চিতাতেই সব শেষ নয়, বাংলার গ্রামে মৃত্যুর পরে যেভাবে জড়িয়ে থাকে গাছ
Rural Bengal: মৃত্যু ঘিরে এতরকম মানুষের একসঙ্গে হওয়া। আমগাছের ডাল বয়ে আনা, পাটকাঠি নিয়ে আসা, এতরকম লোকজনের একসঙ্গে হওয়া দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
ছোটবেলায় ঠাকুমাকে যে সাদা কাপড় পরতে দেখতাম, তাতে ময়লা জমলে মা ভাতের উনুনে কাপড় সেদ্ধ করে দশকর্মার দোকান থেকে আনা নীল ছড়িয়ে মেলে দিত।চিট-ময়লা তোলার জন্য পাত্রে ফোটানো হতো, তারপর নীল। এই নীল বিক্রি হতো পুরনো নিচু আলোর দোকানে। কাগজের ঠোঙায় মাটির ঢেলার মতো দেওয়া হতো। এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না সহজে। এমন ধবধবে পরিস্কার হতো, কাপড়ের রঙে আলো হয়ে যেত উঠোন। ভাত খেয়ে, মুখ ধুয়ে ভেজা ঠোঁট মুছতাম বিধবার থানে, লুকিয়ে।
তারপর বিকেলে বেরোলে খেলতে পারতাম না বলে সবাই দূর করে দিত। রোগা আর কালো বলে খুব রাগাত। কেঁদে ফেলতাম। গলার স্বর নরম বলে ক্ষ্যাপাত। কেঁদে ফেলতাম। মেয়েলি বলত। যাকে বন্ধু বলেই জানতাম, সে ইচ্ছে করে ডেকে নিয়ে গিয়ে খেজুরঝোপে ফেলে দিল। কিন্তু জানতাম, ঠাকুমার নীল দেওয়া কাপড় আছে আশ্রয়সুতো।
হাতের চেটোয় চোখের জল মুছতে মুছতে দৌড়ে এসে ঠাকুমার সাদা আঁচলের নিচে টুপ ঢুকে পড়তাম।গোপাল জরদার ঘ্রাণ। ঠাকুমা বুকের কাছে নিয়ে গপ্পো শোনাত, গান শোনাত, গাছ চেনাত, মাটির পুতুল গড়া শেখাত।
আরও পড়ুন: গোপন ভিডিও থেকে অসভ্য অসভ্য খেলা! পাড়াগাঁয়ের যৌনতার ক্লাসরুম কেমন ছিল
ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর শাড়িটা যে কোথায় গেল, কে জানে! শ্মশানে দিয়ে দিয়েছিল কেউ?
আজ যখন কেউ কেউ ব্যথা দেয়, অপমানের চাকা চাকা দাগ করে দেয় শরীরে, তখন সেই আঁচল খুঁজি, ভীষণভাবে খুঁজি, কাঁদতে কাঁদতে খুঁজি।
বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়ায়। খোঁজ নেয়। খবর নেয়। আমি আমার বন্ধুদের পোশাকের দিকে তাকিয়ে দেখি, কোথাও সেই শান্ত আশ্রয় রঙের ঠাকুমার শাড়ির রং টুকরো টুকরো হয়ে ছিট ছিট এখানে মিশে গেছে কি না!
এতটা ব্যক্তিগত গৌরচন্দ্রিকা করে শুরু করলাম কারণ, ঠাকুমার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। সেই প্রথম শ্মশান দেখা, ছোটবেলার অমন কাঁপতে থাকা ঘন রূপকথার জগৎ ভেঙে পড়ল। শোক কী, ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম।আর এই উদাসীন শোক আমাকে আরও দেখার দিকে নিয়ে গেল।
সাইকেলে চেপে দিগবিদিক ঘুরে বেড়াই। গ্রামে গ্রামে ঘুরি। শ্মশানগুলো দেখি। আশপাশে তিরতিরে বয়ে যাওয়া নদী থাকে প্রায়শই। পাশেই মন্দির দেওয়ালে পোড়াকাঠ দিয়ে মৃত ব্যক্তির নাম লেখা। শ্মশানের সেই ভয়াবহতা অনেক কমে গেছে। খুঁজলে-টুজলে দু'-একটা শেয়াল মিলতে পারে মাটির নিচের গর্তে।
একটি মানুষের মৃত্যুর সময় নাকি নাক বসে যেতে শুরু করে। নাক দেখেই বুঝতে পারা যায়, মৃত্যু আসন্ন।তারপর সবাই ধরাধরি করে ঘর থেকে খোলা আকাশের নিচে নামিয়ে দেওয়া।
মৃত্যুর পর বাঁশ কেটে খাটিয়া বানানো। কাঁধে কাঁধে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। খই-ছিটানো মুখে হরিধ্বনি।এইরকম ছিল শবযাত্রার ছবিটি। একজনের শোককে নিভিয়ে আনার জন্য পাড়া-প্রতিবেশী, কতজন শামিল হয়েছে।
