জাহাজ-খালাসি থেকে সাংবাদিক! গৌরকিশোর ঘোষের বিয়েতে অতিথিদের টিকিট কাটতে হয়েছিল

মেরুদণ্ড সোজা রেখে, অদক্ষ, স্বৈরাচারী শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদের ভাষাকে সকলের কাছে তুলে ধরেছেন গৌরকিশোর ঘোষ।

'l Believe In Love, For Love And Only Love Make A Man Human'- সারা জীবন যিনি এই আদর্শে বিশ্বাস রেখেছেন, তিনি গৌরকিশোর ঘোষ। যাঁর নামটাই একটাই মাইলস্টোন, একটা ব্র্যান্ড। মুখে চুরুট, হাফ পাঞ্জাবি বা ফতুয়া, সেই সঙ্গে ভারী চশমার ফ্রেমের আড়ালে চকচকে দৃষ্টি আর মুখের কোণে স্মিত হাসি, সাদামাটা আভরণে মোড়া গৌরকিশোর।

অধুনা বাংলাদেশের যশোহরে জন্ম গৌরকিশোরের। ম্যাট্রিক পাশ করেন নবদ্বীপের স্কুল থেকে। ইন্টারমিডিয়েটের পরে প্রথাগত শিক্ষার দিকে আর এগোননি তিনি। ১৯৫৩ সালে সাংবাদিকতাকেই স্থায়ী পেশা হিসেবে বেছে নেন, তবে এই পেশাতে আসার আগে অন্তত বারো বছর জীবনের নানা পর্যায়ে। নানারকম পেশার সঙ্গে জড়িয়েছেন গৌরকিশোর। এমনকী, একসময় জাহাজে খালাসির কাজ করেছেন তিনি। তাছাড়া কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনও হোটেলের বেয়ারা, কখনও নাচের দলের ম্যানেজার, কখনও বা ছাত্র পড়ানো- কত কী! শেষ পর্যন্ত সীমান্তে শুল্ক আদায় অফিসে কেরানির চাকরি থেকে সাংবাদিকতায়। শুরু ‘সত্যযুগ’ কাগজ থেকে। তারপর আসেন আনন্দবাজারে। কিন্তু কোনওদিনই সাংবাদিকতা তাঁর শুধু পেশা হয়ে থেকে যায়নি। কলমই হয়ে উঠে ছিল তাঁর প্রতিবাদের আঙ্গিক। সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকার সাপ্তাহিক কলামে 'গৌড়ানন্দ কবি ভনে' শিরোনামে লিখতেন তিনি।

গৌরকিশোর ঘোষের জীবনকে দেখার দৃষ্টিকোণ ছিল একেবারে ভিন্ন। রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি ছিলেন‌ ‌র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট। মানবতার ধর্মে দীক্ষিত এই মানুষটি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, উদারপন্থী। ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার, নিয়ম- কোনওকিছু নিয়ে তাঁর কোনওরকম গোঁড়ামি ছিল না। প্রচলিত রীতি-নিয়মকে কিছুটা অবজ্ঞা করে এসেছেন নিজের জীবনেও। যেমন, তাঁর বিয়ে। বাড়ির অমতেই বিয়ে করেন। কলেজ স্ট্রিটে রেজিস্ট্রি সেরে বন্ধু অরুণ সরকারের বাড়িতে ফুলশয্যা হয়। পরে একদিন আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে অনুষ্ঠান। তাতে প্রবেশ মূল্য পাঁচ টাকা! টিকিট না কেটে ঢোকা যাবে না। তাঁর বাবাকেও টিকিট কাটতে হয়েছিল। আমন্ত্রিত রাজশেখর বসু গৌরকিশোর ঘোষকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, "তোমার বিয়ে নিয়ে আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ সেই মেয়েটিকে নিয়ে, যে তোমাকে পছন্দ করল।"

আরও পড়ুন: শিশুদের কাছে বিজ্ঞানকে সহজ করে তুলেছিলেন, বাঙালি মনে রাখেনি গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে

সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ সাহিত্যজগতেও নিজের সিগনেচার স্টাইলকে বজায় রেখেছিলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের স্বীকৃতিতে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৮১-তে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়ার বহু আগে ১৯৭০ সালে সাহিত্যক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হন গৌরকিশোর। ঠিক তার আগের বছর, ১৯৬৯ সালে, প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘সাগিনা মাহাতো’। চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। তাঁদের নেতা সাগিনা। যা পরে তপন সিংহর হাত ধরে সেলুলয়েড এসে আরও পরিচিতি পায়। যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন দিলীপকুমার।

