নদীর গর্ভে লুকিয়ে আছে সোনা! আজও কিংবদন্তি আর রহস্যে মোড়া সুবর্ণরেখা
Subarnarekha river: প্রায়ই সোনা পাওয়া যায় ভারতের এই নদীটিতে।
ভারত নদীমাতৃক দেশ। ভারতে জালের মতো বিস্তৃত হয়ে রয়েছে কমবেশি প্রায় চারশোটি নদী। আমাদের দেশের কৃষিকাজের অনেকটাই নির্ভর করে নদীগুলির ওপর। এছাড়াও পানীয় জল, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কলকারখানা, নগর গড়ে ওঠা- সবকিছুই নদীর ওপর নির্ভরশীল। ভারতের মোটামুটি সব নদীরই কিছু না কিছু বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে কোনও না কোনও ধর্মের মানুষের কাছে। তবে আমাদের দেশে এমন অনেক নদী আছে, যেগুলোর নিজস্ব কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। এই রকমই একটি নদীর কথা জানা যাক। কেমন হবে, যদি জানা যায় যে, নদীর জলে মাছের পাশাপাশি সোনাও পাওয়া যায়? আর কদাচিৎ নয়, প্রায়ই সোনা পাওয়া যায় ভারতের এই নদীটিতে। আমাদের দেশের এই নদীটির কথা অনেকেই জানেন না।
এই নদীর নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সোনা। ভারতের ঝাড়খণ্ডের সুবর্ণরেখা নদীর কথা বলা হচ্ছে। অনেকেই ভাবতে পারেন, বোধহয় নামের শুরুতে সোনা রয়েছে নদীটির। কিন্তু নামের পাশাপাশি বাস্তবেও এই নদীর নিচে মেলে সোনা। সুবর্ণরেখার অর্থ হলো, ‘সোনার রেখা বা, আঁকড়’। ঝাড়খণ্ডের রাঁচি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ছোটনাগপুর মালভূমিতে পিস্ক নামের একটা জায়গা থেকে উৎপত্তি হওয়া এই নদী পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। অনেক পর্যটক যারা ঘুরতে গিয়েছেন, তাঁরাও দেখেছেন, নদীর পাড়ে পরে রয়েছে সোনার পাথর। এমনকী, এই নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল তামর এবং সারান্দার বাসিন্দারা কয়েক শতাব্দী ধরে সোনা পরিশ্রুত করেই রোজগার করছেন, পেট চালাচ্ছেন নিজেদের।
৪৭৪ কিলোমিটার লম্বা সুবর্ণরেখা নদীকে স্থানীয় লোকরা ‘করকরি নদী’ নামে অভিহিত করে থাকেন। নদীর বেশিরভাগই পাথরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেই থেকেই সোনা পাওয়া যায় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। অবশ্য ঠিক কোন কারণে সুবর্ণরেখা নদী থেকে সোনা পাওয়া যায়, তা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে সোনা কিন্তু খুব সহজে মেলে এই নদী থেকে। সোনা পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তার জন্যে করতে হয় কঠোর পরিশ্রম। অবশ্য সোনা পাওয়া গেলেও সেই সোনার পরিমাণ এতই কম হয় যে, তাতে সংসার চলে না পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দাদের। সব্বোর্চ ৭০ থেকে ৮০টি সোনা অনেক প্ররিশ্রম করে সংগ্ৰহ করে অধিবাসীরা। তারপর সেই সোনা বিক্রি করে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। এই সোনা পরিশোধন করে ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা মাসে মোটামুটি ৭-৮ হাজার টাকা রোজগার করেন।
আরও পড়ুন: নদীর গর্ভে পাঁচশো বছরেরও পুরনো মন্দির, যেভাবে আবিষ্কার হয়েছিল এই প্রাচীন স্থাপত্য
আপনি এই নদীর ধার দিয়ে হেঁটে গেলেই দেখতে পাবেন, বেশ কিছু মানুষ একটা থালার ওপর নদীর বালি তুলছেন। জল-পাথরের গা ঘষে আসার সময় নিয়ে আসে সোনার কণা। জল-বালিতে মিশে থাকা সোনাকে গ্রামের আদিবাসী মানুষ একটা ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নেয়। এমনভাবে জল-বালি ছেঁকে সোনা বের করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এই সোনা যারা কিনতে আসেন, তাঁদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘নেহারা ধুলাইওয়ালা’। চলার পথেই কারু, কাঞ্চি, করকরি, খরখরি, গরা, শঙ্খ, জুমার, ডুলুং ও আরও অনেক ছোট ছোট নদী এসে মেশে সুবর্ণরেখায়।
