রবীন্দ্রনাথ আঁতকে ওঠার ভান করলেন মোহরের কথা শুনে...
আমরা ছেলে ছোকরার দল তখন গোরাদার নেতৃত্বে কোথায় , কী ভাবে লুকোবো মোহরদিকে, তাই ভাবছি। আর মোহরদি লুকোচ্ছেন নিজেকে। এরই ভিতরে চলে এসেছেন সুচিত্রা মিত্র ' আনন্দধারা'-তে।রাত তখন প্রায় দশটা। 'ওরে বাবা, এতো রাতে সুচিত্রা!' বলেই তড়িঘড়ি দরজায় খিল এঁটে শুয়ে পড়লেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাতের আড্ডায় খাদ্য- পানীয়ের তালে তালে সুচিত্রা খোলা গলায় গেয়ে চলেছেন। ছাত্রী অবস্থায় প্রথম শান্তিনিকেতনে এসে চটি পড়া কলকাতার মেয়েটাকে বন্ধু করেও এইরকম ভাবে কী করে সিঁটিয়ে থাকতো মোহর, তার গল্পে মশগুল তখন সুচিত্রা। পরের দিন সকালে মোহরদি বললেন; কাল কিন্তু বড় ভালো গাইছিল সুচিত্রা। 'যেদিন ভবের মেয়াদ ফুরাবে ভাই আগল যাবে খসে' - ওর মতো করে গাইতে কেউ পারবে না- আপন মনে বলে চলেছেন মোহর আর ছোট্ট জাঁতিটা দিয়ে কুট কুট করে সুপুরি কেটে চলেছেন।
আগন্তুক-এর শ্যুটিং করতে শান্তিনিকেতনে এসেছেন তিনি। কখনো পান খাওয়ার অভ্যাস নেই। তবে মোহরের হাতে কাটা সুপুরি খাওয়ার অভ্যাস সেই ছাত্রজীবন থেকে--অকপটে বলছেন সত্যজিৎ রায়' আনন্দধারা' র সেই বিস্তৃত ডাইনিং হলে বসে। বিজয়া রায় থেকে উৎপল দত্ত, মমতাশঙ্কর থেকে শুরু করে নবদা- কে শ্রোতা নন। আর আমাদের ছোট্ট পম, মোহরদির তানাজি, তখন ছুটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হলঘরটা। কারণ, একটু আগেই মানিকমামা তাঁকে বলেছেন, ওর সঙ্গে ক্রিকেট খেলবেন। পমের বিরক্তি, উঠছে না কেন লম্বা লোকটা। আর সেই কিন্নর কন্ঠে পমকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন মোহরদি, পম, 'মানিকদার হার্টের অসুখ তোমাকে বলেছি না।'
'সেইরকমই থেকে গেলে মোহর। জোর গলায় কাউকে বকতেও শিখলে না। হার্টের অসুখ কি এতোটুকুনি ছেলে বোঝে?'. বললেন মঙ্কুমাসী. এরই ভিতরে বনের পুকুরে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। শ্যুটিং দলের মানুষেরা তাড়া দিচ্ছে সত্যজিৎকে। 'আজকেই কিন্তু নাচের শটগুলো নেব',কণিকাকে বললেন সত্যজিৎ।
'তোমার কথায় মানিকদা অনেক খুঁজে খুঁজে এই মেয়েগুলোকে জোগার করা হয়েছে। তবে জোগারের কৃতিত্ব সবটাই নবর। ওঁদের নাচ দেখেছি। ভালো নাচে। তোমার ও মনেহয় ভালো লাগবে।'
'সেই জন্যেই তো এই নাচের মেয়ে জোগাড়, লোকেশন সিলেকশন-- সবটাই তোমার উপরে ছেড়ে দিয়েছি'- কণিকার কথার জবাবে সত্যজিৎর কথা শুনে লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেলেন কণিকা। সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষও গানের বাইরে,তাঁর ফিল্মের শুটিংয়ের খুঁটিনাটির প্রয়োজনে তাঁর উপর নির্ভর করেন, এটাতেও যেন লাজুক কণিকার বিড়ম্বনার শেষ নেই। এমনটাই ছিলেন কণিকা। তাই তাঁর চলে যাওয়ার পর আজ যেটা মোহরকুঞ্জ, সেখানে সেই সময়ের রাজ্য সরকারের উদ্যোগে তাঁর নশ্বর দেহ রেখে দেওয়ার ঘটনায় খুব বিরক্ত হয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন; 'লজ্জা যে ছিল মোহরের অঙ্গের ভূষণ।নিজেকে এক্সিবিট করার কথা মোহর কখনো ভাবতেই পারত না।আর সেই মানুষের ডেড বডি ওই ভাবে প্রদর্শিত করা হলো? আমি যাইইনি নিথর মোহরকে দেখতে।'
