তুলসী থেকে কুলেখাড়া, আজও বাংলার ভরসা গাছপালাই
Natural medicines: আগুন জ্বালাতে শেখা ও চাকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে শিখে নিতে হয়েছে হাতের কাছে থাকা গাছপালার সাহায্যে নিজেকে নিজেই সারিয়ে ফেলতে পারার অপূর্ব কৌশল।
সৃষ্টির পর আদিম অবস্থা থেকে যখন একটু একটু করে প্রাণের চরাচর জেগে উঠেছে, তখন থেকেই প্রতিনয়ত লড়াই করতে হয়েছে টিকে থাকার জন্য। খাদ্য সংগ্রহ, হিংস্র পশুর থেকে আত্মরক্ষা, আগুন জ্বালাতে শেখা ও চাকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে শিখে নিতে হয়েছে হাতের কাছে থাকা গাছপালার সাহায্যে নিজেকে নিজেই সারিয়ে ফেলতে পারার অপূর্ব কৌশল।
এই বিদ্যা কিন্তু একদিনে আয়ত্ত হয়নি, দিনের পর দিন ধরে কত না-এর ভিতর দিয়ে, কত নিপুণ মনঃসংযোগ, সূক্ষ্ম ও সজাগ দৃষ্টিতে শিখে নিতে হয়েছে। তারপর অতি যত্নে আয়ত্ত করা বনৌষধির রূপকথা রক্তের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছে শ্রুতির মাধ্যমে, ছড়িয়ে পড়েছে প্রজন্ম-পরম্পরায়।
কোন ঋতুতে কোন গাছ জন্মাচ্ছে, কোন সময়ে কোন গাছের ফল পাকল, শরীরে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কোন পশুপাখি কোন গাছের বাকলে গা ঘষল, কোন পাতা চিবিয়ে খেল- এই দিকেও রাখতে হয়েছে চোখ। গাছের কোন অংশের ব্যবহার কীসের সঙ্গে- এও এক পাঠ বইকি। অফুরন্ত বৈচিত্র্যময় গাছপালা ও মানুষের প্রকৃতির স্বাভাবিক ও সহজ যোগ মানুষকে আপনা-আপনি দিয়েছিল আরোগ্য-উপায়।
আরও পড়ুন: বেসনে চুবিয়ে শাপলার ভেলাভাজা! ওপারের হেঁশেলে লুকিয়ে অচেনা রান্নার গন্ধ
যে-কোনও সামান্য অসুখে হয়তো ঠান্ডা লাগা, মৃদু পেটখারাপ, কাশি, হাতে-পায়ে ব্যথা, সঙ্গে সঙ্গে মুঠো মুঠো ওষুধ খেয়ে নেওয়া অক্লেশে- এর ফলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও বিভিন্ন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া পড়ে শরীরে। জীবন এমনই দ্রুত হয়ে গেছে, স্থিরতার কোনও চিহ্ন নেই, একটু শ্রী একটু সেবার ঠান্ডা হাত ধীরে ধীরে লুপ্ত যেন।
বয়স্ক ঠাকুমা-দিদিমারা কীভাবে, কত যত্নে ভোরের শিশিরে, সন্ধের আঁধারে পায়ে হেঁটে আমাদের অসুখের কথা শুনে নিদান দিতেন বনৌষধির। নিদান দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না, শিখিয়ে দিতেন গাছপালা ও প্রয়োগের নিয়ম। এইসব আশ্চর্য মানুষদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হয়ে যাবে এই বিদ্যার। গাছপালার বিভিন্নতাও কত কমে এসেছে আগের থেকে। নিচে মুখে মুখে প্রচলিত সেই আবহমান বনৌষধির সামান্য কিছু উল্লেখ করা হলো।
জ্বরজারি বা ঘন ঘন সর্দি লাগাতে তুলসীপাতার রস তো রীতিমতো প্রাণদায়িকা। খালি পেটে এই রস মধু দিয়ে দু'-তিনদিন খেলেই ম্যাজিক। প্রসঙ্গগত উল্লেখ, শেফালি পাতা অর্থাৎ শিউলিপাতার রসও খুব উপকারী।
যে-কোনও পেটখারাপ বা পেট ব্যথায় থানকুনি পাতা খুবই কাজের। দুপুরে পাতলা করে খাওয়া যেতে পারে গাঁদালপাতার ঝোল। ধৈর্য ধরে একটু গন্ধ সহ্য করতে হবে আর কী।
বরশিলা থেকে এপারে আসা দিদিমার হাত দু'টি বড় লক্ষ্মীমন্ত ছিল। দেখতাম কৃমিনাশের জন্য কীভাবে কালমেঘ পাতা শিলে বেটে ছায়ায় শুকিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করে কৌটোয় রেখে দিত স্নেহ ও মমতার মায়া মিশিয়ে।
চোতক্ষ্যাপা বলে এক ধরনের রোগের কথা শোনা যেত আগে। চৈত্র-দুপুরের ঠা ঠা রোদ গেলে মাথা বিগড়ে যেত। তখন মাথায় খানিক ঘৃতকুমারীর শীতল শাঁস (অ্যালোভেরা) ঘষে, পুকুরের পাঁকে গেঁথে রাখা ডাব তুলে এনে জল খাইয়ে, ঘন ঘন বেলের পানা খাইয়ে এই ক্ষ্যাপামোর উপশম ঘটানো হতো।
বাড়ির দক্ষিণে নিমগাছ লাগানোর বিধি ছিল। এই হাওয়া রোগনাশক ও উপশমকারী। চামড়ার রোগ হলে, ঘা-প্যাঁচড়া হলে নিমপাতা গরমজলে ফুটিয়ে, ধুইয়ে দিলে শুকিয়ে আসত ব্যথা। সাদা গরম জলে নিমপাতা ফোটাতে ফোটাতে ঘন এক রং ধরত।
অতীত দিনে অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল টলোমলো, কিন্তু প্রাণশক্তি টানটান ও প্রকৃতির সমারোহ এই বিদ্যাকে পরিপুষ্ট করেছিল। এই যে আমি শ্বাস নিচ্ছি হাওয়ায়, ভাত খেতে পারছি, বেঁচে থাকছি- এ তো সম্ভব হতো না, যদি না পূবপুরুষ, পূর্বনারীরা বেঁচে থাকার কতরকম কৌশল ধীরে আয়ত্তে না করে নিতেন। প্রণাম সেইসব ধাই-মা, সেই গাছপালার গুণ জানা, ধাতুপাথরের গুণ জানা মানুষদের।
ধীরে ধীরে রক্ত, স্মৃতি ও শ্রমের ভেতরে গড়ে ওঠা বিদ্যা অনেক ঝড়ঝাপটার পরেও সম্পূর্ণ মুছে যেতে পারে না।
মাথাধরায় আদা চা, পেটখারাপে কাঁচকলা-পেঁপে, অনিদ্রায় শুষনি শাক, রক্ত বৃদ্ধিতে কুলেখাড়া- এইভাবে এখনও টিকে আছে পুরনো মানুষদের তৈরি প্রকৃতির কাছ থেকে সংগ্রহ করা আদিম ও সহজ বিদ্যা। এই ক্ষীণ গাছপালার রেখা ধরে পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করলে আমরা পৌঁছে যেতে পারব লুপ্ত বনৌষধির মহারণ্যে।