নিষিদ্ধপল্লিতেও হয় কার্তিক পুজো! সন্তান পাওয়ার কিংবদন্তির আড়ালে যে সত্য
Kartik Puja: ভারতে ও বাংলার বিভিন্ন জনপদের কার্তিককে ঘিরে রয়েছে নানা মিথ। চলে আসছে নানান কৃত্য।
কার্তিক মাসের সংক্রান্তি। এই দিনটির জন্যই পাড়ার বন্ধুরা তাক করে আছে। নিজেরাই চাঁদা তুলে খরিদ করেছে একটি মূর্তি। এরপর নৈশ্য-গোপনতায় সেই মূর্তি ফেলতে হবে কাছের নববিবাহিত বন্ধুর দরজায়। পরের দিন সকালে ঘুম চোখে সস্ত্রীক যুবকটি আচমকা এক কার্তিক মূর্তি দেখে ঘাবড়ে গিয়েও পরক্ষণে স্নেহগন্ধে তুলে নেবে ঘরে। দেখতে পাবে, কার্তিকের নিজের বয়ানে লেখা চিঠি। মূর্তির গলায় বা হাতে সুতোয় গাঁথা সেই চিঠিতে লেখা থাকে “আমি তোমার খোকা আমায় নাও গো তুলে, বাপ মায়ের নামটি লিখে ভর্তি হব স্কুলে।" এরকমই একটি ছড়াসহ মূর্তি ‘প্রজাপতি বিস্কুট’ ছবিতে বাঙালিমাত্রেই দেখেছিল। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এধরনের কার্তিকের উড়ো চিঠির আরও নমুনা পাওয়া যায়। যেখানে লেখা থাকে, ‘আমাকে আনতে কাকাদের ৪০১টাকা খরচ হয়েছে’ অথবা ‘কাকারা যা যা খেতে চায় তার তালিকা রয়েছে- মন ভরে খাইও’, আরও কত কী!
বাংলায় কার্তিকপুজোর সঙ্গে এই কৌতুকময় বিষয়টি ঠিক কবে জুড়ে গেছে, তা বলা যায় না, তবে এই দেব-আরাধনার পিছনে রয়েছে সন্তান-প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা। এখানে কার্তিক পুত্রসন্তান-প্রদায়ক প্রজননের দেবতা। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে কার্তিকঠাকুরের আরও অনেক চরিত্রের খোঁজ পাওয়া যায়।
কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে পুরাণেভেদে বিভিন্ন আখ্যান রয়েছে। তাদের ভেতর প্রায় সাদৃশ্যের জায়গাটি হলো, তারকাসুর বধের জন্য শিব দীর্ঘ সঙ্গমে লিপ্ত হলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের কারসাজির ফলে সঙ্গম থেকে বিচ্যুত হন শিব। আচমকা শিববীর্য ভূমিতে গিয়ে পড়ে। ভূমি সহ্য করতে অপারগ হলে তা আগুনে নিক্ষিপ্ত করে, শেষে শিববীর্য গিয়ে পড়ল শরবনে। জন্ম হলো কার্তিকের। সেখানে ছ’জন কৃত্তিকা এসে সদ্যোজাতকে স্তন্যপান করান। তাই কার্তিকের আরেকটি নাম ষড়ানন। অসুর বধের জন্যই কার্তিকের জন্ম।
আরও পড়ুন: কৃষ্ণচন্দ্র দর্শন পেয়েছিলেন যোদ্ধাবেশী জগদ্ধাত্রীর! আজও অটুট যে কিংবদন্তি
তিনি দেবসেনাপতি ও মহাধনুর্ধর। কিন্তু বাংলা সংস্কৃতিতে যোদ্ধাবেশী কার্তিকের চেয়ে ফিটফাট বাবুচালের কার্তিকমূর্তিই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। পুরাণ ও লৌকিক কাহিনিগুলিতে কার্তিক কখনও লম্পট চরিত্রের, কখনও ভ্রুণবিনাশকারী অপদেবতা, আবার নারীনিগ্রহের প্রতিমূর্তি। পুরাণ থেকে জানা যায়, কার্তিক একসময় দেবপত্নীদের বলাৎকারের জন্য উন্মুখ। তখন দেবী দুর্গা দেবপত্নীদের মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করান। কার্তিক কামমত্ত হয়ে সেসব নারীর দিকে তাকালে নিজের মায়ের মুখ দেখতে পেয়ে কামবিমুখ ও লজ্জিত হয়ে ফিরে আসেন। অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পৌরাণিকা’ নামক পৌরাণিক অভিধানে দেখা যায় কার্তিক কৃত্তিকাদের জানান ষোলো বছর হলে কার্তিক শিশুহত্যা করবে আর তাদের ভক্ষ্য হিসেবে কৃত্তিকাদের কাছে দিয়ে যাবেন। এরপর তার দেহ থেকে উজ্জ্বল বর্ণের পুরুষ বের হয়ে আসে যারা রৌদ্রগ্রহ বা পুতুনাগ্রহ বা শকুনিগ্রহ। এখানে কার্তিক অপদেবতার সদৃশ। ষোলো বছরের বালকবালিকাদের ক্ষতি করাই তার উদ্দেশ্য। বোঝা যায় কার্তিক বেশ বিতর্কিত এক দেবতা। তিনি কি সন্তান প্রদানের দেবতা? নাকি সন্তানের ওপর থেকে তাঁর কুদৃষ্টি এড়ানোর জন্য তাঁকে সন্তুষ্ট করতে মেয়েরা এই ব্রত পালন করা? সময়বিশেষে উভয়ই সত্য!
