৪১ শ্রমিকের এই পুনর্জন্ম আসলে 'মিরাকল্'! কেন প্রকৃতিকেই সমস্ত কৃতিত্ব দিচ্ছেন আর্নল্ড?

Uttarkashi Tunnel Rescue Operation: যত দিন কাটছিল, ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল ততই। গোটা দেশের মানুষ যেন একমনে প্রার্থনা করছিল একটা মিব়্যাকেলের।

১৭ দিন মাটির নিচে অন্ধকারে কাটানোর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখলেন উত্তরকাশির সুড়ঙ্গে আটকে থাকা ৪১ জন শ্রমিক। এ যেন পুনর্জন্ম। এই উদ্ধারকাজে জান-প্রাণ লড়িয়ে দিয়েছিলেন হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী। উত্তরাখণ্ডের পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল তো ছিলেই, তার সঙ্গে সেনা, এনডিআরএফ এমনকী বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল একাধিক বিশেষজ্ঞ দল। এত বড় উদ্ধারকাজ আগে দেখেনি দেশ। এই উদ্ধারকাজের জন্য বিদেশ থেকে ডেকে আনা হয়েছিল সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্স। সুড়ঙ্গের খুঁটিনাটি তাঁর জানা। কোন পথে উদ্ধারকাজ এগোলে বিপদের আশঙ্কা বেশি, ঝুঁকি কম কোন পথে, এ সবই তাঁর ঠোঁটস্থ। কিন্তু তার পরেও বারবার প্রকৃতির কাছে নতজানু হতে দেখা গিয়েছে আর্নল্ডকে। পাহাড়ের মতো বিরাট এক শক্তির কাছে বিনত হয়েছেন, প্রার্থনা করেছেন শ্রমিকদের মুক্তি। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বারবার সেই কথাই বলতে শোনা গিয়েছে আর্নল্ডকে।

গত ১২ নভেম্বর ধস নামে উত্তরকাশির সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গের ভিতরে সে সময় কাজ করছেন ৪১ জন নির্মাণশ্রমিক। ধসের জেরে ওই অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরেই আটকা পড়েন তাঁরা। তাঁরা যে ওই সুড়ঙ্গে আটকা পড়েছেন, সেই খবর বাইরের পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল কঠিন ব্যাপার। তবু তা ঘটেছে। শেষমেশ বন্দি শ্রমিকদের আর্তস্বর পৌঁছয় বাইরের পৃথিবীর কাছে। শুরু হয় উদ্ধারের তোড়জোর।

আরও পড়ুন: ১২ নভেম্বর সুড়ঙ্গ ভাঙার সময় ঠিক কী ঘটেছিল? ১৭ দিন পর মুক্তি পেয়ে জানালেন শ্রমিক

উদ্ধারকাজে কোনও রকম খামতি রাখেনি কোনও পক্ষই। সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে জল, খাবার ও ওষুধপত্র। পাঠানো হয়েছে অক্সিজেন। সব রকম ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনোর। কিন্তু প্রকৃতি বড় বালাই। কাজে যতবার দু-পা এগিয়েছেন উদ্ধারকারীরা, ততবার প্রকৃতির ভ্রূকূটিতে উদ্ধারকাজ পিছিয়ে গিয়েছে দু-ধাপ। কখনও ফের নেমেছে ধস। কখনও বা ধ্বংসস্তূপ সরানোর জন্য আনা মার্কিন খননযন্ত্র বিকল হয়ে বেড়েছে নতুন বিপদ। নানা পদ্ধতি, নানা উপায় বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবু হাল ছাড়েননি উদ্ধারকারীরা। ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে পৌঁছনো হয়েছে শ্রমিকদের কাছে।

যত দিন কাটছিল, ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল ততই। গোটা দেশের মানুষ যেন একমনে প্রার্থনা করছিল একটা মিরাকল্-এর। উদ্ধারকারী যাঁরা, যাঁরা শ্রমিক, যাঁরা আরও ৪১ জন শ্রমিকভাইয়ের প্রাণ বাঁচাতে দিন রাত এক করেছেন, রক্তজল করেছেন, তাঁরাও কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক সর্বশক্তিমানের। ওই সুড়ঙ্গের সামনে তৈরি করা হয়েছিল এক অস্থায়ী মন্দির। ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে ওই মন্দিরের কাছে এসে মাথা নুইয়েছেন উদ্ধারকারী প্রতিটা মানুষ। প্রার্থনা করেছেন, তারা যেন ওই ৪১জন মানুষকে বাঁচাতে সফল হন। যে যার ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করেছেন, যাতে সুস্থ দেহে ফিরে আসে ঘরের ছেলেরা ঘরে। সুড়ঙ্গের বাইরে খালি পেটে দাঁড়িয়ে থেকেছেন বাবা, তাঁর আল্লার কাছে উপবাস করে প্রার্থনা করেছেন সমস্ত ছেলেদের কুশলমঙ্গল। সুড়ঙ্গ থেকে যোজন দূরে বসে সুড়ঙ্গে বন্দি সমস্ত সন্তানদের জন্য মন্দিরে মানত করেছেন কোনও এক মা।

