বর্ণময় জীবন পর্দার 'সিধুজ্যাঠা'-র || তাঁর বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন সত্যজিতের নায়িকা
গায়ে লাল শাল। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পক্ককেশ এক বৃদ্ধ রাশি রাশি বইয়ের মধ্যে কিছু একটা খুঁজছেন। বইটা খুলতে দেখা গেল তাতে নানা আকৃতির খবরের কাগজের কাটিং তাতে সাঁটা। এরপরে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা-পরিহিত সেই বৃদ্ধ অবলীলায় বলে দিলেন, কোথায় কবে ‘ভণ্ড সাধু ও অপগণ্ড চ্যালা’-র সঙ্গে ড. হাজরার প্রথম টক্কর হয়েছিল। এই দৃশ্য বঙ্গজনের স্মৃতিতে গেঁথে আছে এখনও। ফেলু মিত্তিরের মতো ঝানু গোয়েন্দাকেও বলতে হয়, "ভাগ্যিস আপনি গোয়েন্দা হননি, তাহলে কিন্তু আমাদের পসার থাকত না।" বাঙালির আদি গুগল এই সিধুজ্যাঠাকে কিছুটা শার্লক হোমসের দাদা মাইক্রফটের আদলে গড়েছিলেন সত্যজিৎ, এবং ‘সোনার কেল্লা’-র সেই কাল্ট হয়ে যাওয়া চরিত্র-চিত্রায়ণ করেছিলেন হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। সিধুজ্যাঠা হোক বা 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর বরফি, বাঙালির মনে তাঁর অমলিন উপস্থিতি। “তুমি গোয়েন্দাগিরি করছ, মানুষের মনের অন্ধকার দিকটা নিয়ে তোমার কারবার, কিন্তু তাই বলে নিজের মনটাকে অন্ধকার হতে দিও না ফেলু”- বাঙালির কানে এখনও বাজে এই সংলাপ, তবে সিধুজ্যাঠার আড়ালে আসল মানুষটা বাঙালির যৌথ স্মৃতি থেকে নীরবে সরে গিয়েছেন বহুকাল।
১২৪ বছর আগে আজকের দিনটিতে তেলেঙ্গানায় জন্মেছিলেন হরীন্দ্রনাথ। ২ এপ্রিল, ১৮৯৮। সেই পরাধীন ভারতের প্রথম ডিএসসি, অর্থাৎ বিজ্ঞানে ডক্টরেট অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র হরীন্দ্রনাথ। অঘোরনাথের আরেকটা পরিচয় ছিল। তিনি সরোজিনী নাইডুর পিতা। হরীন্দ্রনাথের দিদি সরোজিনী স্বনামে ভারতখ্যাত। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি হিসেবে উপস্থিতি- সর্বত্র সরোজিনীর কৃতিত্ব এখনও উজ্জ্বল। দাদা বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের বামপন্থী রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ। সর্বহারার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে ১৯২০ সালে মস্কো পাড়ি দেন। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও হয়েছিলেন। রাশিয়াতেই মৃত্যু হয় তাঁর। এমনই ছিল হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার। বাবা বিজ্ঞান গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে পূরাতন ধাঁচে কবিতা লিখছেন, এই নিয়ে দিদির সঙ্গে তাঁর সে কী তর্ক! সরোজিনী শেষমেশ বাবাকে বললেন, “বাবা, কবিতার থেকে বড় বিজ্ঞান আর কিছু নেই, বুঝলে!” বাবা হেসে মেয়েকে জবেব দিলেন, “পাগলি, বিজ্ঞানই তো শ্রেষ্ঠ কবিতা রে!” এই মান-অভিমান খেলার ছলে দর্শনচর্চার ফাঁকে হরীন্দ্রনাথের বড় হয়ে ওঠা। কাজেই এই চর্যা যে তাঁর রক্তে থাকবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
আরও পড়ুন-‘ফ্যাসিবাদের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, তাই ব্যারিকেড’ || কথাবার্তায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়
তাঁর যখন মাত্র বছর দশেক বয়েস, তখন ক্ষুদিরামের ফাঁসির ঘটনা তাজা। বাঙালি যুবমনের গহিনে সেই ঘটনা ছাপ ফেলেছিল। ওই বয়সেই হরীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘ডায়িং প্যাট্রিয়ট’, ইংরেজিতে একটি পূর্ণ কবিতা। পারিবারিক পরম্পরার কারণে অবশ্যই অত্যন্ত কম বয়সে তাঁর প্রতিভা আলোকপ্রাপ্ত, তবে প্রতিভা যে তাঁর বহুমুখী, সেকথা অস্বীকার করা যায় না। পরের বছর তাঁর রচিত নাটক 'আবুল হাসান' মঞ্চস্থও হয়। সেই নাটক করে যে টাকা ওঠে, তার সম্পূর্ণটা এগারো বছর বয়সি হরীন্দ্রনাথ দান করেন অ্যানি বেসান্তের 'ন্যাশনাল এডুকেশন ফান্ড'-এ।