সুজিত চৌধুরীর লেখা থেকে জানতে পারি, যৌধেয় জনজাতি সর্বপ্রথম কার্তিককে তাদের অধীশ্বর দেবতা হিসেবে গ্রহণ করে। পাণিনিও এই জনজাতির কথা বলেছেন। এদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রথম শতক থেকে সমুদ্রগুপ্তের সময়কাল পর্যন্ত। সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘মত্তময়ূরী’ বলে একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে যার সঙ্গে যৌধেয়দের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মত্তময়ূর থেকে বোঝা যায়, ময়ূর এদের টোটেম। এখান থেকে কার্তিকবাহনের পূর্বসূত্রটির একপ্রকার আঁচ করা যেতে পারে।
পরবর্তীকালে অন্য জাতিদের মধ্যে কার্তিক পুজোর প্রচলন হয়। কুষাণ রাজা হুবিষ্ক কার্তিক ও ময়ূরমার্কা মুদ্রা চালু করেন। মুদ্রা, স্তম্ভে, প্রস্তরলিপিতে এই দেবতাপুজোর প্রমাণ মেলে। গুপ্তযুগে কার্তিক আরাধনার বিশেষ মাত্রা পায়। এই সময়ে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যটির রচনাকাল। যার মাধ্যমে কার্তিকপুজোকে সর্বজনগ্রাহ্য করবার একটি প্রয়াস ধরা থাকে।
সুরমা-বরাক উপত্যকায় কার্তিকপুজোয় এক বিশেষ পদ্ধতি লক্ষ করা যায়। কার্তিক ঠাকুরকে নিয়ে এক লোককাহিনি এই অঞ্চলের মহিলামহলে বেশ প্রচলিত। সেটি আগে জানা যাক।
একবার অসুরদের যুদ্ধে পরাস্ত করে কার্তিক ফিরে আসছে তখন এক রূপবতী দেবকন্যা ঊষার সঙ্গে তার দেখা হয়। ঊষা কার্তিককে বিয়ে করতে চায়। কার্তিকও তাতে সম্মত হয়ে ঊষাকে ধানের ক্ষেতে দাঁড় করিয়ে রেখে দুর্গার কাছে অনুমতি নিতে যায়। বিয়ের পূর্বে কার্তিক মাকে প্রণাম করতে গিয়ে দেখে মা আস্ত একটা মহিষ খাচ্ছেন। কেননা বউ বাড়িতে এলে তাকে হয়তো খেতেই দেবে না। কার্তিক কথা দেওয়া সত্ত্বেও ঊষাকে বিয়ে করল না। অথচ ঊষা বীজক্ষেত্রে তখনও অপেক্ষা করছে। শেষ পর্যন্ত ঊষা প্রত্যাখ্যানের অপমান নিয়ে আজীবন ধানক্ষেতেই লুকিয়ে রইল।
‘সুরমা-বরাক’ অঞ্চলের মেয়েদের মনে ঊষার দুঃখের কথা আজও অমলিন। তাই সেখানকার মেয়েরা কার্তিক পুজোর আগে মাটির সরায় একটি নকল বীজক্ষেত্র বানায়। তাতে ধানের চারা বের করে এবং একটি পুতুল বানিয়ে সরাপাত্রে লুকিয়ে রাখে। ঊষার প্রতীক এই পুতুল। পুতুল-সহ এই সরাটি কার্তিক পুজোর অঙ্গ হয়ে যায়।
বাংলার বিভিন্ন গ্রামে এখনও পুজো করার সময় একটি ধান্যক্ষেত্র তৈরি করা হয়। উঠোনের মাঝখানে গোলাকার মৃত্তিকাস্তুপে ধানের বীজ ছড়িয়ে নবাঙ্কুর ক্ষেত বানিয়ে নেয় গ্রামবাসীরা। সংক্রান্তির দিন কার্তিকের মূর্তি রেখে পুজো করে স্ত্রীলোকেরা।
সমাজবিজ্ঞানীরা এই কৃত্রিম ধান্যক্ষেত্রকে বলেন ‘অ্যাডোনিস গার্ডেন’। এখানে মনে হয় কার্তিক শস্য বা প্রজননের দেবতা। উর্বরতা বা শস্য সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত কার্তিক। দেখা যাবে, বর্ধমানের কাটোয়া ও আশেপাশের গ্রামে অঘ্রাণ মাসে নতুন ধান দিয়ে কার্তিক পুজোর রেওয়াজ প্রচলিত যদিও সেটি কার্তিক সংক্রান্তির পরে হয়।
