বিশ্বকাপ নয়, গলি ক্রিকেটেই লুকিয়ে দেশের প্রাণভোমরা
Gully Cricket : রাহুল দ্রাবিড় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উইকেট কিপিং করতে গিয়ে তাঁর ব্যাটিংয়ে সুবিধে হয়েছে
এমন একজন জম্পেশ উইকেটরক্ষকের নাম বলুন, যে একই ম্যাচে দু’দলের হয়ে কিপিং করেছে?
বিশ্বকাপের বাজারে, এর উত্তর তাঁরাই এক ঝটকায় দিতে পারবেন, যাঁরা ক্রিকেট খেলেছেন অলি-গলিতে। উত্তর: পাঁচিল। এই গলি-লেখা তাঁদের জন্য, যাঁরা উত্তরটা মনে মনে দিয়ে ফেলেছেন। আর তাঁদের জন্যও, যাঁরা উত্তরটা দিতে পারেননি বলে, সারাজীবনে গলিতে অন্তত আরেকবার ক্রিকেট খেলতে নামবেন!
পাঁচিলে ফুটো থাকলে তা আসলে দূরবিন। কে যে বলেছিল কথাটা, আজ আর মাথায় নেই। কিন্তু এমন গলি-দর্শন আমি বিশেষ শুনিনি। গলির হাজার উড়ো কথার মধ্যে, চলকে পড়া জীবন সংকেতের মধ্যে কিছু কথা মাথার মধ্যে অনন্তকাল ঘাই মারতে থাকে। আমার কাছে এ-ও তেমনই একটা কথা। বল যদি অতিরিক্ত ড্রপ খেয়ে, কিংবা উটকো পাথরের শয়তানিতে, এ ঠিকানা-সে ঠিকানা ছুঁয়ে লাফ মেরে বেরিয়ে পড়ে গলি থেকে, পাঁচিলের গা বেয়ে শামুকের শ্লথগতি ভেঙে উঠে পড়ার আগে, সবার প্রথমে চোখ রাখতে হবে ওই ফুটোয়। কারণ সেই বেয়াড়া বলের গতিপথ মেপে নিতে হবে। পাঁচিলের এপারে বলের অজস্র দাগ এবং ওপারে ‘ব্রিগেড চলো’। যে এই পাঁচিলে উঠে দাঁড়াবে, সে হয়ে উঠবে খেলাবন্ধের বিজ্ঞাপন বিরতির রাজনৈতিক মডেল, ‘ব্রিগেড চলো’র মাথায় দণ্ডায়মান।
রাহুল দ্রাবিড় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উইকেট কিপিং করতে গিয়ে তাঁর ব্যাটিংয়ে সুবিধে হয়েছে, কারণ বল শেষ পর্যন্ত কতদূর কী কাণ্ডকারখানা করে, তা দেখতে পেতেন তিনি একমাত্র এই ভূমিকায়। আমরা, যারা কাকের অ্যালার্মে ভাঙা দুপুর মুছতে মুছতে এসে পড়তাম গলিতে, হাতে উইলো গাছের পরজন্ম– একটি ব্যাট, আর গলির উপগ্রহ: কালো রবারের বল-সহ, তারা ওই উইকেট কিপারের চোখ দিয়ে দেখতাম, বল কতদূর গড়াল। তাতে অবশ্য আমাদের বিশেষ সুবিধে হয়নি। শুধু পাড়ার কয়েকটা অকিঞ্চিৎকর ‘খবর’ মাঝে মাঝে চোখে পড়ে গিয়েছে। যেমন, ৩টে ৫০-এ এগারো ক্লাসের রিয়া যার জন্য দাঁড়াত, সে ৫০ ছুঁইছুঁই বাবলুদা। যেমন, শনিবার ৪টায় মিলি যায় ভূগোল ক্লাসে। যেমন, শনিবার ৬টায়, ওই ভূগোল কোচিং থেকে ফেরার পথে মিলির বাবাও থাকে তার সঙ্গে। সোম-শুক্র সাড়ে ৪টেয় যায় এক মূক আইসক্রিমওয়ালা, ঘণ্টি মৃদু বাজিয়ে। এইরকমই হরেক সব তথ্য-পরিসংখ্যান। গলির তো কোনও রেকর্ড বুক নেই। ফলে ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েও আর লাভ নেই কোনও।
আরও পড়ুন- ক্রিকেটার কবিগুরু! যে রবীন্দ্রনাথকে আজও চেনেই না বাঙালি
