"মাঝেমাঝে আইন তুলতে হয় নিজের হাতেই," দেশকে যেভাবে 'সবক' শেখায় সম্পত দেবীর গুলাবি গ্যাং
Gulabi Gang: হাতেগোনা কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে এই সংগঠন ২০০৫ সালে তৈরি হয়েছিল। মাত্র এক বছরের মধ্যেই, ২০০৬ সালে এই সংগঠনের সদস্যা সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজারের উপর।
“শুধু ভাবতাম, এই অত্যাচারের কি শেষ নেই? আর কতদিন এইভাবে ভয়ে ভয়ে বাঁচব! কোনও কারণ ছাড়াই যখন তখন পেটানো হচ্ছে মেয়েদের। কোনও নিরাপত্তা নেই। না ঘরে, না বাইরে। ঘরে মেয়েদের কারণ ছাড়াই পেটানো হচ্ছে, বাইরে পশুর দল সুযোগ পেলেই বলাৎকার করছে। এর কি কোনও প্রতিকার নেই?”
আক্ষেপ, ক্ষোভ, হতাশায় কথাগুলি বলেছিলেন সম্পত পাল দেবী। ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম বুন্দেলখণ্ডের বান্দা জেলার বাদাউসা। নারীর মর্যাদা এখানে অলীক, স্বামী এবং স্বজনদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার, মার নিত্যদিনের ঘটনা। ‘পশুর চেয়েও অধম’ এই ধারণা থেকেই সম্ভবত ঘরে বাইরে নিত্যদিন অপমানিত এবং নির্যাতিত হতে হয়েছে মহিলাদের, হতে হচ্ছেও। সম্পত পাল দেবীও ওই নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে সম্পত দেবীকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে স্থানীয় রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল জোর করে। কিন্তু পড়াশোনা শেখার স্পৃহা সম্পত দেবীর চিরকেলে। গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে তিনি পড়াশোনা কিছুটা শিখেছিলেন, তবে লুকিয়ে। তারপর ষোলো বছর বয়সে প্রথম অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ভেতরে ন্যায় অন্যায় বোধ ছিল চরম। তবে একদম ছোট বয়সে অন্যায় দেখলেও ভেতরে ভেতরে গুমরে থাকা ছাড়া কোনও পথ ছিল না। অন্যায় দেখলে দৌড়ে যেতেন কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস হতো না। চোখের সামনে সম্পত প্রতিনিয়তই দেখতেন একজন পুরুষ অকারণে নিজের স্ত্রীকে প্রতিদিন মারধর করে। একদিন আর থাকতে না পেরে সেই পরিবারে গিয়ে হাত জোড় করে অনেক অনুরোধ করলেন সম্পত। আগ্রাসী পুরুষটিকে অনুরোধ করলেন যাতে তিনি এই কাজ থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু কোনও ফল হল না, উলটে সেই পুরুষ রেগে গিয়ে সম্পতকে গালমন্দ করতে লাগলেন। এখানেই বাঁধ ভাঙে। গ্রামের অন্য কয়েকজন মহিলার সাহায্যে মাঠের মধ্যে লোকটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করলেন। শুরু হল সম্পত দেবীর লড়াই।
এরপরই সম্পত দেবী নির্যাতিত নারীদের নিয়ে একটি দল গঠন করলেন এবং যারা ঘরের মেয়েদের মারধর করে তাদের উপর নজরদারি শুরু করলেন। সব সময় দলের মহিলাদের হাতে থাকত বাঁশের লাঠি। একটা কথা সম্পত ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। জোটবদ্ধ না হলে কিছুই করা যাবে না। কথায় আছে, “দশের লাঠি, একের বোঝা”। তিনি মেয়েদের সংগঠিত করলেন, তাঁদের লাঠি চালনায় দক্ষ করে গড়ে তুললেন, শরীর চর্চা এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজেই গান বেঁধে সেই গান সবাইকে শেখাতে লাগলেন। তাঁদের গানের কথা ছিল খানিকটা এইরকম- “অনেকদিন হয়ে গেছে ভারতের নারীরা, তোমরা এখন জাগো, উঠে দাঁড়াও। আমরা ঘরে কখনই শান্তিতে থাকতে পারিনি। সুতরাং একজোট হও। গর্জে ওঠো রুখে দাঁড়াও।”
আরও পড়ুন-‘সংখ্যালঘুরা আজও শাসকের কাছে শুধুই ভোটব্যাঙ্ক’: নৌশাদ সিদ্দিকি
নিজে গৃহবধূ হয়েও নারীর অধিকার রক্ষার জন্য এত বড় একটি সংগঠন সম্পত তৈরি করতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র মনের জোর এবং সাহসের বলে। ২০০৫-০৬ সালে এই ‘গুলাবি গ্যাং’ তৈরি হয়। শুধু যে ঘরের অত্যাচারী পুরুষদের বিরুদ্ধেই লড়েছে এই দল তা নয়, এই সংগঠনের সদস্যদের লড়াই ছিল দুর্নীতিবাজ পুলিশ এবং ধর্ষকদের বিরুদ্ধেও।
সম্পত দেবী চেয়েছিলেন তাঁর নারী সংগঠনের মানুষজনদের প্রত্যেকে যেন আলাদাভাবে চিনতে পারে। তাই তিনি মেয়েদের পোশাকের জন্য একটি রঙ বাছলেন। তাঁর কথা অনুযায়ী, “মেয়েদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে কানপুর থেকে শাড়ি অর্ডার করলাম। সবাইকে বললাম, “চলো সবাই একরকম শাড়ি পরি। যাতে মনে হয় আমরা ইউনিফর্ম পরেছি।” দেখলাম একমাত্র গোলাপি রংটিই কোনও রাজনৈতিক দলের রং নয়। সেই কারণে আমি ৫০০ টা গোলাপি শাড়ির অর্ডার করলাম।” হাতেগোনা কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে এই সংগঠন ২০০৫ সালে তৈরি হয়েছিল। মাত্র এক বছরের মধ্যেই, ২০০৬ সালে এই সংগঠনের সদস্যা সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজারের উপর।
