পেট ঢালাই হোক সিমেন্টবালিতে, ভাতের চিন্তা থাকে না! গ্রামবাংলার খিদের না-বলা গল্প

Rural Bengal: অল্পে খুশি হওয়া, আকাশের দিকে তাকিয়ে রেগে ওঠা, পরস্তাব বলা মানুষের দল কোথায় গেল?

বাজারের তরিতরকারি, মাছ, ফল ও নিত্যদিনের জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। একজোড়া লেবু- ১৬। সরষের তেল- ২০ টাকা কেজি। চালানি রুই- ২৫ টাকা কেজি। পাটশাক আঁটি- ১৫ টাকা।

বেলা করে মাছবাজারে গেলে অথবা কুপি-জ্বলা সন্ধের বাজার, পাটশাকের বদলে জলায় নেমে হিংচে, অনেক দরদামে না হলে সত্যি-ইলিশের বদলে খোকা ইলিশ/ ভোলা/ কোকিলা। বরফচাপা মাছ পছন্দ না হলে সস্তা তেলাপিয়া বা সিলভার কাপ। বাড়ির গাছে ফাল্গুনের কচি নিমপাতা- এইসব কম পয়সায় খেয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্র। ইটভাটার শ্রমিক ও রোদজলের মানুষরা এইসব আবিষ্কার করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কিন্তু, এই সমস্ত তুক বিফল হয়ে যাচ্ছে।

এইসব দেখে আমার চোখের সামনে শীতলা মন্দিরের কাছে দু'জন ভ্যানে বসে থাকা মানুষ আকাশের দিকে মুখ না তুলে বলল, এই খানকির ছেলে পেটের গর্তটারে ইচ্ছা করে সিমেন্টবালিতে ভরতি করে ঢালাই করে দি। না করতে হবে বাজার, না হবে তিনবেলা ভাতের চিন্তা...

আরও পড়ুন: ‘ইন্ডিয়ায় সহজে মাছ মেলে না’, তাই ওপার থেকে এল হাঁড়িভর্তি সরষে-ইলিশ

অভাবের বেড়া দিয়ে ঘেরা বাসা, তাতে সাদা অনটনফুল এদের। পেটে ভাত নেই, পরনের কাপড়ের অভাব, ভেজা জামা গায়ে শুকনো করতে হয়, খিস্তি করে, তবু সাক্ষাৎ আনন্দের বসবাস এদের বাড়ির লেপাউঠোনে।

কাজের জন্য একজনের বাসা নবদ্বীপ, গোরার লীলাভূমিতে, ইনি কাঠ কুঁদে নকশা বানান। এর বোনেরা একে আপনি সম্বোধন করে, ধুতি পরেন, ছোটখাটো আনন্দময় মানুষ, স্ত্রী মারা গেছেন, কুকুর-বেড়াল-পাখি নিয়ে থাকেন। আর কবিতা লিখে চলেন। ছোট ছোট স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ভগবানের প্রতি নিবেদনপদ। এই কবিতা লেখা তাকে নাকি জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তির দিকে টেনে নিয়ে যায়।

অন্যজন থাকেন অগ্রদ্বীপের কাছে, গোপীনাথ যেখানে ভক্তের শ্রাদ্ধকাজ সমাপন করেন। গোপীনাথ মন্দির থেকে খানিক পশ্চিমে বেত, বাঁশ আর তমালছায়ায় ছোট্ট কুটির। তাঁত বোনেন, আর গান রচনা করেন।বাঁশের ময়ূর, কাঠের ধনুক, লাউখোলের একতারা, দোতারা গড়তে পারেন। বেতের কচিডগা নুনলঙ্কায় জারিয়ে ভাতের পাশে মেখে খান। ভবানন্দ নামে গান লেখেন। প্রিয় গান টুকে রাখেন। খাতায় লিখে রাখা-

সাধনভজন জানি না মুই, ওরে আমার মন।
একটা হাতির কয়টা হাত আর কয়টা আছে পা।
বড়ো বড়ো কান দুটি তার,ছোট এক মাথা -
একবার যদি কাদায় পড়ে তখন তাহার উপায় হবে কী?
ব্রহ্মা বিষ্ণুর বাড়ি কোথায় না আছে জানা,
ওরে আমার মন...