এমন দৃশ্যও দেখা যে, চাষ করার ট্রাক ভর্তি করে গাঁ থেকে লোক এসেছে। মৃতদেহ সাজানো রঙিন বেলুন দিয়ে। একজন মহিলা ঘোমটার আড়ালে বসে বসে চপ-মুড়ি খেতে খেতে খানিকক্ষণ কেঁদে নিয়ে আবার খাওয়াতে মন দিচ্ছে।
মৃত্যু ঘিরে এতরকম মানুষের একসঙ্গে হওয়া।আমগাছের ডাল বয়ে আনা, পাটকাঠি নিয়ে আসা, এতরকম লোকজনের একসঙ্গে হওয়া দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
লোকজনের দেখা পাওয়া যায় না এখন। মৃতদেহ কাচ-ঢাকা গাড়িতে শোয়ানো, দু'-চারজন লোক। শোক কেমন ভারি হয়ে থাকে। এমনকী, যে গান গ্রামে মানুষের খালি গলায় শোনা যেত, তা যন্ত্র গায়। প্রযুক্তি বিষয়ে বলার কিছু নেই। বলার বিষয়, এক মানুষের কাছ থেকে অন্য মানুষের নিঃশব্দে সরে যাওয়া।
কিছুদিন আগে মানুষ দেখার নেশায় 'বিশ্বকবি' বাসে চড়ে গ্রাম দেখতে যাচ্ছি। যে-কোনও একটা জায়গায় নেমে যাব। কবিদের গ্রাম ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছে বাস। শ্রীনিবাস আচার্যর যাজিগ্রাম, খানিক এগোলে জ্ঞানদাস, সুদূর কৃষ্ণদাস কবিরাজকে পাশে রেখে নানুরে চণ্ডীদাস, বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ, অজয় তীরে জয়দেব রয়েছে। গন্তব্য কোথায় হবে ঠিক করিনি।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি, দূর গ্রামের মড়া বেশিরভাগ আসে উদ্ধারণপুরের ঘাটে। বনমালা নামের একটি বাস সাইড নিল দ্রুত। কুয়াশা ফেটে রোদে ভরে আছে চারপাশ। বাসের ঠাকুর চিনামাটি দিয়ে তৈরি শিব। তাতে ঝকমক করছে জ্যান্ত চন্দ্রমল্লিকা, দেবদারু পাতা। সুন্দর সাজানো। ড্রাইভারের রুচি আছে বলতে হবে।
বাসের সামনে একটি হলুদ-রঙা ট্রাক চলেছে। চিন্তা থামিয়ে ট্রাকের পিছনে কী লেখা আছে, মাঝে মাঝে পড়ে নিই। '৮০ বন্ধু আবার দেখা হবে', 'হিংসা নয় চেষ্টা করো', 'জয় শ্রী রাম', 'দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি', 'কৃষ্ণ বলো সঙ্গে চলো'- এসবই লেখা থাকে।
জ্ঞানদাস কান্দরা পার হওয়ার সময় দেখা এই হলুদ ট্রাকের পিছনে লেখা-
ফুল যখন ফুটেছিল, ভালো যখন বেসেছিলে, কেন যাবে ভুলে কেন যাবে?
কে জানে কোন অনামা কবি এমন বুক-মোচড়ানো, স্তদ্ধতামাখা দু'টি লাইন লিখে রেখেছে।
বাস চলেছে। মন উদাস হয়ে আছে। কিছুটা এগোনোর পর খেয়াল করলাম, পরপর একটা করে বিশ্রামের জায়গা করা আছে, মৃতদের বয়ে আনার পথে হাঁফ লাগলে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। সেখানে এখন বুনো ঝোপ, ছাগলের নাদি এইসব।
বাস থেমেছে কোমরপুর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে।খানিকক্ষণ সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরের পাশে একটা বটগাছ। দাহ করে শ্মশানবন্ধুরা ফিরছে। ফিরে সবাই গ্রামে ঢোকার আগে ওই বুড়ো গাছটাকে একবার জড়িয়ে ধরে তারপর ঘরের পানে যাচ্ছে।
মৃত্যু-পরবর্তী এমন এক রীতি দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল। শোককে কি এভাবে গাছের কাছে দিয়ে যাওয়া?
আজকাল এইসব রীতি, এইসব একসঙ্গে হওয়া কারা যে খুবলে খেল। অথচ এমন সব পরাণকথার গন্ধ ছিল আমাদের, সেসব শোনানোর জন্যই শীতলপাটি এইসব আখ্যান বলে যাওয়া।