এই সিরিজের আগের লেখা-সেদিন সন্তানতুল্য বুদ্ধদেবের কটাক্ষে আহত হয়েছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়
শেষ অসুস্থতার সময়ে তৎকালীন রাজ্য সরকার ব্যবস্থা করেছেন তাঁর চিকিৎসার এসএসকেএম-এ। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে তাঁকে আনা হচ্ছে কলকাতায়। হাওড়া স্টেশনে গাড়ি ঢোকার পর জানলা দিয়ে ভিড় দেখে একটু ঘাবড়েই গিয়েছেন তিনি। ওই ভিড় যে শান্তিনিকেতন থেকে অসুস্থ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আসছেন বলেই, সেটা ভাবতেই পারেন না সাধারণের থেকেও সাধারণ কণিকা। তাই একটু ঘাবড়ে গিয়েই গোরা সর্বাধিকারীকে জিজ্ঞাসা করছেন; 'গোরা, আমরা কি করে পিজি হাসপাতালে যাব?' তেমন মজাদার মানুষ গোরাদাও। বললেন, 'সাইকেল করে।তোমাকে সাইকেলের হাতলে বসিয়ে নিয়ে যাব।'
শেষ অসুখের আগেও একবার মারাত্মক অসুস্থ হয়ে এসএসকেএমে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সেইবার কার্ডিওলজি বিভাগে পাশাপাশি দু'টো ঘরে আছেন শান্তিদেব ঘোষ আর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। গুরুশিষ্যায় জমিয়ে আড্ডা, পান আর জর্দা খাওয়াও চলছে। আছেন হাসি বৌঠান ইলা ঘোষ। শান্তিদেবের ঘরণী। সেদিন কলঘরে পড়ে গেলেন শান্তিদা মাথা ঘুরে। হুলুস্থুলু কান্ড হাসপাতাল জুড়ে। তাবড় তাবড় ডাক্তারবাবুরা ছুটে এলেন। তারপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেল, অতিরিক্ত জর্দা খাওয়ার ফল। আর যায় কোথায়, শান্তিদেব- কণিকা, গুরুশিষ্যা দু'জনে মিলে ঠিক করলেন, আর জর্দা খাবেন না।হাসিবৌঠান যেমন হাসছেন, তেমনিই আসছেন রুণুদি, বীথিকা মুখোপাধ্যায়, মোহরের ছোটবোন। কারণ, দু'জনেরই মনে সংশয় আর আগ্রহ; দেখি, কতদিন ওঁরা প্রতিজ্ঞা বজায় রাখতে পারে।
তখন শান্তিনিকেতনের আশেপাশে সিনেমা হল বলতে, সবেধন নীলমণি , বোলপুরের ' বিচিত্রা' । মোহর একবার সদলবলে গিয়েছেন সিনেমা দেখতে। সিনেমার আলোতে পাশে বসা একজন মহিলাকে দেখে তাঁর কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে,অথচ ঠিক চিনে উঠতে পারছেন না।এইরকম মনের অবস্থায় সিনেমার দিকে ঠিক মতো মনঃসংযোগ ও করতে পারছেন না। হাফ টাইমে আলো জ্বলতেই দেখেন, আরে এযে আমাদের ধোপার বৌ।আরে একী কান্ড, এই কাপড়টাই তো কদিন আগে আমি কাচতে পাঠিয়েছি। সেটাই তো পড়ে এসেছে ধোপার বৌ। কণিকার সবটা ভাবা আর বোঝার আগেই ধোপার বৌ পড়ি কি মরি করে পালিয়েছে। সিনেমা মাথায় উঠেছে তার তখন সিনেমা দেখা হলের ভিতরে মোহরদিকে দেখতে পেয়ে।
