Cow politics: গরু নিয়ে রাজনীতি, হত্যার পরিকল্পনা বারবার, একদিনে হয়নি...

পেহলু খান কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। গত কয়েক বছরে খবরের ট্রেন্ড বলে দিচ্ছে, গো-হত্যাকারী এবং গরু পাচারকারী সন্দেহে গণপ্রহার এবং খুনের ঘটনা নির্বিচারে বেড়েছে। কেন আবার গো-রাজনীতির কথা সামনে এল?  


সারা দেশ ইদের উৎসবে মাতোয়ারা। মধ্যপ্রদেশের সিওনি জেলা সাক্ষী থাকল নির্মম ঘটনার। গো-হত্যার অভিযোগে দুই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রহার করে ১৫-২০ জনের উন্মত্ত জনতা। গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটে কুরাই থানা এলাকায়। থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন ব্রজেশ বাট্টি। তাঁর অভিযোগ, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলের সদস্যরা লাঠি নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। অতিরিক্ত পুলিস সুপার এস. কে. মারাভি জানিয়েছেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ২ জনের মৃত্যু হয়। এঁদের দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে। পুলিস জানিয়েছে, খুনের মামলা দায়ের হয়েছে। অতীতের ঘটনা কি প্রমাণ করে না যে, এ নিছক পুলিসের দায়সারা অবদান! পেহলু খানের ঘটনা নিয়ে এত তোলপাড় হয়েছে, তারপরে কোথায় কী! ইনসাফ রসাতলে! বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে গেছে। 


পেহলু খান হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছ’জনকেই বেকসুর খালাস করে রাজস্থানের একটি জেলা আদালত। ২০১৭-র ১ এপ্রিল পশুমেলা থেকে গরু কিনে ফেরার পথে আলওয়ারে স্বঘোষিত গোরক্ষকদের হাতে আক্রান্ত হন পঞ্চাশোর্ধ্ব পেহলু খানু। দু’দিন পর হাসপাতালে মারা যান তিনি। এরপর দু’বছর ধরে সেই মামলার শুনানি চলে আলওয়ার জেলা আদালতে। প্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত ছ’জনকে মুক্তি দেন অতিরিক্ত জেলা বিচারক সরিতা স্বামী। তাঁর পরিবার উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বললেও, অন্য খবরের মতো পেহলুও খবরের ভিড়ে হারিয়ে যান। যদিও মধ্যপ্রদেশের ঘটনা আবার খুঁচিয়ে তুলল তাঁর নাম। 
পেহলু খান হত্যার সময় রাজস্থানে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। কিন্তু এরপর সেখানে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। গণপিটুনির ঘটনা রুখতে রাজস্থান বিধানসভায় নয়া বিল পাশ করিয়েছে তারা। তাতে গণপিটুনির ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন সাজার কথা বলা হয়েছে। জরিমানা ধার্য হয়েছে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। তাই পেহলু খান হত্যা মামলায় অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে যাওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়তে হয় কংগ্রেসকেও।

আরও পড়ুন: ভারতে গণহিংসার সম্ভাবনা ঠিক কতটা, কেন সিঁদুরে মেঘ দেখছে আন্তর্জাতিক মহল?


আবারও বলছি, পেহলু খান গো-রাজনীতির নির্মম পরিণতির কোনও ব্যতিক্রমী নাম নয়। খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। গত বছর, গরু পাচারকারী সন্দেহে ত্রিপুরায় তিন ব্যক্তিকে গণপ্রহার করা হয়। এর জেরে মৃত্যু হয়েছে এই তিন ব্যক্তির। মৃত তিন ব্যক্তির নাম জায়েদ হুসেন (২৮), বিলাল মিঞা (৩০), শাফিউল ইসলাম (১৮)। মৃত ব্যক্তিরা ত্রিপুরার শেফালিজলা জেলার সোনামুড়ার বাসিন্দা। ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিস জানায়, গ্রামবাসীরা এদিন কয়েকজনকে খোয়াই জেলার চম্পাহোয়ারে গাড়ি করে পাঁচটি গরু নিয়ে পালাতে দেখে। গরুগুলিকে দেখে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারে যে এই গরুগুলি গ্রাম থেকে চুরি গিয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে। এরপরই সেই তিন ব্যক্তিকে আটকানোর চেষ্টা করে তারা। তবে তারা সেই গাড়িটিকে থামাতে ব্যর্থ হয়। পরে গাড়িটিকে ১০ কিলোমিটার দূরে উত্তর মহারানিপুরে আটকায় ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা। সেখানে জায়েদ হুসেন এবং বিলাল মিঞা গণপ্রহারের শিকার হন। এর আগে মুঙ্গিয়াকামিতে শাফিউল ইসলামকে ধরে ফেলেছিলেন গ্রামবাসীরা। সেখানে তাঁকে আক্রমণ করা হয়।


