নকল বাসিন্দা সাজিয়ে সীমান্তে হত্যার মহড়া! যে ভাবে তিলে তিলে ইজরায়েলে হামলার ছক কষে হামাস
Israel-Palestine conflict: অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর রকেট দিয়ে হামলা চালানো হলে একসঙ্গে এতগুলো লক্ষ্যবস্তুকে আটকাতে পারবে না আয়রন ডোম। সে কারণেই আঁটঘাট বেঁধেই ৫ হাজার রকেট নিয়ে হামলা চালানো হয় আকাশপথে।
শুধুমাত্র প্রতিহিংসার লড়াইয়ে 'নেই' হয়ে গেল দু'টো দেশের হাজার হাজার মানুষ। হামলা-পাল্টা হামলা আর প্রতিহিংসার মুখে রাস্তা জুড়ে নামল লাশের ঢল। দু'দেশের যুদ্ধ মানেই আমরা জেনে এসেছি ভূখণ্ড দখলের লড়াই। এ লড়াইয়ের ইতিহাসেও ভুখণ্ডের যুদ্ধ আছে বটে। তবে শনিবার যে ভয়ঙ্কর হামলা ঘনিয়ে উঠল ইজরায়েল জুড়ে, তার সঙ্গে সরাসরি যোগ শুধুমাত্র প্রতিহিংসার। হঠাৎ করেই ওই দিন ইজরায়েলে মারণ-হামলা চালিয়ে বসল হামাস জঙ্গিগোষ্ঠীর গেরিলা বাহিনী। এলোপাথাড়ি গুলি করে মেরে ফেলা হল অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। কিন্তু সত্যিই কি এই হামলা এতটাই আকস্মিক, না এর নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও কৌশল?
শনিবার সকাল ছ'টা কি সাতটা। তখনও ভালো করে জেগে ওঠেনি ইজরায়েল। হঠাৎ সাইরেনের শব্দে কেঁপে উঠেছিল চারপাশ। পর পর বেশ কয়েকবার। আকাশ ততক্ষণে ধোঁয়ায় ঢেকেছে। জানা গেল, ইজরায়েলের উপরে রকেট হামলা চালিয়েছে প্যালেস্টাইন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের স্মৃতি এখনও টাটকা বিশ্বের সমস্ত মানুষের মন ও মাথায়। একের পর এক ক্ষয়ক্ষতি, মুহূর্তে শ্মশানে পরিণত হওয়া আস্ত একটা দেশ, সেই ছবি মোছেনি এখনও মানুষের দৃষ্টি থেকে। তার মধ্যেই আরও দু'টি দেশের মধ্যে লেগে গেল যুদ্ধ। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, সম্ভবত পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের শুরুটা হয়ে গেল এভাবেই। কারণ প্যালেস্টাইনের হামলার পর ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয় ইজরায়েলও। প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধঘোষণা করে দিয়েছে তারা। এ ব্যাপারে সমস্ত ধরনের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর ইজরায়েল।
৬ অক্টোবর, ইহুদিদের কাছে একটা পবিত্র দিন। আর সেই 'সিমহাত টোরা'-র দিনটাকেই নিশানা করেছিল প্যালেস্টাইনের মৌলবাদী সংগঠন হামাস। প্রথম দফায় গাজা থেকে ইজরায়েল লক্ষ্য করে ছুটে আসে ৫ হাজারটি রকেট। হ্যাঁ, সংখ্যাটা চমকে দেওয়ার মতোই। তেল আভিভ এবং বিরশেবার মতো একাধিক জায়গায় বেজে ওঠে সাইরেন। বাসিন্দারা ছুট লাগান যে যেখানে পারেন। তবে কেবল মাত্র রকেট হামলা করেই আশ মেটেনি হামাস বাহিনীর। রীতিমতো বিষাক্ত পিঁপড়ের মতো ইজরায়েলকে সমস্ত দিক দিয়ে চেপে ধরতে ছুটে আসে মৌলবাদী ওই সন্ত্রাসবাদীদের দল। আকাশপথে প্যারাগ্লাইডিং করে ইজরায়েলে ঢোকে জঙ্গিরা, নৌ-পথে জাহাজে এসে জোটে একদল। স্থলপথে গাড়িতে করে ঢুকতে থাকে হামাস সেনাভর্তি একের পর এক গাড়ি। শুধু কি তাই,সিঁদেল চোরের মতো মাটিতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নো-ম্যানস ল্যান্ড পেরিয়ে ইজরায়েলে ঢুকে পড়ে ওরা। জায়গায় জায়গায় তাদের রুখতে গিয়ে গুলিযুদ্ধে জড়ায় ইজরায়েলের সেনা। একের পর এক বিস্ফোরণে কাঁপতে থাকে ইজরায়েলের আকাশ-বাতাস। একের পর এক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মৃতদেহ।
আরও পড়ুন: পবিত্র দিনেই কেন খুন ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ? কারা এই হামাস, কীই বা তাদের লক্ষ্য?