Expert Arnold Dix After Tunnel Rescue Arnold Dix, who became a familiar sight at the rescue site during the course of the long-drawn operation, said the successful rescue of the trapped workers was a "miracle"

যে দেশ আখলাকদের পিটিয়ে মারে বা রাগ বা ক্ষোভের বশে মন্দির জ্বালিয়ে দেয়, সেই দেশ সব কিছু ভুলে প্রার্থনা করেছে সুড়ঙ্গে বন্দি ৪১ জন শ্রমিকের জন্য। ওই ৪১টি প্রাণের প্রার্থনার গুলিয়ে গিয়েছে ধর্মীয় ভেদাভেদ, বৈষম্য। মঙ্গলবার বিকেলে যেন এক অন্য ছবি দেখেছে ভারত। সুড়ঙ্গে বন্দি শ্রমিকদের মধ্যে নানা রাজ্যের নানা ধর্মের বাসিন্দারা ছড়িয়েছিলেন। তাঁদের উদ্ধারে যাঁরা এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম, কেউ বা দলিত। কেউ এসেছেন বিহার থেকে তো কেউ রাজস্থান, কেউ বা উত্তরপ্রদেশ। কেউ বা সুদূর আমেরিকা কিংবা থাইল্যান্ড। সকলের যৌথচেষ্টার ফল মিলেছে হাতেনাতে।

ভারতীয় সংস্কৃতি, তাদের ঠাকুর-দেবতার সঙ্গে দূরদূরান্তের কোনও সম্পর্ক নেই আর্নল্ডের। কিন্তু সেই সর্বশক্তিমানের উপর নির্ভর করেছেন তিনি। ভরসা করেছেন, সর্বশক্তিময় যে প্রকৃতি, তার কাছে সুবিচারের। তাই উদ্ধারকাজ শেষ হতে না হতে আর্নল্ড ছুটে যান সেই অস্থায়ী মন্দিরে। প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানান এই সাফল্যের জন্য। আগেই আর্নল্ড জানিয়েছিলেন, যখনই ওই ৪১ জন শ্রমিক বেরোবেন সুড়ঙ্গ থেকে, সেটাই সকলের কাছে ক্রিসমাস। আর্নন্ডের কথা ফলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। এ বছর ক্রিসমাস তাড়াতাড়ি এসেছে। শ্রমিকেরা সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়ে আসছেন যখন একে একে, বাইরে তখন আতসবাজির রশনাই।

Expert Arnold Dix After Tunnel Rescue Arnold Dix, who became a familiar sight at the rescue site during the course of the long-drawn operation, said the successful rescue of the trapped workers was a "miracle"

জেনেভার আন্তর্জাতিক টানেলিং অ্যান্ড আন্ডারগ্রাউন্ড স্পেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আর্নন্ড। তিনি নিজে একজন অধ্যাপকও বটে। আর্নল্ড জানিয়েছেন, এ এক আশ্চর্য অভিযান ছিল, যেখানে সকলে, যাঁরা যাঁরা উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে অভূতপূর্ব। ভারতের সেরা ইঞ্জিনিয়াররা এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন। এই টিমের অংশ হতে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন আর্নল্ড। অবশ্য তিনি না থাকলে আদৌ এই ৪১ জন শ্রমিক আলোর মুখ দেখতে পেতেন কিনা সন্দেহ। তার পরেও আর্নল্ড জানিয়েছেন, মঙ্গলবার যা ঘটেছে, সবটাই মিব়্যাকেল। প্রকৃতি না চাইলে, পাহাড় না চাইলে ফেরা হত না ওই ৪১ শ্রমিকের।

আরও পড়ুন:“স্নান করে নিস কিন্তু” : সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসা বাংলার শ্রমিককে বললেন মা

আসলে মানুষ যুগ যুধ ধরে প্রকৃতির উপরে প্রভূত্ব কায়েম করার চেষ্টা করেছে। নিজের সুবিধা মতো তাকে ব্যবহার করেছে। প্রকৃতি মাঝেমধ্যে এভাবেই তার বদলা নেয়। উত্তরাখণ্ড থেকে হিমাচল বা সিকিম, বারবার সেই প্রমাণ দিয়েছে সর্বশক্তিমান। ইচ্ছামতো গড়ে নেওয়া রাস্তা, সুড়ঙ্গ, নদীবাঁধ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকে বারবার এভাবেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে সে। আসল ক্ষমতাবান সেসব ঘটনায় নিজের পিঠ বাঁচিয়ে নেয় , কিন্তু তাঁর বলি হয় ওই ৪১ জন শ্রমিকের মতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। এই ঘটনা আসলে তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

 

More Articles