হস্তশিল্প মেলা: সেই রূপকথা যা ফুরোয়নি আজও

Handicrafts Artist: যেই মানুষগুলোর সঙ্গে বছরে একবার করে দেখা হত ওই মেলায়, আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে তাঁরাই আমার ঘরসংসার।

শীত আগের মতো আর তেমন আসে না। তবু হস্তশিল্প মেলা ঠিকই আসে নিয়ম করে। আর শীতকাল মানেই তো হালকা গরম জামা গায়ে জড়িয়ে হস্তশিল্প মেলায় ছোটা। এটাই রুটিন সেই কোন ছোটোবেলা থেকে। এ যেন এক সব পেয়েছির দেশ। চারদিক রঙিন, আলো ঝলমলে। যে যার পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানি। কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প ও হরেক রকম খাওয়াদাওয়া। মনে পড়ে, প্রত্যেক বছর মা আমাকে মেলা থেকে মাটির খেলনাবাটি কিনে দিতেন। পরের বছর আসতে না আসতে সেসব যেন কোথায় হারিয়ে ফেলতাম আমি। পরের বছর মেলায় পৌঁছেই ফের বায়না। কত মানুষ, কত রং, কত রকমের আওয়াজ, মনে হত ঠিক যেন রূপকথা! প্রত্যেকবার মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, "কীভাবে তৈরি করে গো মা এত সুন্দর সুন্দর জিনিস? আমিও বানাতে চাই।"

কোথাও কেউ যেন বসে ঠিক শুনেছিলেন আমার মনের সেই গোপন ইচ্ছার কথা। সত্যি কি কোনওদিন ভেবেছিলাম, সেই নিয়েই কাজ করব বড় হয়ে। যেই মানুষগুলোর সঙ্গে বছরে একবার করে দেখা হত ওই মেলায়, আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে তাঁরাই আমার ঘরসংসার। বিশ্বাস করুন, একটুও বাড়িয়ে বলছি না, একে সংসার ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারি বলুন! সরকারি এক দফতরে ডিজাইনের কাজ করছি আজ দেখতে দেখতে ৯ বছর হয়ে গেল। কবে যেন ওঁরা আমার বৃহত্তর এক পরিবার হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের কাজটা মূলত টেক্সটাইল নিয়েই। কিন্তু শুধু কি তাঁত-শাড়ি, কুটির শিল্পতেও তো নতুন নতুন নকশার দরকার পড়ে সবসময়। তাই সেদিকটাও আমাদের ভাবতে হয়। নদিয়া থেকে দার্জিলিং, সমস্ত স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছি এই ৯ বছরে। করে চলেছি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে শুধুই কি কাজের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এতগুলো বছরে? না, ঠিক তেমনটা নয়।

আরও পড়ুন: মূর্তি গড়া থেকে বিসর্জন, জলই কথা বলে! অভাবনীয় যে শিল্পের সন্ধান দিল কলকাতা

কখনও কখনও ভোর পাঁচটায় ফোন আসে। চোখ কচলে উঠে ফোনের ও-প্রান্তে শুনি, "এই চাষ করতে বেরোবো দিদি, শাড়িগুলো কাল পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু, পেলে জানাবেন।" বা রাত ১১টায় ফোন, "ম্যাডাম আমার মেয়ে হলো এইমাত্র। মা আর বাচ্চা সুস্থ আছে।" এসব ফোন কি স্বজন-বান্ধব না হলে আসে! গরমকালে গাছের আম ঠিক পৌঁছে যায় আমার কাছে। ভোলেন না ওঁরা কোনওবার। তা-ও আবার যে সে আম নয়! ম্যাডাম হিমসাগর ভালোবাসে তাই গাছ পাকা, হিমসাগরই দিতে হবে। শীত পড়তে না পড়তে আমার হাতে এসে পৌঁছয় গুড়। "এই সব কেন পাঠাও বলো তো!" - আমি প্রতি বছর বারণ করি। কিন্তু ওঁরা কানে তোলেন না কোনও কথা। বলেন, "জানি আপনি ভালোবাসেন তাই বকেন।" - এইসব সম্পর্ক কি শুধু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে! কখন সেই বেড়াজাল পেরিয়ে যে ওঁরা বড় মায়ার, বড় আপন হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি। আজ ভালোবাসার কথা মনে পড়লেই, চোখের সামনে কতগুলো সহজ সরল মুখ ভেসে ওঠে।

