মৃত ছেলের শোক নিয়েই বাটামাছের বিকিকিনি! গ্রামের হাটে-বাজারে নানা রঙের গল্প
Rural Bengal: বাজারহাটে ঘুরে, পথে পথে বেরিয়ে একটু মানুষের কথা শুনলে, পাশে চুপ করে বসলেই আমরা বাঁচিয়ে ফেলতে পারব এইসব সত্যি বেঁচে থাকার কথনবিশ্ব।
যে-কোনও নতুন জায়গার প্রাণ বুঝতে গেলে সেখানকার বাজারে যেতে হয়। ছোট-বড় দোকান, ঘুমটি, ফুলচারার পাশে কামারশালা একটা ছোট্ট সেলুনের পাশে মাটির জিনিস বিক্রি হচ্ছে। খাবারদাবারের স্বাদ উপভোগ করতে হয় সময় নিয়ে, মাছ দেখতে হয়, তাজা আনাজ-ফল ও হরেক দ্রব্য, আর দু'চোখ মেলে মানুষ দেখো। কিসসা পাবে, জীবনরসের ভিয়েন পাবে, পাবে মধুর স্তদ্ধতা।
নয়ের দশকের বাজারের সঙ্গে এখনকার বাজারের মিল নিভে এসেছে স্বাভাবিকভাবেই। বাজার এখন ছোট ছোট ভ্যানগাড়িতে ভেঙে লোকের দুয়োরে চলে যায়, গৃহিণী উঁচুতলা থেকে দড়ি ঝুলিয়ে বাজার তুলে নেয়।সংযোগও হলো না কোনও। আন্তরিক কথাবার্তাও না।
হাতের কাছে পাওয়া জিনিস দিয়ে ব্যবহারের উপযোগী জিনিসে রূপান্তর করার বিষয়টি ফুরিয়ে এসেছে এখন।
আরও পড়ুন: চিতাতেই সব শেষ নয়, বাংলার গ্রামে মৃত্যুর পরে যেভাবে জড়িয়ে থাকে গাছ
বাজারের প্রবল ভিড় আর জমির ধু ধু নিঃসঙ্গতার ভেতর বসে মনে করি, মায়েদের সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকার মায়া ও আশ্চর্য রন্ধনশৈলী।
বাজার থেকে আসা আনাজ ভাগ হয়ে যাবে প্রথমেই।দাগ ধরা, প্রায় নষ্ট শাকপাতা চলে যাবে পড়শিদের গোরুর পাদনায়, নিজেদের ছাগলের খাবারের পাত্রে।
লাউ, কুমড়ো, ডাঁটা, ঝিঙে, ফুটি, লেবু এলে ধুয়ে ধুয়ে বীজ তুলে রাখা হতো শুকনো করে, তারপর বর্ষায় লাগিয়ে দেওয়া হবে আওতা ও রোদঘেরা জায়গায়।
কাঁঠালের বীজ ডালে, ঘ্যাঁটে খাওয়া হবে। আলুর খোসাও ভাজা খেতে চমৎকার। আনারসের পাতাওয়ালা মাথা কেটে মাটিতে বসিয়ে গাছ বানিয়ে ফেলবে, তাতে রসস্থ সব আনারস।
কিনে আনা ব্রাহ্মী, কুলেখাড়ার একটা ডাল জল-জল জায়গায় পুঁতে দিলেই দিব্য গাছ হয়ে যায়, এ শিক্ষা কতদিনের পুরনো।
একটি ডিম ভেজে মামলেট করে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে আলু দিয়ে গা-মাখামাখা করে রাঁধলে কী যে সোয়াদ তার! অথবা চালের কুমড়োফুল বেসন চুবিয়ে ভাজা, বেসন না থাকলে আতপচাল বেটে! সকালে খাওয়ার কিছুই নেই? কেবল গতকালের কড়কড়ে ভাত? কুছ পরোয়া নেহি! ঠিক পরিমাণে নুন, কাঁচা তেল, অল্প একটু হলুদ ছড়িয়ে দিলেই অমৃত! সঙ্গে গাছের কাঁচালঙ্কা।
মিষ্টির শিরা (রস) না ফেলে চাটতি বা চা'তে ব্যবহার অবাক করে দিত, কিংবা জমে থাকা শিরা দিয়ে বাদাম সহযোগে বাদামচাক। ভাতের ফ্যানে পাঁপড়, শাপলা ফুলের বড়া ভাজা আমি নিজে খেয়ে দেখেছি।খামআলু, খারকোলপাতা, পলছাতা, বুড়ো শসার শাঁস, বাঙাল ডাঁটা, গুগুলির স্বাদ যারা জানল না, হায়!