আকস্মিক যতিচিহ্নময় এই গলি-ক্রিকেট। হাজার রকম দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন এসে পড়ে। তারাই ব্যাঘাত, আবার তারাই এই গলিগলতার ক্রিকেটের আশ্চর্য উপাদান। ক্রিকেটই আসলে পার্শ্বচরিত্র, মুখ্য ওই অমোঘ উপাদানগুলি যাতে সম্পর্কের বলছাপ লেগে রয়েছে। যতিচিহ্নের রূপ ধরে কখনও এসে পড়ে আদুরে কুকুরছানা, কখনও জাঁদরেল বাইককাকু, কখনও টিউশন স্যার, দু’রঙা চোখের বিড়াল, অতি শ্লথ অশীতিপর, দৃষ্টিহীন কোনও মানুষ, ডাকপিওন, হোম ডেলিভারি– আরও কত কী! গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়লে, লরি, স্কুলবাস, হাতরিকশা, অজস্র বাইক, সাইকেল, পথচারী। আবার কখনও বল ফেটে গেল, হারিয়ে গেল, দোকান খোলার জন্য অপেক্ষা, যে ব্যাটের মালিক তার হঠাৎ জ্বর– এরকম বিবিধ বিচিত্র ঘটনাও। এই যে হরেকরকম থামা, আচমকা বিশ্রাম– গলি ক্রিকেটের ম্যাজিক। তা বাদ দিলে, গলি ক্রিকেট নেহাতই শুধু ‘ক্রিকেট’ হয়ে থাকত। জীবনে জীবন এই ঘোরতরভাবে মিশে যেত না। আর কোনও উপায়ে যাওয়া যেত না অপরিচিত এক বাড়ির ছাদে, দেখা যেত না সেই ছাদ থেকে কীরকম লাগে আমাদের অল্প আলোর মফস্সল। নানা ছাদের ওই মিশ্রিত যোগফলেই তো এই গলিনির্মিত আকাশ। যে আকাশ কোনও দিন আমাদের বল স্পর্শ করে না। কিন্তু সে নিয়ে গলির কোনও দুঃখ নেই। সে দেওয়ালে দেওয়াল, কার্নিশে কার্নিশ, সামান্য ফুটপাথ বদল করেই বেজায় খুশি।
১৯৮১-’৮২ সালে সাংবাদিক শেল্ড ব্যারি ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে ভারত সফরে এসেছিলেন। সময়টা খেয়াল করবেন, তখনও কপিল দেবের হাতে বিশ্বকাপ ওঠেনি। সেসময় নানা শহরে ঘুরে ঘুরে শেল্ড ভারতের ক্রিকেটপ্রীতি দেখেছিলেন, লিখে রেখেছিলেন তা। শেল্ডের সঙ্গে ছিলেন দুরন্ত আলোকচিত্রী আদ্রিয়ান মুরেল। তাঁর লেখার সংকলনে গড়ে উঠেছিল যে বই, তার নাম ‘ক্রিকেট ওয়ালা’ (Cricket Wallah)। সেই ’৮১-’৮২ সালে, কীরকম ছিল রাস্তার ক্রিকেট, লিখছেন শেল্ড, তা আজকের গলি-রাস্তার ক্রিকেট থেকে সামান্যই বদলেছে বোধহয়। তাঁর লেখার এক টুকরো বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়–
‘প্রত্যেকের একইরকমের আগ্রহ– মধ্যদিনের কলকাতায় রিকশাওয়ালা (কলকাতাই একমাত্র শহর যেখানে এখনও হাতে-টানা রিকশা চলে) তার রিকশায় অর্ধেক নিদ্রাচ্ছন্ন ও বাকি অর্ধেক জেগে খেলা দেখছে, তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন দ্বিতীয় তলের ওই বৃদ্ধা মহিলা; অপেক্ষা করছেন কখন বল তাঁর বারান্দায় এসে পড়বে এবং তিনি তা বাজেয়াপ্ত করবেন। সুপুরি বিক্রেতা তাঁর ঝুড়িটি এ গলিরই এক দেওয়াল-খোপে গুঁজে দিলেন, এক ফেরিওয়ালা অন্যমনস্কভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তার খুঁটিতে কয়েকটা ঝুড়ি দোলনা, এক ভিখারি, কাঁধে বস্তা, রাস্তার আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছিল কিছু।’
এতসব ঘটনা ঘটছে, গলি ক্রিকেট চলতে চলতেই। সমান্তরালে। শেল্ড ব্যারি এখানে খেলার বর্ণনাই দেননি। দিয়েছেন আবহের। বাকি সব স্তব্ধ করে দিয়ে এ খেলা গড়ে ওঠেনি। বিপুল অর্থসমাগম, প্রচুর দর্শক, স্লোগান বা দেশের কোনও জার্সি পরে নয়। জাতীয় সংগীত গেয়ে নয়। এই গলিতে মানুষের আনন্দ-রাগ-বিরক্তি-শ্লেষ জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে টুকিটাকি কুজ্ঝটিকাও। ওই যে বয়স্ক টেঁটিয়া ভদ্রমহিলা, তিনিও বিরক্তি সত্ত্বেও হয়ে উঠছেন গলি ক্রিকেটের একজন। না, স্রেফ দর্শক নয়। কারণ গ্যালারি আসলে খেলারই অঙ্গ। গলিতে ওই দোতলার বারান্দায় বল উঠলে নিয়ম জারি হয়েছে ‘চান্স আউট’-এর। এই যে আশ্চর্য