কেউ বলেন ‘হিরো’, কেউ ’রাস্তার গুন্ডা’! আসলে কে এই বিতর্কিত গোপাল পাঁঠা?

Who is Gopal Patha: বউবাজারের মঙ্গলা লেনের বাসিন্দা ছিলেন গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পারিবারিক সূত্রে তাঁরা পাঁঠার মাংসের ব্যবসা করতেন।

সময় যত এগোচ্ছে, পৃথিবীর যত বয়স বাড়ছে ইতিহাসের বইয়ে ততই জুড়ছে নতুন পাতা। এমনই এক সোনালি পাতা ইতিহাসের বইয়ে জুড়ে ছিল অগাস্ট ১৯৪৭-এ। সুদীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতা কাটিয়ে স্বাধীন হয়েছিল ভারত। কিন্তু কথায় বলে, ভোরের আগে রাত সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সেটাই প্রযোজ্য। স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার আগে আমাদের দেশকেও এমন অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত দেখতে হয়েছে। ১৫ অগাস্ট যখন জওহরলাল নেহরু পাঠ করছেন, “At the stroke of midnight, when the world is sleeping...”, সেই সময় সেই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত মহাত্মা গান্ধী। তিনি রয়েছেন জোড়াসাঁকোর এক পুড়ে যাওয়া বাড়ির এক তলায়। বিনিদ্র অবস্থায় কাটাচ্ছেন রাতের পর রাত। স্বাধীনতার উৎসবে কেন তিনি শামিল হচ্ছেন না জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছিলেন, “স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপন করার থেকেও বেশি হিন্দু-মুসলিম একতা বজায় রাখা দরকার ছিল। যেভাবে ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীনতা পেয়েছে তা এই দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করে দিয়েছে।” কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দিল্লিতে থাকার বদলে কলকাতায় কেন রয়েছেন গান্ধীজি? এর কারণ জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে এক বছর আগের বাংলায়।

১৯৪৬ সালের মে মাসে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি নির্দেশ দেন ভারতীয়দের হাতে ভারতের শাসনভার তুলে দিতে হবে। তিনি ৩ সদস্যের কমিটি পাঠান ভারতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সঙ্গে কথা বলে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য। সেই কমিটি প্রস্তাব দেয়, হিন্দু গরিষ্ঠ এলাকাগুলি নিয়ে ভারত গঠন হোক এবং ভারতেরই মুসলমান গরিষ্ঠ এলাকাগুলি নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হোক। মুসলিম লীগ এক বাক্যে রাজি। বেঁকে বসল কংগ্রেস! তাদের দাবি, কিছুতেই ভারত ভাগ হতে দেওয়া যাবে না। মহম্মদ আলি জিন্না যখন দেখলেন ভালো কথায় কাজ হচ্ছে না, তিনি ঘোষণা করলেন ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা ডি-ডে'র (D Day)। এর উদ্দেশ‍্য ছিল পাকিস্তান গঠনের দাবির সপক্ষে ঔপনিবেশিক সরকারের সামনে বিক্ষোভ এবং শক্তি-প্রদর্শন।

সেই সময় দেশের বিভিন্ন প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রধানমন্ত্রী বা প্রিমিয়ার ছিলেন যা পরবর্তীকালে মুখ্যমন্ত্রী পদে রূপান্তরিত হয়। সেই সময় পশ্চিমবাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দী। ১৬ অগাস্ট অর্থাৎ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে'র দিন সুহরাওয়ার্দী কলকাতা পুলিশকে ছুটি দিয়ে দিলেন এবং বাংলা বন্ধের ঘোষণা করে দিলেন। এই দিন কলকাতার মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যরা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়েন এবং বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। দুই পক্ষ যখন মুখোমুখি হল তখন হিন্দু-মুসলমানে ভাগাভাগি হয়ে গেল কলকাতা। সেদিন প্রশাসন কার্যত ছুটিতে ছিল বা ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলত কলকাতায় শুরু হল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, চিল-শকুনের মহোৎসব। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ছয় দিনব্যাপী এই নির্মম হিংসায় মারা গিয়েছিলেন কয়েক হাজার বাঙালি। স্টেটম্যানের সম্পাদক এই ঘটনার উপর বিবৃতি দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের ঘটনা যেকোনও যুদ্ধের বিভীষিকাকে লজ্জিত করবে। এই বিভীষিকাময় আবহেই আবির্ভাব হয় এই কাহিনির মূল চরিত্র, গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠার।