আরো অনেককাল আগে। ফরটিফাইভে (শান্তিনিকেতনের যে বাড়িতে থাকতেন) তখনও আসেননি ওঁরা। নীচুবাংলার পাশে থাকেন। হঠাৎ এক ফেরিওয়ালা এসে বলে; 'মা, আমরা সোনার গয়না পরিস্কার করি।ময়লা তুলে ঝকঝকে করে দেব।' বিশ্বাস করে গিয়েছেন মোহরদি। আলমারি খুলে যাবতীয় গয়না বের করে দিয়েছেন ফেরিওয়ালাকে। প্রায় সারাদিন জুড়ে তারা টুকটুক করে কাজ করছে। বীরেনদা, বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহরদির স্বামী, বিশ্বভারতীর লাইব্রেরি থেকে আসবার আগেই সেই ফেরিওয়ালারা বলে; 'মা অ্যাসিডের জলের ভিতরে সব গয়ন গুলো এই মাটির হাঁড়িতে করে আমরা চুবিয়ে রেখে গেলাম। একদম হাত দেবেন না। আমরা কাল সকাল সকাল এসে ওগুলো একদম ঝকঝকে করে আপনার হাতে তুলে দেব।'
অবলীলায় গয়না পরিস্কারওয়ালা চলে গেল।মোহরদির এতোটুকু সন্দেহ বা সংশয়, কিছুই হয়নি। বীরেনদাকেও কিছু বলেননি।পরের দিন, অনেক বেলা হয়ে গেল, এখনো গয়না পরিস্কার করবার লোকগুলো এলো না। একটু একটু করে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে মোহরদির কপালে। শেষকালে আর থাকতে না পেরে সবটা খুলেই বললেন বীরেনদাকে। শান্তভাবে বীরেনদা সেই মাটির হাঁড়িগুলো হাতড়ে দেখেন, তাতে রয়েছে কিছু নুড়িপাথর। কোথায় গয়না!
ওই নীচুবাংলায় থাকাকালীন আর একটা ঘটনা। এক চোর ওই বাড়িতে চুরি করতে এসে ধরা পড়ে গেছে। পড়শিরা চোরকে ঘিরে ধরেছে। মারবে মারবে করছে। এমন সময়ে সঙ্গীতভবনের ছুটির পর মোহরদি ফিরেছেন। সঙ্গীতভবন থেকে বড় একটা ছাতা মাথায় করে ফিরতেন মোহরদি। ওঁদের পড়শিরা তো সেই ছাতা দিয়েই চোরকে মারবে। সবাইকে শান্ত করে মোহরদি সবটা শুনলেন। শুনে চোর করে বললেন; 'আর কখনো এমনটা করবে না কিন্তু।'
এইখানেই তিনি থামলেন না। বাড়ির ভিতর থেকে মিষ্টি, জল এনে চোরকে খাইয়ে তবে সেই চোরকে তিনি বিদায় দিলেন।
কোনো মানুষকেই কখনো নেতিবাচক দৃষ্টিতে কখনো দেখতে পারতেন না মোহরদি।গায়িকা কণিকার বিচার তো মহাকাল করেইছে।গায়িকা কণিকার সাথে যেন পাল্লা দিয়ে আত্মবিকাশ ঘটেছিল মানুষ কণিকার।কটু কথা বলা, কঠিন কথা বলা- এগুলো সব ছিল তাঁর স্বাভাব বিরুদ্ধ ব্যাপার। এই যে তাঁর মনের বিকাশ, সেটার জন্যে বোধহয় গুরুদেবের ব্যক্তিপ্রভাবটা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর অনেক বেশি স্থায়ী হয়েছিল।তিনি ম্যাট্রিক পাশ করে প্রণাম করতে গিয়েছেন গুরুদেবকে। প্রণাম করতেই গুরুদেব বললেন; 'হঠাৎ প্রণাম করছিস কেন?'
অবন ঠাকুরের 'আকবরী মোহর'-এর উত্তর, 'ম্যাট্রিক পাশ করেছি।' আঁতকে উঠলেন গুরুদেব, 'সে কি রে! তুই তো আমার থেকেও শিক্ষিত হয়ে গেলি।আমি তো ম্যাট্রিকও পাশ নয়।'