কবিতা লেখার চর্চা এসবের মধ্যেই জারি ছিল। ১৯১৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ফিস্ট অফ ইউথ’ প্রকাশিত হয়। পরের বছরই বাল্যবিধবা কৃষ্ণা রাওকে বিবাহ করেন হরীন্দ্রনাথ, যদিও ভারত তাঁকে চিনত কমলাদেবী নামেই। হরীন্দ্র তখন কেমব্রিজে পড়ছেন। ডক্টরেট না হলে কেমব্রিজে গবেষণা করার অনুমতি দেওয়া হয় না। কিন্তু হরীন্দ্র তখন জনপ্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর কবিতার প্রশংসা করছেন। কাজেই সে নিয়ম হরীন্দ্রর ক্ষেত্রে খাটল না। কেমব্রিজ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করল। ফিৎজউইলিয়াম কলেজে উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তাঁরই সহায়তায় 'ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন'-এর বেডফোর্ড কলেজে ভর্তি হলেন কমলাদেবী। ক্রমে কমলাদেবীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে সারা ভারতে। সাংবাদিকতায় র্যামন ম্যাগসেসে পাবেন, পদ্মভূষণ-পদ্মবিভূষণ পাবেন। হস্তশিল্প ও তাঁতশিল্প সংরক্ষণের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে উঠবেন লন্ডনের এই রিসার্চ স্কলার।
হরীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক জীবনও নেহাত হেলাফেলার নয়। গান্ধীজি যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, তখন দেশে ফিরলেন হরীন্দ্র। আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর ওতপ্রোত যোগ ছিল। হিন্দি ও ইংরেজিতে আন্দোলনের জন্য বহু গান লিখেছেন, গেয়েছেন। এমনকী, ‘শুরু হুই জং হামারি’ গানটি গাইবার জন্যে ৬ মাসের জেল হয়েছিল। ছিল গণনাট্য ও 'প্রগতি লেখক সঙ্ঘ'-এর সঙ্গে ছিল আত্মিক যোগ। নেহরু তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। মূলত নেহরুর চেষ্টাতেই রাষ্ট্রপতি-নির্বাচিত লোকসভা সদস্য হন তিনি। লোকসভার চরম উত্তেজিত বাগযুদ্ধের পরিস্থিতি হাস্যরসে স্নিগ্ধ করে আনতেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে হরীন্দ্রনাথের সখ্য ছিল। যাঁদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সূকর্ণ অন্যতম।
আজীবন সাহিত্যের চর্চা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। বিদেশে থাকাকালীন ‘ইন্ডিয়ান ম্যাগাজিন’, ‘ব্রিটেইন অ্যান্ড ইন্ডিয়া’-র মতো পত্রিকা তাঁর লেখা ছাপত। ১৯২৯-এ লিখছেন 'তুকারাম' নামে আরেকটি নাটক। মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত সন্ন্যাসী-কবির জীবন এর উপজীব্য। দেশজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাঁকে এই নাটকটি। কবিতা লিখেছেন অজস্র। 'দ্য ম্যাজিক ট্রি' (১৯২২), 'পোয়েমস্ অ্যান্ড প্লেজ' (১৯২৭), 'স্ট্রেঞ্জ জার্নি' (১৯৩৬), 'দ্য ডার্ক ওয়েল' (১৯৩৯), 'এজওয়েস অ্যান্ড দ্য সেইন্ট' (১৯৪৬), 'লাইফ অ্যান্ড মাইসেলফ' (১৯৪৮), 'মাস্কস অ্যান্ড ফেয়ারওয়েল' (১৯৫১), 'স্প্রিং ইন দ্য উইন্টার' (১৯৫৬), 'ভার্জিনস্ অ্যান্ড ভাইনইয়ার্ড' (১৯৬৭)— তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম। একই সঙ্গে বহু হিন্দি ছায়াছবির গান লিখেছেন। অশোক কুমারের সঙ্গে ‘আশীর্বাদ’ ছবিতে গানও গেয়েছিলেন। ১৯৪৪-এ 'ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ' কলকাতায় তাঁর একটি একক অনুষ্ঠান আয়োজিত করে। সেখানে একাই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ও কবিতা আবৃত্তি করেন হরীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন-প্রিয় রবিবাবু থেকে ভানুদাদা, ঠিক কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ ও লেডি রাণুর সম্পর্কের ভিয়েন