আরও পড়ুন- উন্নত চিনের মুখোশের আড়ালে ক্রীতদাস প্রথা? কতটা নির্মমতার শিকার সেদেশের কর্মীরা

বউবাজারের মঙ্গলা লেনের বাসিন্দা ছিলেন গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পারিবারিক সূত্রে তাঁরা পাঁঠার মাংসের ব্যবসা করতেন। গোপাল চন্দ্রের বাবা অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই পাঁঠার দোকান চালু করেন। বংশানুক্রমিক ভাবে তাঁরা পাঠার ব্যবসা করতেন বলে গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন গোপাল পাঁঠা নামে। এই কলকাতা হিংসা যখন চরমে তখন নিজের বাহিনী নিয়ে আসরে নামেন গোপাল পাঁঠা। শোনা যায়, গোপাল মুখোপাধ্যায় ‘ভারতীয় জাতীয় বাহিনী’ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘ওয়ান টু টেন’ নীতি গ্রহণ করার জন্য। অর্থাৎ আমাদের একজনকে মারলে তোমরা ওদের দশজনকে মারো। এবার এই ‘আমাদের’ এবং ‘ওদের’ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে সর্বত্র। একদলের মত, সেদিন নিজের হিন্দুদের বাঁচাতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেন গোপাল পাঁঠা এবং তাঁর বাহিনী। কিন্তু ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক সূত্রে মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হত তাঁকে। তাঁদের সঙ্গে খুব সুসম্পর্কই ছিল গোপাল পাঁঠার। সেদিন তিনি অবশ্যই হাতিয়ার তুলেছিলেন কিন্তু সেটি হামলাবাজদের বিরুদ্ধে। অনেকে মনে করেন, যেহেতু মুসলিম লীগ এই হিংসা শুরু করেছিল তাই হামলাকারীদের অধিকাংশই মুসলিম ছিলেন। এর সঙ্গেই জুড়ে গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে একজন মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবেও তুলে ধরতে চায় কিছু বিশেষ রাজনৈতিক দল।

কিন্তু এর শুরু কীভাবে হয়েছিল? নিজের এক সাক্ষাৎকারে গোপাল পাঁঠা নিজেই জানিয়েছিলেন সে কথা। তিনি বলেন,

“সেই সময় বাইরে দাঙ্গা চলছিল, আমি বাড়িতে ছিলাম না। ফিরে আসার সময় দেখি আমার বাড়ির দরজার বাইরে শুকনো কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দরজা বন্ধ, ভেতরে রয়েছে মেয়ে-বউরা। আমার হাতে একটা সোর্ড ছিল। আমার বাড়িতে যে লুটেরাগুলো আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছিল তাদের মধ্যে একজনকে আমি দিলাম এক কোপ। সে তো সেখানেই মারা গেল এবং যারা ছিল তারা পালিয়ে গেল।”

এই ঘটনাটি ঘটে ১৬ অগাস্ট। গোপাল মুখোপাধ্যায় আরও বলেন,

“আগে থাকতে কিছু হাতবোমা মজুত রাখা ছিল। আমার কাছে দুটো আমেরিকান ৪৫ পিস্তল ছিল। ফুল লোডেড। চাইলে চালাতে পারতাম কিন্তু চালাইনি। মানুষের প্রাণ নেওয়া খুব সহজ, কিন্তু বাঁচানো খুব মুশকিল। কিন্তু এত বড় দাঙ্গা হবে ভাবা যায়নি। ১৬ তারিখে পাড়ার কিছু মুসলমান পরিবারকে থানায় পৌঁছে দিয়ে আসা হয়। এক মুসলমান জাদুকর বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় হিন্দু যুবকরা। কিন্তু ওই দিনই সন্ধ্যের পর থেকে বীভৎস দাঙ্গার খবর আসে। জানা যায়, স্থানীয় ফিয়ার্স লেনে, সাগর দত্ত লেনে প্রচুর মানুষ মারা পড়েছে। হিন্দুরাই বেশিরভাগ মারা গিয়েছিল। তবে যে মুসলমান নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য এই দাঙ্গা লাগালেন, তাদের কিছু যায় আসলো না। নেতাদের কারণে অনেক নির্দোষ গরিব মুসলমান মারা যায়, কারণ তারাই পেটের টানে রাস্তায় বেরিয়েছিল।”