২০০৬ সালে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে একজন নিরপরাধ মানুষকে ১৯ দিন ধরে আটকে রেখে পুলিশ চরম অত্যাচার চালাচ্ছিল। কারণ তাঁর স্ত্রী ছিলেন ‘গুলাবি গ্যাং’-এর সদস্যা। মোষ চুরির মিথ্যা অভিযোগে ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। সম্পত দেবী গুলাবি গ্যাংয়ের কিছু সদস্যাকে নিয়ে থানায় গিয়ে ওই ব্যক্তিকে আটক করার কারণ জানতে চাইলে থানার ইনচার্জ সম্পত দেবীর সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেন এবং তাঁকে থানা থেকে বের করে দেন। সম্পত দেবী ফিরে গিয়ে গুলাবি গ্যাংয়ের ৩০০ সদস্যাকে নিয়ে এবং রাস্তার বেশ কিছু কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে থানায় উপস্থিত হন। কুকুর দেখে থানার ইনচার্জ জিজ্ঞেস করেন, তিনি কুকুর সঙ্গে এনেছেন কেন? উত্তরে সম্পত দেবী জানান, পুলিশ যখন কোনও তদন্ত করতে যায় সঙ্গে করে কুকুর নিয়ে যায় তাহলে তাঁরাই বা কেন আনতে পারবেন না! পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতির পর পুলিশ সম্পত দেবীকে ধরবার চেষ্টা করলে থানার পুলিশ ইনচার্জকে গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যরা একটি দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে।
এই ঘটনা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ নিরপরাধ মানুষটিকে ছেড়ে দেয় এবং ভুল স্বীকার করে নেয়। ধীরে ধীরে গুলাবি গ্যাং বড় হয়। ২০১০ সালে স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা অল্প বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষিতার বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির অভিযোগ আনে যাতে সে মুখ না খুলতে পারে। এর প্রতিবাদে গুলাবি গ্যাং ১১ দিন টানা অবস্থান করে জেলের বাইরে এবং ওই ক’দিন প্রায় দশ হাজার মানুষ গুলাবি গ্যাংয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পালা করে সকলে জেলের সামনে দিনরাত অবস্থান করেন। ট্রেনে চড়ে, বাসে চেপে বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে মেয়েরা এসে উপস্থিত হয়েছিলেন জেলেন বাইরে। শেষে ওই রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিচার হয় এবং ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তাকে।
আরও পড়ুন- হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
সম্পত দেবীকে অনেকবারই হত্যা করার চেষ্টা হয়। অনেক মিথ্যা অপরাধের সঙ্গেও নাম জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে তাঁর। কিন্তু সম্পতের বক্তব্য, “একদিন তো মরতেই হবে। সেই মৃত্যুটা যেন অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করেই হয়।” এখন গুলাবি অনেক বড় আকার ধারণ করেছে, সদস্যা সংখ্যা বেড়েছে, অনেক শিক্ষিত এবং ধনী পরিবারের মেয়েরাও সম্পত দেবীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ২০১২ সালের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে মানিকপুর আসন থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন সম্পত। জনপ্রিয় টিভি-শো বিগ বসেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। গুলাবি গ্যাংকে নিয়ে তথ্যচিত্র, সিনেমা তৈরি হয়েছে। অনেক পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে গুলাবি গ্যাং। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘গডফ্রে ফিলিপস ব্রেভারি আ্যওয়ার্ড’ এবং ‘দ্য কেলভিনেটর ইলেভেন্থ জিভার ৮ (উইমেন্স আ্যওয়ার্ড)’। সম্পত দেবীর বিরুদ্ধে অনেকের অনেক অভিযোগ থাকলেও এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে আধুনিক ভারতের মেয়েদের জন্য তিনি অনুপ্রেরণা। মহিলাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক মূর্তিমান প্রতিবাদ সম্পত। অসংখ্য অত্যাচারিতাকে পথ দেখিয়েছেন, নিজের শক্তিতে জ্বলে উঠতে সাহায্য করেছেন সম্পত।
এক সাক্ষাৎকারে সম্পত দেবী বলেন, “এসব এলাকায় কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে না। সরকারি কর্মকর্তা আর পুলিশ দুর্নীতিবাজ এবং দরিদ্র বিরোধী। তারা শুধু ধনীদেরই পোষণ করে। তাই মাঝে মাঝে আইন আমাদের নিজেদের হাতেই তুলে নিতে হয়। এছাড়া অন্যান্য সময় অপরাধীকে আমরা লজ্জা দিতেই বেশি পছন্দ করি।” ১৯৬০ সালে সম্পত দেবীর জন্ম। বর্তমানে তাঁর বয়স ৬২। গুলাবি গ্যাংয়ের প্রধান পদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এখন। কিন্তু সময়ে অসময়ে গোলাপি আলোর পাশেই উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন সম্পত।