দশটি গ্রাম নিয়ে জমিদারি! হুগলির এই জায়গায় ইতিহাস এখনও কথা বলে
সৌন্দর্যময় তোরণদ্বার, রোমান ক্যারিন্থিয়াম পিলার-যুক্ত সিংহদ্বার, নাচঘর প্রভৃতি জমিদারদের সুরুচির পরিচয় বহন করে।
হুগলি জেলার দশঘরার জমিদার বংশের ইতিহাসে লুকিয়ে বিশ্বাসদের জমিদার বাড়ির ইতিহাস। দশটি গ্রাম নিয়ে জমিদারির পত্তন হয়েছিল বলেই এর নাম দশঘরা। গ্রামগুলি হল: ১) শ্রীকৃষ্ণপুর, ২) শ্রীরামপুর, ৩) ইছাপুর, ৪) গোপীনগর,৫) জারগ্রাম, ৬) দেঘরা,৭) আগলা পুর, ৮) পারাম্ব, ৯) নলতবা এবং ১০) গঙ্গেশনগর।
শোনা যায়, একবার মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ এই দশঘরা থেকে কিছুটা দূরে চকদিঘি-তে কোনও এক সময় সৈন্যবাহিনী-সহ বিশ্রাম করেছিলেন। এই জমিদার বংশ পূর্বে থাকত হরিদ্বারে, পরে তারা উৎকল অর্থাৎ উড়িষ্যার রাজার আমন্ত্রণে সেখানে যায় এবং সেখান থেকে বিশ্বাস উপাধি নিয়ে অবশেষে এই বাংলায় এসে জমিদারির পত্তন করে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই বংশের জমিদার 'চোরগঙ্গ দেব'-এর সময় থেকেই এই পরিবার তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলার মাটিতে পা রাখেন। একটি ভাগ চলে যায় পুরুলিয়া-কাশীপুরে। এদের কথা আমরা জানি, এরা ইতিহাসবিখ্যাত পঞ্চকোট পরিবার (দেওদার সিং দেও)। একটি ভাগ চলে যায় কৃষ্ণনগরে, পরবর্তীতে এদের কথা বিশেষ জানা যায়নি। অপর ভাগটি চলে আসে হুগলিতে। জগমোহন দেব দ্বারা দশঘরায় জমিদারি পত্তন হয়। আদতে এরা ক্ষত্রিয় বংশজাত। পদবি বিশ্বাস হওয়ার ফলে এরা বর্তমানে কায়স্থ হিসেবে পরিচিত। পারিবারিক কোনও আচার-অনুষ্ঠানে এরা 'দেববিশ্বাস' পদবিতে সংকল্প করেন। পূর্ব পদবি 'দেও' থেকে ক্রমশ 'দেব' পদবিটি এসেছে।
আরও পড়ুন: সুড়ঙ্গ দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় মাটির তলার শহরে, যে রহস্য লুকিয়ে কৈলাস মন্দিরে
এই বংশের কুলদেবতা গোপীনাথ জিউ-র তিন খিলানবিশিষ্ট মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কষ্টিপাথরের গোপীনাথ জিউ-র মূর্তি-সহ এই মন্দির ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন জমিদার শ্রীসদানন্দ বিশ্বাস। জগমোহন বিশ্বাসের চার ছেলে ছিল। সর্বকনিষ্ঠ ছেলে নিধিরাম খুব অল্প বয়সে মারা যান। তখন তার মা শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। মায়ের এই অবস্থা দেখে তিন ছেলে হরিদ্বার থেকে তীর্থ করে ফেরার সময় গোপীনাথ জিউ-র মূর্তি নিয়ে আসেন। গোপীনাথ জিউ-র সঙ্গ পেয়ে তাঁদের মাতার শোক প্রশমিত হয়। কিন্তু মুশকিল দেখা দেয় অন্যত্র।বিশ্বাস বংশের রীতি-অনুযায়ী দেবী চণ্ডীর নিত্যপূজার প্রচলন ছিল বিশ্বাসবাড়িতে।
