হেমন্তে ছিল আলো তৈরির পাঠশালা! কালীপুজোর প্রদীপ যেভাবে তৈরি হত হাতে হাতে
Kali Puja 2022: পুজোর কয়েকদিন আগে থেকে চলত সলতে পাকানো পর্ব, আলো তৈরির পাঠশালা।
কালীপ্রতিমা জলে ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই হিম পড়া শুরু হয়ে যায়। রাতের দিকে বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে মাথার চুল ভিজে ওঠে শিশিরের 'ওম' লেগে। ছাতিমগাছে ফুল ফোটে, পুকুরের জলে মিহি সর দেখা যায়। হেমন্তের এসব হলো মার্কামারা দৃশ্য, গ্রাম-মফসসলে দেখা যাবেই। তবে এখন খানিক তফাৎ ঘটে গেছে, একটু দেরি করে আসে যেন সবকিছুই।
পুজোর কয়েকদিন আগে থেকে চলত সলতে পাকানো পর্ব, আলো তৈরির পাঠশালা। মানুষ বাজারজাত পণ্যে এত নির্ভর ছিল না, হাতে কাঁচা টাকার অফুরান সঞ্চয় ছিল না, চারদিকের প্রকৃতির দানকে নিজের মতো ব্যবহার করে গড়ে নিত প্রয়োজনের জিনিস।
বিনোদন এত সুলভ ছিল না তখন, পাড়ার সকলে দিনের পর দিন একসঙ্গে বসে তিল তিল করে শ্রম ও যত্নকে আশ্রয় করে 'বই' নামাত। বড় টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা মঞ্চ, ভাইফোঁটার আগের দিন গ্রামের লোকজন মিলে নাটক করবে। গাছের মাথায় চোঙা বাঁধা, বিছানো আলুর বস্তায় বসে বসে অনুষ্ঠান দেখা, এ গাঁ-ও গাঁ ঝেঁটিয়ে লোক এসেছে। চপ-বেগুনি-পাঁপড়ভাজা কিনে খাওয়া, ফিরতি পথে সস্তার বাসনকোসন, কাচগেলাস, হরেক মাল কিনে বাড়ি ফেরা, ফিরতে ফিরতে রাত পুইয়ে যাবে, ভোরবেলা কুয়াশার নিচে সাদা পোশাক পরে শ্রীখোল বাজিয়ে দুয়োরে দুয়োরে গান শুনিয়ে যাচ্ছে টহল-গায়ক, কার্তিক মাসজুড়ে এই টহল চলবে।কত সব অচেনা পদ গাইছে। টাকা পাওয়ার আশা নেই, নামযশের ভাবনা নেই, গান গেয়ে যাওয়া ভালবেসে।
আরও পড়ুন: তুলসী থেকে কুলেখাড়া, আজও বাংলার ভরসা গাছপালাই
কালীপুজোর কয়েকদিন আগে থেকে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বসে গেছে সার বেঁধে, প্রদীপ গড়ছে কিংবা পুজোর পর মোমবাতি বানাচ্ছে- এ একেবারে চিরপরিচিত দৃশ্য ছিল। এখনও সার বেঁধে বসছে ছোট ছোট বাচ্চারা, হাতে ফোন।
যত দিন যাচ্ছে, আলোহাওয়ার বদল ঘটছে, সময়ের জিনিস সময়ে থাকছে না, গ্রামের দিকে ছোট ছোট নাটকের দল কোনও মতে টিকে আছে কোথাও কোথাও; আলো তৈরির পদ্ধতি প্রায় বিলুপ্ত আস্তে আস্তে। আমাদের চেনা-জানা চালচিত্র একটু একটু করে ঠান্ডা জলের নিচে ডুবে যাচ্ছে।
যে-কোনও মাটি দিয়ে উপযুক্ত পাত্র গড়া যায় না। কোন জলের মাটি সুন্দর, কোন নদীর পলি টিকবে বেশিদিন, কোন কাঁকড়া-গর্তর পাশে থাকা মসৃণ মাটিতে আঙুল চালানো যাবে সহজ ও সাবলীলভাবে- এ কাউকে শিখিয়ে দিতে হত না, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে যেন শিখে যেতাম।