Handicraft Fair in Kolkata and Life of Handicrafts artist of Bengal By Debatri Goswami Robibarer Royak

কাজের সূত্রে আমাকে প্রায়শই ঘুরে বেড়াতে হয়। যেতে হয় ফিল্ড ভিজিটে। কখনও ধনেখালি তো কখনও নদিয়া। ধনেখালি যাওয়ার সময়ে আমায় মনে করে লজেন্স নিয়ে যেতেই হবে। ভুলচুক হলে রক্ষে নেই। যামিনীবাবু, বছর সত্তরের কাছাকাছি, সমিতির ম্যানেজার। নামের সাযুজ্য খুঁজে ফোনের কলারটিউন দিয়ে রেখেছেন, 'আমি যামিনী, তুমি শশী হে'। ভারী মজার মানুষ এই যামিনী বাবু। ওঁর আবার লজেন্স খাওয়ার ঝোঁক। সেই লজেন্স না পেলে আবার অভিমান করেন। একবার ভুলে গিয়েছিলাম লজেন্স পাঠাতে, অমনি হোয়াটসঅ্যাপে নামল অনুযোগের ঢল। আমাদের অফিসে সব সময় লজেন্স রাখা থাকে যামিনীবাবুদের জন্য। তারপর অমূল্যবাবুর কথাই ধরুন না, অমূল্য বসাক। পঁচাশি পেরিয়েছেন। নদিয়ার সিনিয়র মোস্ট তাঁতি তিনি। কোনও কাজ আটকে গেলেই ছুটি তাঁর কাছে। সব বিপদের মুশকিল আসান অমূল্যবাবু। তাঁতের যে কোনও সমস্যার সমাধান ওঁর নখদর্পণে। অফিশিয়ালি অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে ছুটি পাননি। আর সেটা দিব্যি গর্ব করে বলে বেড়ান অমূল্যবাবু। এখনও বিজয়ার প্রথম প্রণামটা কিন্তু ওঁকেই জানাই। শুধুমাত্র তাঁতশিল্পী হিসেবে নন, সবদিক থেকেই তিনি আমার শিক্ষাগুরু। কত না-জানা বুনন কৌশল যে নিমেষে শিখিয়ে দেন অমূল্যবাবু!

Handicraft Fair in Kolkata and Life of Handicrafts artist of Bengal By Debatri Goswami Robibarer Royak

সরকারি এই দফতরের আমাদের মহিলা শিল্পীদের উপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। গ্রামের মহিলারা যেন এই ধরনের হাতের কাজ করে নিজেদের স্বনির্ভরতার পথটি খুঁজে নিতে পারেন, সেই চেষ্টাই করা হয়। ফলে বহু কাজের জন্যই আমরা ওঁদের উপরেই বেশি ভরসা করি। নানুরের কাঁথাশিল্পী তাজকিরা বেগম। যেমন অসাধারণ হাতের কাজ, তেমনই অসামান্য হৃদয়ের মানুষ। নিজের জমি থেকে তিন বিঘা জমি অবলীলায় দান করে দিয়েছেন। মেয়েদের জন্য সেখানে তৈরি হয়েছে ওয়ার্কশপ। গ্রামের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা কত মহিলাকে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন আমাদের তাজকিরাদি, তা গুনে শেষ করা যায় না। কথায় কথায় একদিন বললেন "দিদি, কেউ যখন এসে বলে না, আপনার জন্য আমার মেয়েকে আবার স্কুলে ভর্তি করতে পেরেছি নিজের উপার্জন থেকে। তখন আমার মনে হয়, আমার সব পাওয়া হয়ে গেছে। আর কিচ্ছু বাকি নেই।" তাজকিরাদিদের মতো এইসব মুক্তর মতো মানুষের সমাজের প্রতি যে অবদান, তার খবর কি আমরা রাখি? না, বেশিরভাগ সময়ে জানা হয়ে ওঠে না, এই সব ছোটো ছোটো কাজের কথা, অবদানের কথা। নিঃস্বার্থ ভাবে নিজেদের ছোট্ট সঞ্চয় থেকেই অনেকটা দিয়ে ফেলেন ওঁরা অন্যের জন্য। আমরা পেরে উঠি না। নিজস্ব ক্ষুদ্র বিশ্ব নিয়ে মেতে থাকি। না প্রচারের লোভ রয়েছে তাঁদের, না অতিরিক্ত অর্থের। পরিশ্রম করে নিজের শিল্পের মাধ্যমে যোগ্য পারিশ্রমিকটুকু পাওয়ার চেষ্টা রয়েছে কেবল। নিজের নাম বা ছবি ছাপানোর কোনও লোভ নেই। মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সাহায্যের হাতটুকু বাড়িতে দেওয়ার মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ রয়েছে, সেটুকু নিয়েই মেতে রয়েছেন এইসব শিল্পীরা।