একই বাড়িতে দুই দেবতার নিত্যপূজা হতে পারে না। তাই দেবী চণ্ডীর ঘট গুরুগৃহে স্থানান্তরিত করা হয়।এরপর এই চণ্ডীমণ্ডপেই শুরু হয় জয়দুর্গার পুজো।অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি দেবী বিশালাক্ষীর মন্দির স্থাপিত হয়। মন্দিরের অন্দরে অপরূপ সাজে সজ্জিতা, সুন্দরী, স্মিতহাসিনী, নরমুণ্ডশোভিতা, শাড়ি-পরিহিতা বিশালাক্ষী মাতা দণ্ডায়মান। একদা সমৃদ্ধশালী বারোদুয়ারি রাজ্যের জমিদারদের বহু কীর্তি ছড়িয়ে রয়েছে এই দশঘড়া গ্রামে। এদের প্রতিষ্ঠিত গোপীসায়র দীঘি, অষ্টকোণাকৃতি রাসমঞ্চ, চারচালা দোলমঞ্চ, পঞ্চরত্ন গোপীনাথ জিউ-র মন্দির, আটচালা শিবমন্দির, জমিদারদের কাছারি বাড়ি, নহবৎখানা, জমিদার বাড়ির বৈঠকখানা (যা বর্তমানে স্থানীয় লোকজনের কাছে 'সাঘর' নামে পরিচিত, হয়তো জলসাঘরের অপভ্রংশ) আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
দশঘরা গ্রামের আরও এক বর্ধিষ্ণু জমিদারবাড়ি হল 'রায়বাড়ি'। এই বাড়িটি ঘিরে চতুর্দিকের বিস্তীর্ণ এলাকা রায়পাড়া নামে পরিচিত। রায়বাড়ির নাচঘরটি অসাধারণ। রায়বাড়িতে ঢুকতেই চোখ টানে একটি অষ্টভূজাকৃতি ঘড়িঘর। চারটি দেওয়ালে চারটি ঘড়ি এবং অন্য চারটি দেওয়ালে তখনকার দিনের খড়খড়ি দেওয়া জানালা। ঘড়ির মধ্যে এখনও প্রস্তুতকারকের নাম জাজ্বল্যমান- J M DASS & BROS, CALCUTTA. ঘড়িটির সুন্দর রোমান হরফের লেখা দেখে মনে হয়, এখনই ঘড়িটি ঢং ঢং করে বেজে উঠবে। সৌন্দর্যময় তোরণদ্বার, রোমান ক্যারিন্থিয়াম পিলার-যুক্ত সিংহদ্বার, নাচঘর প্রভৃতি জমিদারদের সুরুচির পরিচয় বহন করে। রাজবাড়ির শিবমন্দিরটি ডিম্বাকৃতি। শিবলিঙ্গকে বেষ্টন করে আছে একটি পিতলের নাগরাজ।
এই বংশের প্রতিষ্ঠিত একটি দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে এখানে। ১৯১৫ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন সার্জেন জেনারেল, G.F.A Harry সাহেব উদঘাটন করেন। রায়বাড়ির দুর্গাদালানটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী।দুর্গাদালানের অন্দরের দৃশ্য শুধু মনোগ্রাহী নয়, অভিনব। চমৎকার ইউরোপীয় শৈলির কাজের সঙ্গে মিশে আছে দশমহাবিদ্যা-সহ অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনি, যেমন ধূমাবতী, দশমহাবিদ্যা, অন্যান্য মুর্তি, বরাহ অবতার, কুঠার হাতে পরশুরাম, বলরাম ইত্যাদি।
বাংলা সনের ১৩২০, ২৯ বৈশাখ, জমিদার বিপিনকৃষ্ণ রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সুদৃশ্য দ্বিতল বাড়ি, বাড়ির সামনে একটি অপরূপ ঝিল, বাড়িটির নাম Bradley Birt Bungalow এবং বিলটির নাম 'কৃষ্ণরায় ঝিল'। ১৯১৫ সালের ২৫ আগস্ট তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট Bradley Brit এই বাড়িতে প্রথম এসে থাকেন, তাঁর নামানুসারে এই বাড়িটির এইরূপ নামকরণ হয়। এই বাড়িটিই হুগলি জেলার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট বাংলো।
ইতিহাসের পাতায় পাতায় অজানা তথ্য কানে কানে বার্তা দিয়ে চলেছে। শুধু খোঁজার অপেক্ষা।