এক লব্জ– ‘চান্স আউট’, তা জন্ম দিয়েছে তো গলিই! কী প্রয়োজন ছিল এই নতুন নিয়মের? কারণ ওই বৃদ্ধা মহিলা, বল কেড়ে নেবেন। ফলে ক্রিকেটীয় নিয়ম তৈরির নেপথ্যে এসে পড়ল বৃদ্ধার উষ্মা। তাহলে কী করে তাঁকে স্রেফ দর্শকের আখ্যা দেব? মনে করুন, ওই রিকশাওয়ালাকে। যিনি আধোঘুমে, আধো জাগরণে খেলা দেখছেন। তিনি খেয়াল রাখছেন নিজের দিকেও বল উজিয়ে আসছে কিনা, দুমদাম লেগে যাবে না তো! তিনি ঘুমোচ্ছেন বোলারের হাত থেকে বল বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত। তারপর, অপেক্ষা করছেন ব্যাটার কোথায় মারছে। এইটুকু তাঁর জাগরণকাল। সুপুরি বিক্রেতা, সেও এখানে এসে খানিক থামল। হয়তো দেখল খেলা। জিরিয়ে নিল। আর ওই ফেরিওয়ালা এবং ভিখারি– হাওয়ার মতো বিদায় নিল দ্রুত। যারা খেলছে, তারাও কি দেখছে না এইসব? দেখছে তো। যে ব্যাট করছে, হয়তো সেই-ই দলের শেষ ব্যাটার, ২ ওভারে রান বাকি ১৭। এই ঘন ঘন আকস্মিক যতিচিহ্নর মাঝে, সে নিজের মনকে ফিরিয়ে আনছে। আবার তছনছ হচ্ছে মন, অন্য কোনও যতিতে।
আরও পড়ুন- টি-টোয়েন্টির রমরমায় ক্রিকেটাররা এখন কর্পোরেট চাকুরে?
শেল্ড ব্যারির আরেকটি চমৎকার অংশ, তা না বললে অপরাধবোধে ভুগব–
‘ভারত ব্যাপারগুলোকে গ্রহণ করেছে ও পাল্টে নিয়েছে নিজের মতো করে। ধরা যাক, বাস– এ তো ক্রিকেটের মতোই একখানা পশ্চিমি বস্তু, ইদানীং ভারতই তা তৈরি করছে, এবং এই বাসের যে আদব, সেটা আশ্চর্যভাবেই ভারতীয়। একইভাবে ক্রিকেট ব্যাপারটাকেও নিজের প্রয়োজনমতো এবং পরিস্থিতি বুঝে কলকাতার রাস্তা বদলে নিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিচ ক্রিকেটের মতোই এই তরুণেরা নিজেদের মতো করে খেলাটা বদলে নিয়েছে। অনেকটা মূল গাছ থেকে শাখা বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে, আবার নতুন একটা গাছ তৈরি হওয়ার মতো ব্যাপার। বিধিবৎ ক্রিকেট থেকে এদের বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে।’
সব কি আর বিধি মেনে হয়? তাহলে ‘কোনো যে মানে নেই সেটাই মানে’– কী করে লেখা হবে? তাহলে কী করে পেটার বিকসেল লিখবেন ‘টেবল ইজ টেবল’-এর মতো গল্প? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যদি তাগড়াই কোনও অভিধান হয়, গলি ক্রিকেট নেহাতই ছোটখাটো তরঙ্গময় ৬-৭ লাইনের কবিতা। ‘অভিধান’-এর সঙ্গে যোগ অর্থময়তার, অর্থব্যাপ্তির সঙ্গে তেমনভাবে নয়। গপ্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে, আমরা শব্দ দেখে যদি থমকাই, তাহলে অভিধান খুলে দেখে নিতে পারি। কারণ গপ্প-উপন্যাস আমাদের এই অভিধানগত অর্থকে বহন করে। কিন্তু কবিতা, তা অভিধানের অর্থকে স্বীকার করে না। নিজের মতো তৈরি করে নেয়। অর্থশৃঙ্খলাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। গলি ক্রিকেটও কবিতার মতো, এই নিজস্ব নিয়ম তৈরি করে ফেলেছে বহুকাল হল। তাকে এখন আর ‘বিধিবৎ’ করে তোলা যাবে না। সেখানে বিশ্ব, মহাবিশ্ব ঢুকে পড়বে অনায়াসেই– বিশ্বকাপের প্রতি তার মোহ নেই কোনও। সে তো পুরস্কারপ্রত্যাশী নয়। যদি কিছু নিয়ে তার অথৈ উচ্চাশা থাকে, তা ওই দূরবিন। অন্ধ গলির শেষে যৎসামান্য ফুটোওয়ালা পাঁচিল।