ইতিমধ্যেই প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দিয়েছে ইজরায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। আকাশপথে প্যালেস্টাইনের গাজায় হামলা চালায় ইজরালের বায়ুসেনা। সেখানেও একের পর এক শবদেহের ভিড় জমতে থাকে সেখানেও। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক এই যুদ্ধে দু'দেশের বলি অন্তত ১,১০০। জখম অসংখ্য। ক্রমশ বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। ইজরায়েলে ঢুকেই অকথ্য অত্যাচার চালাতে শুরু করে হামাসবাহিনী। অপহরণ থেকে শুরু করে, প্রকাশ্যে হত্যা, কী করেনি তারা। শনিবার গোড়াতেই জেরুজালেম-সহ একাধিক জায়গার একের পর এক ভবন লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ শুরু করে প্যালেস্টাইনি জঙ্গিরা। রকেট হামলা শেষ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে স্থল, জল ও আকাশপথে ইজরায়েলে ঢুকতে শুরু করে হামাসবাহিনী। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যতদূর জানা যাচ্ছে, ইজরায়েলের ২২টি শহর ও সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে এগোতে শুরু করে হামাস সেনা। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর রাস্তায় অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও সেনাকর্মীকে অপহরণ ও হত্যা করে তারা। ঘরে ঢুকে ঢুকে মারা হয় নিরিহ মানুষকে। সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থা হয়েছে ইজরায়েলের দক্ষিণের শহর সেরোটের। সেখানে রাস্তায় জমেছে লাশের পাহাড়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে একাধিক বাড়ি ও গাড়িতে। মানুষ দেখলেই ছুটে এসেছে গুলির বৃষ্টি। রবিবার পর্যন্ত অন্তত ৭০০ জন ইজরায়েলবাসীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। এতক্ষণে যে সেই সংখ্যাটা আরও বেড়েছে বলাই বাহুল্য। প্যালেস্টাইনের এই হামলাকে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’নাম দিয়েছে ইজরায়েল। এর পাল্টা অভিযান ‘অপারেশন আয়রন সোর্ডস’-ও শুরু করে দিয়েছে ইজরায়েল। যে হামলায় ও-পক্ষের ২৩০ জন মারা গিয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারি হিসেব। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে পাঁচশো।
ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। তাদের অধরা কিছুই নেই। ইজরায়েলের মুঠোয় রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম আয়রন ডোম। যা যে কোনও ধরনের রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আটকাতে সক্ষম। রকেট, মর্টার, গোলা, ড্রোনের মতো সমস্ত ধরনের আকাশপথে হামলাকারী ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে নামাতে সিদ্ধহস্ত এই স্বল্পপাল্লার ডিফেন্স সিস্টেম। এত রকমের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সত্ত্বেও মুহূর্তে ভাঙল ইজরায়েলের সমস্ত ধরণের প্রতিরোধ। কেন আগে থেকে কিছুই জানতে পারল না মোসাদ? বিভিন্ন দেশ তো বটেই, এমনকী প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যেই মিশে থাকেন মোসাদের গুপ্তচকর। তা সত্ত্বেও কোন আঘাতই আটকাতে পারল না ইজরায়েল।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সব প্রস্তুতি সেরেই মাঠে নেমেছিল হামাস। তারা জানত, অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর রকেট দিয়ে হামলা চালানো হলে একসঙ্গে এতগুলো লক্ষ্যবস্তুকে আটকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে আয়রন ডোমের পক্ষে। সে কারণেই আঁটঘাট বেঁধে ৫ হাজার রকেট নিয়ে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল ওই জঙ্গি সংগঠন। তাছাড়া দিনের পর দিন ধরে ইজরায়েলকে নানা ভাবে বিভ্রান্ত করে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠীটি। আর তলে তলে চলেছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। একদিন দু'দিন নয়, প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইজরায়েল সরকারকে তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে যে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ তাদের নয়। শান্তির মাধ্যমেই সমাধান চায় তারা।