বাজারে এখনও মাটির হাঁড়ি, তরকারি রাঁধার খুড়ি, রুটি ভাজার মাটির তাওয়া, টাকা জমানোর লক্ষ্মীর ভাঁড় বিক্রি হয়,কিন্তু খুঁজে পাওয়ার জন্য হাড়ে দুব্বো গজাবে। গঞ্জের বাজারে যেখানে শ্মশানকালী হয় রাসের মেলায়, তার একটু তফাতে একজন বুড়ো গাছের অসংখ্য বীজ, চারা নিয়ে বসত। কিনে এনে একটু যত্ন করলেই বাড়িতে চমৎকার ফনফনিয়ে বাগান বেড়ে উঠত। লোকটা যে কোথায় গেল!
সকালে পাখিদের জন্য রেশন থেকে আনা একটু চাল, জল, দুপুররাতে খাওয়ার পর মাছের কাঁটা বিড়াল-কুকুরদের, ভাতের ফ্যান গরুদের দিলে মনে খুবই শান্তি ও আনন্দ বয়ে যায়, ব্যক্তিগত আয়নায় মুখ দেখে দেখে মলিনতার দিনে এসব যে কোথায় খুইয়ে ফেললাম।
উঠোনের একটু বেড়ার ধারে ঘৃতকুমারী, পাথরকুচি, তুলসী, কালমেঘ, দুব্বো, বাসক, থানকুনি লাগিয়ে রাখলে বন্ধুর মতো কাজ অসুখবিসুখে। গাছই চিনতে পারছি না আমরা এখন, পাখিডাক আলাদা করতে পারি না।
নিজের হাতে লাগানো গাছে ফুল-ফল এলে চোখে জল আসে। নারকেল, আম, কাঁঠাল বাজারে বেচলে সংসারে পয়সা আসে।
বন্ধু-পরিজন, আত্মীয়দের ফলপাকুড় দিলে খুব আনন্দ হয়। গাছে গাছে পাখি, উঠোনে বিড়াল, মাছ কুটছে মা, লেবুবনে লেবু গড়াচ্ছের দিবসরজনী থেকে আমরা নিজস্ব গুহা রচনা করলাম।
এমন কালো দিনের হাওয়া বুঝতে পারলাম তখন, যখন থেকে গান গেয়ে ভিক্ষা নিতে আসা মানুষজন কমে যেতে লাগল। আমরা খেদিয়ে দিতে শুরু করলাম ওদের।
একটাই প্রার্থনা, এই মা-বাবা গাছপালা-পশুপাখির মায়া থেকে আমরা যেন সরে না আসি।
২
বাজারের মতো আশ্চর্য জিনিস আর হয় না, একথা বলেছি, ঘুরে ঘুরে তাজা ফসল, কাঁচা তরকারি, টাটকা মাছ, শিশিরলাগা ডিম দেখলে ভারি আনন্দ হয়।আনন্দের ভেতর একটু গভীর করে কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যায়, কত কত না-বলা কথার স্রোতশব্দ।নিজস্ব জীবনের বাইরের তুক মন ছেয়ে ফেলে।আত্মগর্বে, গ্লানিতে ফুলে ওঠা হৃদয়কে নত গাছ হতে শেখায় বাজার। বিশেষ করে সকালবেলার বাজার। তাই বাজার নিয়ম করে সময় নিয়ে করা উচিত, কত আন্তরিক গল্প যে লুকিয়ে থাকে, একটি শোনাই।