আনাড়ি ও ছোট বাচ্চাদের সাহায্য করত বয়সে একটু বড়রা। মাটি খুঁড়ে এনে, বালি-কাঁকড়, কেঁচো-গুগুলি বেছে মাটি নরম করতে হবে ময়দার তালের মতো,ছেনে ছেনে সুন্দর করে তুলতে হবে, তাড়াহুড়ো করা চলবে না, এখান থেকেই শিক্ষা পেতাম ধৈর্যর।
মাটি তৈরি হয়ে গেলে হাতের তালুতে নিয়ে গোল তৈরি করা। সেই গোলাকার গর্তে সলতে রাখার মুখ বানিয়ে অনেক যত্নে, অনেক ভালবাসায় প্রদীপ তৈরি। বাড়তি মাটিতে কেউ কেউ চটজলদি বানিয়ে ফেলত বউপুতুল, জন্তুজানোয়ার।
এরপর চলবে রোদ খাওয়ানো। ধীরে ধীরে শুকিয়ে নেওয়া। রোদ দেওয়া সাঙ্গ হলে পুজোর দিন বিকেলে একবার মৃদু জলে চুবিয়েই কাপড়পাড় দিয়ে সলতে ও সরষের তেলে সাজিয়ে তোলা হলো। মৃদু জলে ভেজানো হলে তেল কম টানে। একই কায়দায় বুদ্ধিমতি চা-দোকানি মাটির ভাঁড় ভিজিয়ে চা পরিবেশেন করে, যাতে শুকনো ভাঁড় চা শোষণ করে না নেয় বেশি।
এইবার কাঁঠালপাতায় রেখে ঘরে বাইরে উঠোনে পুকুরের ধারে গাছতলায় মরাই ও ঢেঁকিশালে সারি সারি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া। বিবেকানন্দ-মার্কা কাগজে প্যাঁচানো রোগা রোগা মোমবাতি আলোকিত করে তুলছে চারদিক। তামসীকে জয় করে জ্বলজ্বল করছে আলো।
একটা বড় নারকেল মালায় কঞ্চি ঢুকিয়ে তৈরি হতো টর্চ। মালার মধ্যে বসিয়ে দাও ছোট ছোট মোমবাতি, আলো হয়ে গেল, শক্ত হাতে ধরে এবার পাড়া বেড়াও ব্যক্তিগত টর্চ নিয়ে, টুপ করে তুলে নিও এর-ওর বাড়ি থেকে মোম, আলো যে এভাবে চুরি করা যায়- এই বোধে নিজেকে তখন মনে হচ্ছে গ্রিক রূপকথার চরিত্র, স্বর্গ থেকে যে আগুন চুরি করে এনেছিল।
পরের দিন সকালে দেখা যাবে, শ্যামাপোকা পাখা ঝরিয়ে মরে আছে, মোম পুড়ে পুড়ে ক্ষয়ে গেছে। কুছ পরোয়া নেহি! ঝরে থাকা মোম ব্লেড দিয়ে চেঁছে তুলে ছোট বাটিতে গলিয়ে নাও, পেঁপে গাছের ডাল কেটে একটা মুখ আটকে সুতো দিয়ে গলন্ত মোম ঢেলে তৈরি করে নেওয়া গেল হাতে বানানো মোমবাতি।
এইসব আলো তৈরির কারখানা লুপ্তির পথে। একসঙ্গে জড়ো হয়ে মহড়া দিয়ে নাটক তোলা দূর অতীত এখন।একসঙ্গে বসার সময়ই নেই। হাতের আঙুল এমনভাবেই তৈরি হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ পরপরই ফোনের স্পর্শ আঁকড়ে ধরতে চায়। জ্যান্ত ও সতেজ জিনিসের চেয়ে কৃত্রিম জিনিসের চটক চিরকালই তো আলাদা।
বাজার ছেয়ে গেছে ইলেকট্রিক নানা আলোতে।কতরকম রং, কতরকম তার বাহার। পয়সা ফেললেই হলো। অপেক্ষাও করতে হবে না, যত্নও করতে হবে না।দুম করে কিনে দুম করে জ্বালিয়ে দিলেই হলো।
তবু হেমন্ত এলে মনে পড়ে, মনে পড়বেই, ছোটবেলার আলোকারখানায় তৈরি আঁকাবাঁকা প্রদীপ ও রোগা রোগা মোমবাতি। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতরে থাকা কারখানাগুলোতে তালা পড়ে যাচ্ছে, মরচে পড়ছে।
একটু শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে; দরজা ফাঁক করলেই কিন্তু দেখা যাবে, শীতের ঘোমটার নিচে হিম ও কুয়াশায় জবুথুবু হয়ে ছাদের কিনারে মিটমিট করে জ্বলছে একাকিনী আকাশপ্রদীপ।