংকটে ভুগছেন বিশ্বের ৩৪.৫ কোটি মানুষ। মোদি সরকার অবশ্য খাদ্য-সুরক্ষার ওপর ভরতুকি খরচ গত বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ কমিয়ে দিয়ে খিদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করেছেন। “বেশি খেলে বাড়ে মেদ"-এর বিরুদ্ধে এ এক মাস্টারস্ট্রোক।
খিদে কী জিনিস, গল্পের ওই রাজা বোঝেননি। আমরাও যে খুব বুঝি, এমনটা নয়। অনেকেই ভাবেন, রেশন ব্যবস্থা থাকতেও স্রেফ না খেয়ে মানুষ কীভাবে মারা যায়। কিন্তু খিদে বুঝেছিল ঝাড়খণ্ডের সিমডেগা-র বছর এগারোর সন্তোষী কুমারি। আধার লিঙ্ক না থাকার কারণে রেশন না পেয়ে খিদের জ্বালায় ছটফট করতে করতে প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে সন্তোষী-র মা কৈলী দেবীর পক্ষে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ল নেটওয়ার্ক (HRLN) আধার-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে দেশজুড়ে অনাহারজনিত মৃত্যুর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন করে। নানা সওয়াল-জবাবের মাঝে আইনজীবী, সমাজকর্মী কলিন গঞ্জালভেস বলেন, বৈধ আধার কার্ড নেই- শুধুমাত্র এই অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৩ কোটি রেশন কার্ড বাতিল করেছে। যার ফলে বহু প্রান্তিক মানুষ, বিশেষত আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলে, দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে অনাহারে প্রাণ হারান। আইনজীবী গঞ্জালভেস জানান, এই আদিবাসী মানুষগুলি এতটাই প্রান্তিক যে, তাঁরা নিজেদের আধার কার্ড তৈরি করাতেই পারেননি। যাঁদের রয়েছে, এমন বহু ক্ষেত্রে নানা প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে তাঁদের মেলে না বায়োমেট্রিক্স। রেশনের পূর্বশর্ত হিসেবে তাই আধার সংযোগ, এই বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতির ব্যবহার সরাসরি খাদ্যসুরক্ষার ওপর আঘাত।
দেশজুড়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের হিড়িকের মধ্যে 'খিদে' কী জিনিস বুঝেছিল আমাদের এই রাজ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ির ভুলাভেদার বাসিন্দা, পরিযায়ী শ্রমিক সঞ্জয় সর্দার। বুঝেছিল জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজারের চা-শ্রমিক দীনেশ ওঁরাও। বোঝার পর সেই অনুভূতি জানানোর সুযোগ হয়নি তাঁদের, ততদিনে তারা এক-একটি সংখ্যা। খিদে কী বুঝিয়েছিল পাঁচ-ছয়ের দশকের খাদ্য আন্দোলন, শহর-গ্রাম-মফসসলে ভুখা মানুষের মিছিল থেকে গুদাম লুঠ, শাহাদত বরণ। আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ‛ছিনিয়ে খায়নি কেন’ গল্পে বৈকুন্ঠর গুদামে তিন হাজার মণ চাল থাকতেও মানুষ ছিনিয়ে খেতে পারে না। যোগী ডাকাত বুঝেছিল,
...এক দিন খেতে না পেলে শরীরটা শুধু শুকায় না, লড়াই করে ছিনিয়ে খেয়ে বাঁচার তাগিদও ঝিমিয়ে যায়। দু-চার দিন একটু কিছু খেতে পেলেই সেটা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দুদিন খেতে না পেলে ফের ঝিমিয়ে যায়। ..খেতে না পেলে গরু দুধ দেয়? না বলদ জমি চষে? কয়লা না খেয়ে ইঞ্জিন গাড়ি টানে?
খিদে কী, তা বুঝেছিল লীলা মজুমদারের ‛তেপান্তরের পাড়ের বাড়ি’ গল্পে না খেতে পেয়ে মারা যাওয়া সেই শিশু ভূতগুলোও, যারা তাদের ভুত-বাড়িতে অনাথ আশ্রম হবে এবং বাচ্চারা খেতে পাবে শুনে দেওয়াল জুড়ে হরিনাম লিখেছিল। খিদে কী বুঝেছিল নিকারাগুয়ার সেই কৃষক, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে এক পশ্চিমি সাংবাদিক যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “আপনার বাকস্বাধীনতা আছে?” উত্তরে সটান বলেছিলেন "আমার যথেষ্ট খাওয়ার স্বাধীনতা আছে।"
নতুন খবর দাও ভোর রক্তিম
কারা যেন আজও খায় পিঁপড়ের ডিম
খিদের বালাই বড় খিদের বালাই
খাবার না পেলে চলো দুনিয়াটা খাই।
কবীর সুমনের গানের এই লাইনগুলিই এখন বাস্তবের ঝংকার। চার সেকেন্ডে একজন না খেতে পেয়ে মরছেন এদেশে, অন্যদিকে ওই চার সেকেন্ডে সাড়ে সাত লক্ষ টাকার মুনাফা হচ্ছে আদানির। আমাদের হাতে রইল কিছু শুকনো তথ্য, একরাশ অপরাধবোধ, আর বিস্মৃত ইতিহাস।