সেই দিনের ঘটনার প্রকাশিত নানা বিবরণী থেকে জানা যায়, ১৮ অগাস্ট সকাল থেকে গাড়ি চেপে একের পর এক মুসলিম পট্টিতে ঢোকে গোপাল মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর বাহিনী। মুসলিম পট্টিগুলোয় নাকি ডেরা ছিল এই হিংসায় জড়িতদের। সেখানে গিয়ে চলে নির্মম হত্যা। গোপাল মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে আরও বহু মানুষও। তথ্য বলছে, কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টির অনেক কর্মকর্তাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। ভবানীপুর গুরুদ্বারার শিখেরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন দক্ষিণ কলকাতায়। শোনা যায়, রাতারাতি কামারশালায় তরোয়াল, বর্শা, কাটারি ইত্যাদি তৈরি হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শোনা যায়, দেশপ্রিয় পার্ক এবং রাসবিহারী এলাকায় রাস্তার ধারে একটাও রেলিং অবশিষ্ট ছিল না, চলে গিয়েছিল কামারশালে। মোটকথা, উচ্চপদস্থ, ক্ষমতালোলুপ নেতাদের কারণে মারা গিয়েছিল মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি। সরকারি হিসেবে ১৬-২০ অগাস্টের হিংসায় মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার হলেও বাস্তবে তা কুড়ি হাজারের বেশি।

আরও পড়ুন- ডাক্তার হয়ে হাজার হাজার ফুট থেকে লাফ! ভারতের প্রথম মহিলা প্যারাট্রুপার আজও আড়ালেই

শোনা যায়, কলকাতার ভয়াবহতা দেখে গোপাল মুখোপাধ্যায় ও তাঁর বাহিনীকে অস্ত্রসমর্পণ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন গান্ধীজি। বিধানচন্দ্র রায় এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের ঘনিষ্ঠ গোপাল মুখোপাধ্যায় অবশ্য সেই আবেদন রাখেননি। এবার প্রশ্ন ওঠে, এই হিংসায় তাঁর ভূমিকা ঠিক কী ছিল? ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে, গোপাল মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর দলের লোকেরা ছিলেন ‘রাস্তার গুন্ডা’। তাঁদের মতে, যে নরসংহার হয়েছিল তার জন্য অনেকাংশে দায়ী গোপাল মুখোপাধ্যায়ই। আবার আরেক দলের মতে, যাঁরা গোপালকে রাস্তার গুন্ডা বলছেন, তাঁরা এই কথা বলার জন্য বেঁচে আছেন গোপালের কারণেই।

ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,

“গোপাল কখনই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, শুধু আত্মরক্ষার্থে হিন্দু যুবকদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি উভয় সম্প্রদায়ের গৃহহীন ও বিধবাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তাঁদের খুন বা ধর্মান্তরিত হওয়া থেকেও রক্ষা করেছিলেন।”

১৯৪৬-এর ওই সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং গোপাল মুখোপাধ্যায়ের প্রতিরোধের পর তাঁদের নায়কোচিত সম্মান দেওয়া হয় কলকাতায়। এরপরে অবশ্য সারা জীবনে কোনদিনও অস্ত্র হাতে তোলেননি তিনি। সারা জীবন মানুষের সাহায্যার্থেই কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিধানচন্দ্র রায়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কংগ্রেস করেন কিনা। গোপাল সাফ জানিয়ে দেন, তিনি কোনও দলের নন, সাধারণ মানুষ হিসেবে যেমন থাকা যায় তিনি সেভাবেই থাকার চেষ্টা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ সিরিজের গল্প ‘আদিম রিপু’-তে বাঁটুল সর্দার নামক একটি চরিত্রের উল্লেখ রয়েছে। অনেকের মতে, এই চরিত্রটি বাস্তবের গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় বা গোপাল পাঁঠার আলোকেই নির্মিত।

 

তথ্যসূত্র

১। https://indiarag.in/history-of-gopal-mukherjee/

২। https://sritiochetona.org/

More Articles