সাংবাদিক, লেখক গৌরকিশোরের জন্মশতবর্ষে আরও একবার ফিরে যাওয়া যাক সেই ইতিহাসের কাছে। তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইতিমধ্যেই আয়োজিত হয়েছে। তবে তাঁকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের কথা ব্যক্তিগতভাবে উল্লেখ করতে চাই। গৌরকিশোর ঘোষ জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির উদ্যোগে ২০ জুন সন্ধ্যায় উদযাপিত হয়েছিল তাঁর জন্মোৎসব। গানের প্রতি তাঁর ছিল অদম্য ভালবাসা, তাই অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রিয়াঙ্গী লাহিড়ীর গান 'আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে' দিয়ে। তার সহজ যাপন আকৃষ্ট করত সকলকে। নির্ভীক গৌরকিশোর ছিলেন দলাদলির রাজনীতির ঊর্ধ্বে। অনুষ্ঠানের শুরুতে সেই কথায় রোমন্থন করেন শিক্ষামন্ত্রী, নাট্যকার ব্রাত্য বসু। তিনি বলেন, গৌরকিশোর ঘোষ হলেন একজন আশ্চর্য রঙিন মানুষ। ছয় ও সাতের দশকের বাংলা ও বাঙালির জীবন ছিল তাঁর সৃষ্টির মূল পটভূমি। রাজনীতি, সমাজ থেকে শুরু করে বাঙালির জীবনের নানা পরতের জীবন-সমীক্ষা তিনি করেছিলেন। পাশাপাশি ব্রাত্য আরও বলেছিলেন সেদিন, যে, গৌরকিশোর একই সঙ্গে নির্মাণ ও বিনির্মাণ দুই করেছেন। তাঁর লেখক সত্তা নিয়েও সেই দিন কথা বলেছিলেন ব্রাত্য বসু। 'পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী, হা হা’, ‘প্রেম নেই’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ প্রভৃতি লেখা স্মর্তব‍্য। এছাড়াও রয়েছে ‘ব্রজদার গুল্পসমগ্র’, যা রসিক গৌরকিশোরের এক অনবদ্য সৃষ্টি।

গৌরকিশোর ঘোষ শতবর্ষ স্মারক বক্তৃতা দিতে গিয়ে ইতিহাসবিদ সুগত বসুর কণ্ঠেও গৌরকিশোরকে নিয়ে একই সুর ধ্বনিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, জরুরি অবস্থাকালীন পরিস্থিতিতে লেখা সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোরের দু'টি লেখার কথা। যে লেখা, লেখকের প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দিদশাতেও পৌঁছেছিল বাইরে।

স্পষ্টবাদী,প্রতিবাদী, দৃঢ়চেতা মানুষটির অস্ত্র হয়ে ওঠে কলম। 'রূপদর্শী' ছদ্মনামেও তিনি লিখতেন। তাঁর কলমের দাপট রেয়াত করেনি ইন্দিরা গান্ধীকেও।ইন্দিরা নিজেকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার প্রবক্তা বলে তুলে ধরলেও গৌরকিশোর বোঝান, দলীয় নেতাই হলো আসলে দেশ। সুগতের কথায়, "নেতার মহিমার সর্বগ্রাসী রূপ আজকের ভারতে আরও বেশি প্রকট। অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে।" পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, "গৌরকিশোরের সময় আইনের নাম ছিল ‘মেনটেন্যান্স অব ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’। এখনকার আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ)-ও একইরকম অনৈতিক। গালভরা নামের আইনে আরও বড় অন্যায়ের লক্ষ্যে আজও সংসদে সংশোধনী আনা হচ্ছে। বিনা বিচারে যাকে খুশি বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা চলছে।" গৌরকিশোরের  'গান্ধী যাত্রা'-র কথা মানুষ বহুবার শুনেছে, গৌরকিশোর আটের দশকের শেষ দিকে ভাগলপুরের গণহত্যার সময়ে যে যাত্রা করেন, তাই ছিল 'গান্ধী যাত্রা'। সেকথা স্মরণ করে সুগত বসু বলেছিলেন, "বিপদের সময়ে সাহসিকতার মধ্যেই গৌরকিশোর মনুষ্যত্বের সন্ধান পেয়েছেন।"

মেরুদণ্ড সোজা রেখে, অদক্ষ, স্বৈরাচারী শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদের ভাষাকে সকলের কাছে তুলে ধরেছেন গৌরকিশোর ঘোষ। বর্তমান সময় তাঁকে যে আমাদের কী প্রয়োজন, তা বলাই বাহুল্য। বর্তমান হলুদ সাংবাদিকতা, স্তাবকতার যুগে (ব‍্যতিক্রম অবশ্যই আছে) তাঁর মতো নির্ভীক সাংবাদিকদের যে কতটা দরকার, তা বোঝানোর মতো উপযুক্ত শব্দ নেই আমার। তবুও এই আকালেও স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি তাঁর দেখানো পথে এখনও হাঁটবে সমাজ, সাংবাদিকতার যে রাস্তা তিনি দেখিয়েছেন, সেই পথে চলবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম।

তথ্য সূত্র:

'আনন্দবাজার পত্রিকা' ও গৌরকিশোর ঘোষ জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি

More Articles