তাঁদের মধ্যেই একজন আমাদের গীতাদি। গীতা কর্মকার। বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামের মানুষ। লোকে যাকে বলে ডোকরা গ্রাম। গীতাদিও একজন ডোকরাশিল্পী। দীর্ঘদিন ধরে ডোকরার বিভিন্ন জিনিস বানাচ্ছেন। অনেক কম বয়সে স্বামী মারা যান, ছেলে ছোটো। বাধ্য হয়ে সংসারের জোয়াল ঠেলতে কাঁধে নিতে হয়েছিল শিল্পের ভার। তখনও বিকনা এই ভাবে ডোকরা গ্রাম হয়নি। কাজ করতে করতে কীভাবে যেন সেই শিল্পটাই ভালোবাসা হয়ে গেল গীতাদির। সেই থেকে ছেলেকে নিয়ে লড়াই করে চলেছেন। এখন ওঁর গোটা গ্রাম এই ডোকরার কাজে যুক্ত। গীতাদির মুখে সবসময় হাসি দেখেছি, ঠিক যেন 'মায়ের মতন ভালো'। এই ৯ বছর ধরে আমি যা শিখেছি এবং প্রতিনিয়ত যা শিখছি, তা আদৌ কোনও স্কুল-কলেজ শেখাতে পারবে কিনা বলা কঠিন। গীতাদিকে কোনওদিন কোনও কাজে না বলতে দেখিনি। নতুন কাজ বা টেকনিক শিখতে বললে সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন গীতাদিরা। আসলে ওঁরাই যেন এক একটি শিল্প। নাহলে কাজের প্রতি এই ভালোবাসা, এই নিষ্ঠা সম্ভব! মুখে বিরক্তি নেই একরত্তিও। রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে দিনরাত চেষ্টা করছেন শিল্পটাকে জায়গা করে দেওয়ার। হাজার সমস্যা, হাজার বিপর্যয় ছোঁয় এসে ব্যক্তিজীবনকে। অথচ জীবনের প্রশ্নে, শিল্পের প্রশ্নে ওঁরা অনড়। সব বিপদ-বিপাকের মেঘ মাথায় নিয়েই একমনে কাজ করে চলেছেন সবাই, দেখতে পাই।

আরও পড়ুন:কলাগাছের সুতো দিয়ে তৈরি হল শাড়ি! যেভাবে তাক লাগালেন বাংলাদেশের এই শিল্পী

এরকম হাজার তাজকিরাদি, গীতাদি বা অমূল্যবাবুরাই এখন আমার স্বজন, আমার কাছের মানুষ। ভালো হোক বা মন্দ, আমি জানি ফোন ঠিক আসবেই । তাঁদের সেই মায়াবি ভালোবাসার চাদর জড়িয়ে নেবে আমাকে শীতে, গ্রীষ্মে বিছিয়ে দেবে শীতলপাটি। আর সেই ভরসাটুকু হৃদয়ে নিয়েই ফের আরও একটা শীতকাল আসবে। আসবে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই হস্তশিল্প মেলা। যে রূপকথার শুরুটা হয়েছিল একদম ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে। আজও সেই রূপকথাতেই আমি আছি! সারা বছর ধরে বেঁচে থাকা আমার ওই রূপকথার গল্পটাতেই।

More Articles