আমাদের দাঁইহাট বাজারে মাছ-বিক্রেতারা বেশিরভাগই পুরুষ। মহিলা আছেন মাত্র জনা পাঁচ-ছয়। ভোররাত থাকতে রওনা দেয় বাড়ি থেকে। এদের একজনের কাছে প্রায় দিনই মাছ নিই। নাম জানি না। বাড়ি বোধহয় ঘোড়ানাশ কিংবা চান্ডুলি গ্রামের পানে।
হাতে শাঁখা নেই, পেতলের চুড়ি পরা, তাতে সেফটিপিন, মলিন শাড়ি, জল ঘেঁটে ঘেঁটে হাত কালিয়ে গেছে, অল্প অল্প হাজা, হাসপাতালে চোখ দেখিয়ে চশমা নিয়েছে তবে পরতে ভুলে যায়।
তার সঙ্গে আমার সুখদুঃখের কথা হয় টুকটাক। আমি বলি,
মাসি, কালকের শোলটা খুব ভালো ছিল গো খেতে।
সে বলে, হতেই হবে, ও যে আড়তে কেনা নয়, ডোবা থেকে ধরা।
আমি জলে হাত চুবিয়ে কানকো উল্টে বলি, তুমি আজ একটু তেলওয়ালা সিলভার কাপ দাও, ছ'পিস করবা।আর ভালো তেলাপিয়া। পোড়াব। রাতে ফিস্টি।
সে ঠোঁট উল্টে বলে, দিচ্ছি খোকা। কিন্তু মাছপোড়া আর মদে ফিস্টি হবে বুঝি?
আমি হেসে বলি, তোমার যেমন কতা, বেলা হলো, দাও দাও মাছ কুটে দাও, আট টাকা করে শ নেবা...
কিছুদিন মাসি বসেনি বাজারে। আজ এসেছে কিছুদিন পর। জ্যান্ত কয়েকটা পোনার ছা জল নেড়ে নেড়ে টাটকা রাখছে। পাশে সাদা পলিথিনের কাপে চা, তার উপরে ঢাকা দেওয়া লেড়ো।
মাসিকে জিজ্ঞেস করি, কী গো, ক'দিন আসোনি কেন?
সে বলে, ছেলেটা চলে গেল, শ্রাদ্ধশান্তি চুকতে দেরি হলো তাই, নাও নাও আজ ভালো বাটা আছে।
ছেলের মৃত্যুখবর ও বিক্রি করতে আনা মাছের সজীবতা বলার মাঝে কোনও ফাঁকা রাখল না এই জননী। তার পোড়া পেট তাকেই চালাতে হয়, চালাতে হবে। আজ এই সজল লোনা বৃদ্ধা মিষ্টি জলের মাছেদের ছা বাঁচাচ্ছে যতক্ষণ পারা যায়, তাতে পয়সা। পেটের ছেলেটি চলে গেল অকালে। রোগে।
আমি কোনও ক্রমে কিছু ভোলা কিনে পালিয়ে এসেছিলাম। ভাবি, ওই শোকতাপের হাত, তারা দেখে ফল খাওয়া হবিষ্য হাত, সন্তান-অশৌচ পার করা হাত এখন কীভাবে কত দুঃখপুকুর পার করে দাঁড়িপাল্লা ধরছে, খুচরো গুনছে, দর কষছে...
এই গল্পবীজ, এই আন্তরিক মানুষের কথন নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। বাজারহাটে ঘুরে, পথে পথে বেরিয়ে একটু মানুষের কথা শুনলে, পাশে চুপ করে বসলেই আমরা বাঁচিয়ে ফেলতে পারব এইসব সত্যি বেঁচে থাকার কথনবিশ্ব।