পরে পুলিস তাঁদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আগরতলায় রেফার করা হয় তাঁদের। সেখানে নিয়ে আসা হলে ডাক্তাররা তাঁদের মৃত বলে ঘোষণা করেন। ঘটনায় দু’টি পৃথক মামলা দায়ের হয়। মৃতদেহগুলি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় ঠিকই, তবে এই ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যায় আগের সব ঘটনার মতোই। 


ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, গো-রাজনীতি থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে পারে না কংগ্রেসও। গরু নিয়ে রাজনীতির কলঙ্ক একটি দলের ঘাড়ে অবশ্যই চাপানো যেতে পারে। কারণ সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, গোমাতাকে রক্ষার নামে তাণ্ডব চালাচ্ছে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। যার পরিণতি নির্মম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে, বাকি সবাই পরিস্রুত তুলসী পাতা কি? নিশ্চয় মনে আছে, কংগ্রেস রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীক ছিল জোড়া বলদ। তার পর পার্টিতে ভাঙন ধরল। ইন্দিরা গান্ধী প্রমাণ করলেন যে, তিনি ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ (বধির কন্যা) নন, তিনি একজন বিচক্ষণ নেত্রী। জোড়া বলদ প্রতীক পেল আদি কংগ্রেস। ইন্দিরা গান্ধী দূরদর্শী ছিলেন। তিনি ভেবে দেখলেন, জোড়া বলদ প্রতীকটা বড়ই পিতৃতান্ত্রিক। তাছাড়া পারিবারিক দৃষ্টিকোণ একটু আনলে ভালই হয়। তাই তিনি প্রতীক নিলেন গাই-বাছুর। গরুতে ছাপ দিয়ে ভোট হয় তাই বহু যুগ ধরে। অনেক পরে এসেছিল হাত। 


আরও একটু আগের ইতিহাস। ব্রিটিশরা বলে সিপাহি বিদ্রোহ, আমরা বলি আমাদের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ। ১৮৫৭ সালে সেই বিদ্রোহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের প্রচলন। গরুর চর্বি মেশানো কার্তুজ দাঁতে কেটে বারুদ ভরতে হত, ফলে হিন্দু সিপাহিরা ধর্মনাশের আশঙ্কায় বিদ্রোহ করে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মঙ্গল পান্ডে। 


গরু রাজনীতির ছোঁয়াচ যে আমাদের রাজ্যে আসেনি, তা জোর গলায় বলার উপায় নেই। কারণ অতীতে একসময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, “(আমি) ইফতারের আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছি। এর জন্য কেউ যদি বলেন, মমতা মুসলিমদের তোষণ করে— তাঁরা বলতে পারেন। আমি বলি, যে গরু দুধ দেয় তার লাথিও একটু আধটু খেতে হয়। যে ডাকবে আমি যাব।” তৃণমূল নেতা জাভেদ খান একসময় তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতার রাস্তায় গরুর গাড়ি বের করেছিলেন। এসব কিন্তু গরু নিয়ে অহিংস ভোট বাক্সের রাজনীতি। সাম্প্রতিক কালে গরু নিয়ে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়েছে গোহত্যা এবং গোমাংস ভক্ষণ। যার পরিণতি মানুষ খুন। এর চেয়ে নির্মম বোধহয় আর কিছু হতে পারে না!

More Articles