মিলে গেল একশো বছর আগের ভবিষ‍্যৎবাণী! এই আবিষ্কারে খুলে যাচ্ছে পৃথিবীকে দেখার নতুন জানলা

অবশেষে ধরা দিল সেই অরূপরতন, যার ভবিষ্যৎবাণী আইনস্টাইন করেছিলেন একশো বছর আগে।

আপনার তত্ত্বটি কতটা সুন্দর কিংবা কতটা বুদ্ধিদীপ্তভাবে আপনি সেটিকে উপস্থাপন করছেন, তাতে কিছু আসে যায় না, যদি পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে তা না মেলে।

-রিচার্ড পি. ফেইনম্যান

ডাস্টার ঝাড়ার জন্য হাত ঝাঁকালে নাকি ঢেউ ওঠে চারদিকে- কই দেখতে পাই না তো! কেন জলে ঢিল ফেললে ঢেউ ওঠে না, যাকে আমরা জলতরঙ্গ বলি? কোনওকিছুর কমা-বাড়া হলেই ঢেউ সৃষ্টি হবে, এটাই তো নিয়ম! তাহলে ডাস্টার ঝাঁকালে কী ধরনের ঢেউ তৈরি হয়? দেশ-কালের ঢেউ, মহাকর্ষের ঢেউ- কী সেটা!

তা বুঝতে গেলে আমাদের নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের শরণাপন্ন হতে হয়, যা বলে, এই মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুই পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং দেয় তার সাংখ্যমান। অদ্ভুত এই তত্ত্ব! একদিকে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি, অপরদিকে গাছ থেকে আম কেন পড়ল- সব কিছুর মুশকিল আসান এই সূত্র। আকাশ ও পৃথিবী যে একই নিয়মে বাঁধা, কেউ বলেনি এর আগে।

আরও পড়ুন: সূর্যের গায়ে পৃথিবীর সমান বড় দাগ! ধ্বংস হতে পারে পৃথিবী?

কিন্তু একটা খুঁতখুঁত থেকেই গেল। ধরুন, আজ হঠাৎ পৃথিবী হাওয়া হয়ে গেল, চাঁদ কি সঙ্গে সঙ্গে সেই বিপর্যয় টের পাবে? না কি আর একটু অপেক্ষা করতে হবে? নিউটনের মতে তৎক্ষণাৎ টের পাবে। ইংরেজিতে যাকে বলে 'action at a distance'‌. কিন্তু পৃথিবী বিলোপের খবরটা কে বয়ে নিয়ে যাবে? আলোর চেয়ে বেশি বেগে কেউ তো যেতে পারে না। কিন্তু সেজন্যও তো অবকাশ চাই কিছুটা। এদিকে নিউটনের তত্ত্বে বাহকের জায়গা খালি, যা হবে সবই তৎক্ষণাৎ!

ঊনবিংশ শতাব্দীতে আইনস্টাইন মহাকর্ষের ধারণাই বদলে দিলেন এবং দেখালেন স্থান ও কাল বিচ্ছিন্ন নয়। তারা মিলেমিশে এক চারমাত্রিক জগৎ তৈরি করে, যেখানে আমাদের বসবাস। তিনি বলেন দেশ-কালের জ্যামিতি বেঁকে যাওয়ার নামই মহাকর্ষ। যেমন, আপনার সামনে একটি কাগজে কিছু মিষ্টি রাখা আছে, একদল পিঁপড়ে সারি বেঁধে চলছিল মিষ্টির টানে। আপনি রেগে গিয়ে দুমড়ে দিলেন কাগজটাকে। ব্যাটা পিঁপড়েগুলো নাছোড়বানদা, কিন্তু বাঁকা পথে পথে অর্থাৎ, বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে পথটাকে বাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপনি তো পিঁপড়ের ওপর কোনও বলপ্রোয়োগ করেননি শুধু কাগজের জ্যামিতিটা পাল্টে দিয়েছেন মাত্র। আইনস্টাইন বললেন, যে কোনও জায়গায় ভর থাকলে সেখানকার দেশ-কালের জ্যামিতি বেঁকে যায়, যার ফলে সোজা রাস্তা ও বাঁকা দেখায়, আর সেটাকে আমরা মহাকর্ষ বলে মনে করি।