‘দেবদেবী ও তাদের বাহন’ বইতে স্বামী নির্মলানন্দ জানিয়েছেন:
হিন্দু ভুলেছে মহাবীর কার্তিকেয়র বীর্যপ্রদ চরিত্র। অধুনা ভীরু, বিলাসী বাঙালি তাঁকে পরিনত করেছে বাবু কার্তিকে। কার্তিকেয় পূজার আড়ম্বর আজ তরুণদের মধ্যে নেই; তা সরে গিয়ে প্রবেশ করেছে কদর্য পতিতালয়ে।
নিষিদ্ধপল্লিতে কার্তিক পুজোর প্রচলন দেখা যায়। এরাও তৈরি করে ‘অ্যাডোনিস গার্ডেন’। কাটোয়ার পতিতাপল্লির চুনুটিপাড়ার কার্তিক পুজোর জাঁক সকলেই জানে। সেখানে আজও ন্যাংটো কার্তিক পুজো হয়। অনেকে মনে করেন, বিবাহসম্পর্কে না যাওয়ার বঞ্চিত গণিকারা কার্তিককে তাদের দেবতা বানিয়েছেন কিংবা কার্তিকের মতো রূপগুনবান খদ্দের তাদের পছন্দ তাই কার্তিক তাদের প্রিয়। কিন্তু সুজিত চৌধুরীর মতে, পুরাণে কার্তিকের ব্যাভিচারের দিকটি পাওয়া যায়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী পুরোহিতরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে গণিকায় পরিনত হয়েছিল। কার্তিকের সঙ্গে গণিকাদের এই সংযোগ পুরুষ আধিপত্যবাদের কাছে নারীপুরোহিতদের সমর্পণের স্মারক-চিহ্ন। আর বেশ্যাপল্লির সরাপূর্ণ কৃত্রিম ধানের ক্ষেত আসলে কৃষিজীবী সমাজে তাদের অতীত গৌরবময়তার ইঙ্গিত ও তার ভ্রষ্টপথের গূঢ়দিকটিকেই সংকেতিত করে।
গৃহস্থ পরিসরে কার্তিকপুজো প্রবেশ করেছে এবং বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। কিন্তু কার্তিক পুজোর জাঁক লক্ষ করা যায়, হুগলির চুঁচুড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া আর বর্ধমানের কাটোয়ায়। মূলত গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সওদাগরদের আনাগোনা সেই সূত্রে বারবনিতাদের সমাগম হতো সেখানে। এটাই ছিল অতীত বাংলায় কার্তিক পুজো সূচনার একটি ক্ষেত্র। সেখান থেকে পুজো ক্রমশ সরে যায় সাধারণ মানুষের অঙ্গনে। বর্তমানে চাঁদা তুলে বারোয়ারি পুজোর রমরমা। গঙ্গা-তীরবর্তী অঞ্চল ছাড়াও বাঁকুড়ার সোনামুখিতেও কার্তিক পুজোর সমারোহ লক্ষ করার মতো। দক্ষিণ ভারতেও কার্তিক পুজো অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেখানে কার্তিকের নাম সুব্রহ্মণ্য, মরুগান।
ভারতে ও বাংলার বিভিন্ন জনপদের কার্তিককে ঘিরে রয়েছে নানা মিথ। চলে আসছে নানান কৃত্য। দেব ভাবনায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য। আবার সেগুলিও সময়বিশেষে পাল্টে ফেলছে তাদের ধরন। তাই যে কার্তিক কারও কাছে প্রজননের দেবতা, কারও কাছে শস্যের, আবার কোথাও পতিতাদের প্রিয়, কখনও বা অপদেবতা। আসলে মানুষ তাদের স্থান ও কালের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছিল এক রূপ। আবার মানুষের কারণেই বদলে বদলে গেছে সেই ইতিহাস।