কোথাও খেদ জমলে দু'জনে মিলে তেড়ে খিস্তি করে গলা ধরে ফিরতেন। মৃতদেহ সৎকারের কাজ বা কোনও বিপদ-আপদ, এরা দু'জন আছেই।

এঁদের মা গোবর কুড়োতেন, ত্যাওরা শাক তুলতেন ভুঁইয়ে, রাত্রিবেলা পান খেতেন ছেঁচে ঠুকঠুক করে মোতিহারি তামুকপাতা দিয়ে। পাথরের গেলাসে দুধ-নারকেল, আতপচালে শ্যামের জন্য পিঠে গড়তেন। নামসংকীর্তন শুনলে চোখ দিয়ে অবিরল জল গড়াত, মাথার ওপরে দু'হাত তুলে নাচতেন। সাদা থানে জড়ানো, গলায় তুলসীমালা, রোগা রুদ্রাক্ষ ফলের মতো তোবড়ানো গালের বুড়িপুতুলের নাচ দেখলে দেহ শিহরিত হতো। দিনেরবেলা কখনও তিনি পরস্তাব বলবেন না, তাতে নাকি মামাবাড়ির ভাতের হাঁড়ি ফেটে যায়। সন্ধ্যার নবজলধরে তিনি নাকি যুগলমিলন দেখতেন।

মন আনমনা সেই এদের বাড়িতে কাচের বদনার মতো পাত্রে অনন্ত এসে যেন তামাকগুড় নিয়ে গুড়ুক গুড়ুক খেতেন। ভক্তির ধূম উঠত। অই বৃদ্ধা আমার দেখা প্রথম নৃত্য-জানা ভক্তিমতি নারী, ওঁর স্বামী মরণের আগে গায়ে-মাথায় উঠোনের মাটি লেপে দিয়েছিলেন, তখন আমি বসতে শিখেছি সবে।

ওঁর স্বামীর নাম ধুলো রায় ,আষাঢ়ের বিকেলে দেহে মাটি ছুঁইয়ে কোন বিজনগহনের ইশারা দিয়েছিলেন?

এইসব অল্পে খুশি হওয়া, আকাশের দিকে তাকিয়ে রেগে ওঠা, পরস্তাব বলা মানুষের দল কোথায় গেল?


আমি আর সন্তোষদা বাংলার পুরাতন গ্রামঘাট, জল-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। অল্প টাকায় দু'-এক সন্ধের বেড়ানো। খাঁ খাঁ জ্যোৎস্নার ভেতর গঙ্গাটিকুড়ি গ্রামের আমবন দেখি, ভোরবেলা আবার বাস থেকে নেমে উদ্ধারণপুরের চা-দোকানে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে চা খাই বিস্কুট চুবিয়ে। মনে ভাবি, এখানেই, এই মহাশ্মশানেই অবধূত থাকতেন।

গত বিকেলে শাঁখাইঘাট পার হয়েছি খেয়ায়। গোধূলির ছোপ লেগেছে আকাশে। পুরনো জায়গা। হাঁটছি আমরা দু'জন।

হাঁটতে হাঁটতে গাছপালা পেরিয়ে এমন এক কাশবনে ছাওয়া জায়গায় এলাম, এখানে মানুষজন নেই।অনেকদিনের একটি ঘাট। কিছু প্রাচীন নৌকো মাটিতে পোঁতা। তাতে লতিয়েছে উচ্ছেলতা। একজন মানুষ স্নান করছে। সূর্য ডুবছে।

হঠাৎ দেখি, কিছু দূরে বনবেলি গাছের ছোট ছোট ডাল পুঁতছে। কথা বলে জানা গেল, একা থাকেন। সবাই বলে মাথায় ছিট। রাতের বেলা নিয়ম করে কুকুরদের বিস্কুট খাওয়ান। গাছের কলম তৈরি করে বেড়ান।

এত কিছু হারানোর ভেতরে এইসব প্রাপ্তি মিলে গেলে বেঁচে থাকার সাহস বাড়ে।

More Articles