মহাকর্ষ মানে তাহলে দেশ-কালের বক্রতা। কোথাও একটা ভর রাখলে তার প্রভাবে আশপাশের জ্যামিতি কীভাবে বদলায়, তার একটা হিসেব। কিন্তু যেখানে ভর নেই, সেখানেও তো পর্যায়ক্রমে দেশ-কাল এই যে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে- এই দোমড়ানো-মোচড়ানোটাই যে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, যা মহাকর্ষের ঢেউ।

সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু তার যে দেখা মেলা ভার, কারণ সে যে ভারি ক্ষীণ। তোড়জোড় শুরু হলো এই ঢেউয়ের সম্মুখ সাক্ষাৎকারের জন্য। আলোক তরঙ্গ দেখার অনেক উপায় আছে, কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেখার একমাত্র উপায় হলো, তার ধাক্কায় কোনও বস্তুর আকারের সামান্য বিকৃতির পরিমাপ (১-এর পিঠে ২১টা শুন্যের একভাগ)। অনেকদিনের এই চেষ্টার ফলই LIGO (Laser Interferometer Gravitational Observatory)। কেমন দেখতে এই যন্ত্র? কীভাবে ধরা পড়ল সে?

পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে মাইকেলসন ইনটারফেরোমিটার নামে এক যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। LIGO তারই এক উন্নত সংস্করণ। ইংরেজি L অক্ষরের মতো, যার দুই বাহু ৪ কিমি লম্বা। আমেরিকার দুই প্রান্তে হ্যালফোড আর লিভিংস্টোনে এই দু'টি এরকম L বসানো আছে। দুই বাহু বরাবর লেজার রশ্মি পাঠিয়ে তাদের মিলিয়ে দিলে দেখা যায় বাহুদু'টির দৈর্ঘ্য সমান ছিল। বাহুদু'টি সমকোণে থাকার ফলে এদের ওপর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এসে পড়লে তাদের দৈর্ঘ্য কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হবে, যা এই যন্ত্রের নজর এড়াবে না। এই যন্ত্র এত সংবেদনশীল যে, কয়েক হাজার আলোকবর্ষের মধ্যে দেশ-কালের জ্যামিতিতে কোনও ঢেউ উঠলেও তা তৎক্ষণাৎ ধরা পড়বে।

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সালে এক অদ্ভুত সংকেত পাওয়া গেল। প্রথমে হ্যানফোডে, পরক্ষণেই (১ সেকেন্ডের হাজার ভাগের ছয় ভাগ) লিভিংস্টোনে। সেই কম্পাঙ্কের তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতার হিসেব কষে বিজ্ঞানীরা বলেন, কৃষ্ণগহ্বরদু'টির ভর যথাক্রমে সূর্যের ভরের ৩৬ গুণ ও ২৭ গুণ মিলে নতুন কৃষ্ণগহবরের ভর সূর্যের ৬২ গুণ।বাকি ৩ গুণ গেল কোথায়? কেন তা বেরিয়েছে মহাকর্ষীয় ঢেউয়ের আকারে?

অবশেষে ধরা দিল সেই অরূপরতন, যার ভবিষ্যৎবাণী আইনস্টাইন করেছিলেন একশো বছর আগে। শেষে একটা প্রশ্ন করাই যেতে পারে, এই ভুল ধরার এত প্রচেষ্টা কেন? শুধুই কি আইনস্টাইনের মানসকন্যা? আসল কথা হলো, আলোকতরঙ্গ ছাড়া মহাবিশ্বকে দেখার আর কোনও জানলা এর আগে ছিল না, এই নতুন জানলা দিয়ে বোধহয় আমরা বিশ্বকে দেখতে পাব আরও নতুন নতুন রূপে। কারণ, এই ঢেউ দুর্বল আর দুর্বলতাই তার শক্তি। এই ঢেউ সহজেই ঢুকে পড়ে পদার্থের অন্দরমহলে, তাই আমরা আশা করে আছি যে, মহাকর্ষীয় ঢেউয়ের কাছ থেকে আমরা জানব নিউট্রন তারার হাঁড়ির খবর, কৃষ্ণবিবর সৃষ্টির রহস্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস, আরও কত কী!

More Articles