তবে এই সব ছোট ছোট নদীর মধ্যে খরখরির (এটি যদিও একটি নদ) সঙ্গে সুবর্ণরেখার সম্পর্ক নিয়ে বেশ দারুন একটি লোককথা প্রচলিত আছে। শোনা যায়, খরখরি সুবর্ণরেখাকে ভালবাসত। কিন্তু কোনও দিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে। এভাবেই চলছিল খরখরির একতরফা প্রেম। কিন্তু একদিন খরখরি সুবর্ণরেখাকে দেখে ফেলে ভরা বর্ষায় আপন ছন্দে নাচতে। এমন নৈসর্গিক মুহূর্তে খরখরি নিজেকে সামলাতে না পেরে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে সুবর্ণরেখাকে। সুন্দরী সুবর্ণরেখা তো এককথায় বিয়েতে রাজি। কিন্তু একই সঙ্গে খরখরিকে একটি শর্তও দিল সুবর্ণরেখা। বড় কঠিন শর্ত সে। যতদিন খরখরি সুবর্ণরেখাকে সোনায় মুড়ে রাখবে, ততদিনই সে খরখরির সঙ্গে সংসার করবে, এমনই ছিল সেই শর্ত। এবং এই শর্তে রাজি হওয়ার পর থেকেই খরখরির জলের সঙ্গে সোনা এসে মেশে সুবর্ণরেখায়। উড়িষ্যার প্রবীণ মানুষজন এমনই মনে করেন।
এমনই সোনা এবং ভালবাসার প্রতীক একটি নদী আমাদের বাংলার উত্তরবঙ্গেও রয়েছে। পাহাড়ের বন্ধুর চড়াই-উতরাই পথ ভেঙে নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছে সে। এই নদীর গতিপথের বাঁকে মিশে আছে এক কিংবদন্তিও। শোনা যায় এক রাজপুত্র সাতসমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এক জঙ্গলঘেরা জায়গায় এসে বসল। অনেক পথ চলার পরিশ্রমে সে ক্লান্ত। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছে তেষ্টায়। একটু দূর দিয়েই বয়ে যাচ্ছিল একটা নদী। স্ফটিক-স্বচ্ছ জল রাজপুত্র এর আগে কোত্থাও দেখেনি। সেই পাহাড়ি নদীতে নেমে আঁজলা ভরে জল পান করতে গিয়ে রাজপুত্রর হাতে জড়িয়ে যায় একটা চুল। তবে সাধারণ চুল নয়, সেই চুলটা ছিল সোনার। সেই চুলটিকে নিজের কাছে রেখে স্রোতের পথ ধরে হাঁটতে লাগল সে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল এক অজানা দেশে। সেখানে গিয়ে দেখে, এক রাজকন্যার মাথাভর্তি সোনার চুল। আর সেই চুল-ধোয়া জলেই তৈরি হচ্ছে নদী। সোনা কেশের এই নদীর নাম হল স্বর্ণকেশী। পরবর্তী সময়ে অপভ্রংশ হয়ে সঙ্কোশ। এমনই লোক বিশ্বাস রয়েছে সঙ্কোশ নদীতে সোনা পাওয়া নিয়ে। নেটফ্লিক্সের একটি জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ হল ‘Love Death + Robots’। এই সিরিজটির তৃতীয় সিজনের অন্তিম এপিসোডর নাম ‘জীবারো’ (Jibaro)। ওই এপিসোডটির সঙ্গে এই সঙ্কোশ নদীর লোককথার অনেকটা মিল রয়েছে।
প্রসঙ্গত, এখন সঙ্কোশ নদীতে আর সেরকম সোনা পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে স্বর্ণকণা আসে বটে তবে তা না আসার মতোই। যাই হোক, শুধু সুবর্ণরেখা বা সঙ্কোশ নদী নয়, ভারতের আরও অনেক নদীতেই সোনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, গুজরাতের তরঙ্গ পাহাড় থেকে জন্ম নেওয়া রূপেন নদী, ছত্তিশগড়ের বস্তার পাহাড় থেকে আসা পারালকোটা নদী (স্থানীয় নাম কোটরি নদী, এটি ইন্দ্রাবতী নদীর একটা শাখা), জামশেদপুরের খারকাই নদী প্রভৃতি। এই নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় সারা বছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমান সোনার সন্ধানে। আপনিও পরেরবার এসব অঞ্চলে ঘুরতে গেলে একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি সোনা খোঁজার?