হরীন্দ্রনাথ যখন অভিনয়ের জগতে পা রাখলেন, তখন তাঁর বয়স ৬৪ বছর। গুরু দত্ত প্রযোজিত 'সাহেব বিবি অউর গুলাম'-এর সেই বিখ্যাত ঘড়িবাবু। বিমল মিত্রর সেই বিখ্যাত চরিত্র। যার বাড়িতে অজস্র ঘড়ি, এবং সেই বয়ে চলা সময়ের কথা যে বাকিদের মনে করিয়ে দিতে থাকে বারংবার। গল্পের শেষে গুঁড়িয়ে যায় প্রাসাদ, মারা যায় ঘড়িবাবু। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাচ্চাদের জন্য ছড়া লিখেছেন হিন্দিতে। ‘গল্প হলেও সত্যি’ অবলম্বনে যখন ‘বাওর্চি’ করলেন হৃষিকেশ, সেখানে দাদুজির ভূমিকায় দেখা গেল তাঁকে। নিজের গুষ্ঠিকে সদা গালাগাল দেওয়া অশীতিপর এক বৃদ্ধ। ‘আশীর্বাদ’, ‘রাত অউর দিন’, ‘তেরে ঘরকে সামনে’, ‘চল মুরারী হিরো বননে’, ‘গৃহপ্রবেশ’-এর মতো হিন্দি ছবিতে অভিনয় অরেছেন চুটিয়ে। বাংলা সিনেমায় এক সত্যজিৎ-এর ছবিতেই অতিথি অভিনেতা হিসেবে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। প্রতিটি চরিত্র স্বাতন্ত্রের দাবি রাখে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ সেই বোবা জাদুকর বরফি, যে তিড়িংবিড়িং লাফায়, আর মন্ত্রঃপূত করে রাখে রাজাকে। সেই দুরন্ত চরিত্র থেকে ফেলু মিত্তিরের সিধুজ্যাঠার রঙিন অভিনয়! বাংলা ছবিতে সেই তাঁর শেষ অভিনয়। এর আগে ‘সীমাবদ্ধ’-র বরেণ রায়ের গল্পও ভোলার নয়। সাহেবদের কাছে বিশেষ অনুমতি চেয়ে শ্যামলেন্দুকে নিজের নাইটহুড পাওয়ার গল্প শোনায় বরেণ। মুখে আঁটা পাইপ, আর থেকে থেকে মিটিংয়ের মাঝেও ঘুমিয়ে, মহিলা দেখলে উচ্ছ্বসিত হয়ে– সেই চরিত্রের সার্কাজম অনবদ্য। উপনিবেশের ফাঁপা পেট বাজিয়ে সেই চরিত্র আওয়াজ দেয় ‘ভদ্র’ সমাজকে। আর এই সব চরিত্রেই সাবলীল হরীন্দ্রনাথ।
এ হেন হরীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অস্বস্তিকর ব্যবহারের অভিযোগ এনেছিলেন অভিনেত্রী পারমিতা চৌধুরী, ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে যিনি শ্যামলেন্দুর স্ত্রী দোলনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অরুনেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘পরশ মানিক’ বইয়ে প্রকাশিত তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে অরুনেন্দ্র পারমিতাকে হরীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চাইলে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন পারমিতা। তাঁর বয়ানে, “মিথ্যে বলব না, প্রথমে ওঁকে আমার মোটেই ভালো লাগেনি। একদিন আমি সোজা মানিকদার কাছেই গিয়ে বলেছিলাম, ‘মানিকদা, ওঁকে আমার একদম ভালো লাগছে না।’” স্পষ্ট বলেছেন পারমিতা, ‘Physically close’ হওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। বারবার হরীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ আচরণে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতেন অভিনেত্রী। যদিও সত্যজিৎ পারমিতাকে বুঝিয়ে বলেন, কোথাও একটা বুঝতে ভুল হচ্ছে। হারিনবাবু খুব মজার মানুষ, পরিশীলিত মানুষ। কিন্তু তখনও ‘ঘাড়ে এসে পড়া’ নিয়ে অস্বস্তি ছিলই পারমিতার। তিনি আবারও সত্যজিৎকে বলেন, “দয়া করে ওঁকে একটু restrained হতে বলুন।” কিন্তু পরে তিনি বলেন, “কিন্তু I was too used to be physically approached. তাই বোধহয় আমি ওঁকে ভুল বুঝেছিলাম।” হরীন্দ্রনাথ চমৎকার মানুষ ছিলেন বলেই শেষ অবধি ধারণা হয়েছিল তাঁর।