এই ৬ অক্টোবরই আবার ইহুদি ধর্মের আরও একটা পবিত্রতম দিন ইয়োম কিপপুর। ১৯৭৩ সালে ওই দিনেই আরব দেশগুলির জোটের সঙ্গে ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ লেগেছিল ইজরায়েলের। আরব জোটের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিল তারা। দুই সপ্তাহ দু'য়েকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও প্রায় ২০ হাজার লাশের উপর দিয়ে জয়ের মুকুট মাথায় পরেছিল ইজরায়েল। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তিতে সেই হামলাই ইজরায়েলকে সুদে আসলে ফিরিয়ে দিল হামাস জঙ্গিগোষ্ঠী। এতদিন তারই প্রতীক্ষায় একটা একটা করে গুটি সাজিয়েছে তারা। ঝড়ের আগে যেমন চারপাশ নিশ্চুপ হয়ে যায়, সেভাবেই গত কয়েক মাস জুড়ে আশ্চর্যরকম শান্তি বিরাজ করেছে গাজা সীমান্ত জুড়ে। তা যে এতবড় ঝড়ের পূর্বাভাস তার আঁচটুকুও পায়নি মোসাদ বা ইজরায়েল প্রশাসন।
এর আগে মহড়ার জন্য নাকি সীমান্তবর্তী এলাকায় নকল ইজরায়েল বাসিন্দা গড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালিয়েছে হামাস-সেনা। শুধুমাত্র মহড়ার জন্য বলি করা হয়েছে এতগুলো মানুষকে। তার পর চলেছে আসল লড়াই। শুধু কি তাই, হামাসরা দিনের পর দিন ধরে ইজরায়েলকে বুঝিয়েছে, যাতে গাজার মানুষজনকে ইজরায়েলে ওয়ার্ক-পারমিট দেওয়া হয়। ইজরায়েলে ঢুকে কাজ করে খেতে পারে যাতে তারা। এই ভাবে হাজার খানেক জঙ্গিকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে গিয়েছে হামাসরা। যাতে ৬ অক্টোবেরের হামলায় এতটুকু খুঁত না থেকে যায়। রকেট হামলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কার্যত পিলপিল করে বিভিন্ন পথে ইজরায়েলে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। সীমান্তের কাঁটাতার ভাঙার জন্য ব্যবহার করা হয় বিস্ফোরক। সেই ফাঁক গলে মোটরবাইকে করে ঢুকতে শুরু করে জঙ্গিরা। এর পর বুলডোজার এনে পথ প্রশস্ত করে ঢুকে পড়ে একের পর এক জিপ। পথে যা পেয়েছে, যাকে পেয়েছে, চূর্ণবিচূর্ণ করে চলে গিয়েছে তারা। হামাস বাহিনীর ট্রাকগুলিতে ভরে ভরে বিভিন্ন রকম অস্ত্র ঢুকেছে ইজরায়েলে। আকাশ পথে প্যারাগ্লাইডিং করে ঢুকতে থাকে জঙ্গি, এমনকী জাহাজে করে সমুদ্রপথেও। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে হামাসদের রুখতে কম পড়তে শুরু করে ইজরায়েলি সেনা। আর রাস্তায় জমতে থাকে লাশের পাহাড়।
আরও পড়ুন: ৫০ বছরের প্রতিশোধ! ৫০০০ রকেটের হামলা! গান শুনতে এসে লাশ হয়ে গেলেন ওরা…
কীভাবে এই বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা জোগাড় করল হামাসরা, কীভাবেই ছকা হল হামলার নীল নকশা? ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। অনেকেই এর মধ্যে অন্য কোনও দেশ বা তাদের বড় কোনও জঙ্গি সংগঠনের মিলিত থাকার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না। বিশেষত সন্দেহের তালিকায় রয়েছে ইরান। কারণ হামাসের এই ভয়ঙ্কর হামলার প্রশংসা করেছে তারা। এদিকে, মারাত্মক এই হামলাকে ইজরায়েলের '৯/১১' বলে আখ্যা দিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার। যে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শুরু হয়ে গিয়েছে গত ৬ অক্টোবর, তা কোথায় গিয়ে থামবে এবং কত জনের প্রাণ নিয়ে থামবে, সেটাই এখন ভাবাচ্ছে বিশ্বের শান্তিকামী সমস্ত মহলকে।