সংসার চালাতে করেছেন ঝাড়ুদারের কাজও, কীভাবে রাতারাতি ম্যাজিক ম্যান হয়ে উঠলেন রিঙ্কু
Rinku Singh : শেষ ৫ বলে চাই ২৮ রান, পরপর ৫ বলেই ছক্কা মেরে কে জেতালেন বাজিগর রিঙ্কু
গ্যালারি ভর্তি দর্শকের ভিড়, টানটান উত্তেজনা। যদিও পাল্লাটা বেশ ভারী একদিকে। ম্যাচের আগাম সমীক্ষা প্রায় ঘোষণা করে দিয়েছে ফলাফল। শেষ ওভার, জয়ের জন্য তখনও বাকি ২৯টা রান। দলের সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বলা ভালো, হেরে যাওয়ার শেষ প্রমোদ গুনছেন। এমনকী ধারা ভাষ্যকারও ধরে নিয়েছিলেন গুজরাট দলের জয় আসন্ন। তবুও নিয়মমাফিক শুরু হল শেষ ওভার। প্রথম বলে উমেশ যাদব এক রান নিয়ে স্ট্রাইক ছেড়ে দিলেন রিঙ্কু সিংকে। গুজরাট টাইটান্স দল অবশ্য ততক্ষণে ধরে নিয়েছিল জয় শুধু আর ৫ বলের অপেক্ষা। কিন্তু এই এত টালমাটাল পরিস্থিতি, এত উত্তেজনার মধ্যেও একমাত্র স্থির ছিলেন একজনই। তখন অবশ্য কেউই বুঝতে পারেননি এই স্থির চোখের আড়ালেই ছিল গনগনে আঁচ। এক্কেবারে চুপিসাড়ে মরণ কামড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কেকেআর -এর রিঙ্কু সিং। যশ দয়াল নিজেও ভাবতে পারেননি তাঁর করা পরবর্তী পাঁচটি বলের ফলাফল কী হতে পারে!
প্রথম বল, ছক্কা হাঁকালেন রিঙ্কু। কলকাতার দল এবং সমর্থকেরা অনেকক্ষণ পর একটু উত্তেজিত হলেন। কিন্তু জয় তো তখনও অনেক দূর। যশ দয়ালও ভাবলেন বলের ধরনটা একটু বদলে ফেললেই হল, ম্যাচ তো হাতের মধ্যেই রয়েছে। পরবর্তী বল, আবার ছয়। রিঙ্কু সিংয়ের শান্ত চোখে যেন আগুন জ্বলছে। ওভারের চতুর্থ বল, ফের ছয় মারলেন রিঙ্কু। মুষড়ে পড়া নাইট বাহিনী এতক্ষণে যেন ফের চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। রিঙ্কুর ওই আগুন রাঙা চোখ দিয়ে তারাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছে। যশ দয়ালও এবার খানিক ঘাবড়ে গিয়েছেন। গুজরাট দল নিজেদের মধ্যে আরও একবার আলোচনা সেরে নিচ্ছেন, আর মোটেই সহজ ভাবে নেওয়া যাচ্ছে না রিঙ্কুকে। গ্যালারি থেকে শুরু করে টিভির পর্দা দর্শকদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। শেষ দুই বল, জয়ের জন্য দরকার আর মাত্র দশ রান। তবে কি সত্যিই কোনও ম্যাজিক হতে চলেছে? মুহূর্তের মধ্যেই যেন ঘটে গেল সেই ঘটনাটা। এক্কেবারে সিনেমার দৃশ্য। শেষ দুই বলেই ফের ছক্কা হাঁকিয়ে শেষ রাতের বাজিগর হয়ে উঠলেন রিঙ্কু সিং।
আরও পড়ুন - আইপিএল মানেই গ্যালারি জুড়ে সেই ভেঁপুর মিউজিক! বিখ্যাত সুরটির পেছনে রয়েছে কোন ইতিহাস?
রবিবার, ছুটির দিন। সকালে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া, তারপর ভাত ঘুম সেরে বাঙালি এক্কেবারে তৈরি ছিল টিভির সামনে। নির্ধারিত সময়েই বেগুনি রঙা পোশাকে মাঠে নেমেছিল কলকাতার নাইটরা। মুখোমুখি লড়াইয়ে সওয়ার ছিল গুজরাট দলও। প্রথমে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে ২০ ওভারে চার উইকেটে ২০৪ রান তোলে গুজরাট। রানের ধাক্কাটা অবশ্য প্রথম থেকেই খানিক তাড়িয়ে বেরিয়েছিল কেকেআর-কে, যার জের সামলাতে বেশ খানিকটা সময়ও কেটে যায়। কেকেআর-কে ফের ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন বেঙ্কটেশ আইয়ার এবং নীতীশ রানা। কিন্তু আইয়ার আউট হওয়ার পর ১৭ তম ওভারে রশিদ খানের হ্যাটট্রিকে কেকেআরের হাত থেকে ম্যাচ প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল। পরপর তিন বলে আউট হন আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারিন এবং শার্দুল ঠাকুর।
কিন্তু তখনই কেই বা জানত আসল কারিগর হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অন্য একজন। রিঙ্কুও অবশ্য প্রথম থেকে কিছুতেই ঠিক টাইমিং করে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পাঁচ বছর ধরেই কেকেআর দলে রয়েছেন তিনি, অথচ মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছেন হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র। গ্রিনরুমের গ্যালারিতে বসে কেবল ম্যাচগুলিকে অনুধাবন করে গিয়েছেন ছেলেটি। আর স্বপ্ন দেখেছেন একদিন মাঠে নেমে নায়ক হয়ে ওঠার। তার সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যে এমন অপূর্ব হতে পারে তেমন ধারণা ছিল না কারোরই। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল থেকে নাইট রাইডার্স শিবিরে আছেন তিনি। প্রথম চার মরশুমে ৮০ লাখ টাকার চুক্তিতে দলে ছিলেন। তার ঘরোয়া পারফরম্যান্সের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, কেকেআর তাকে আইপিএল ২০২৩-এর আগে অকশনে ফের ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে দলে সামিল করে।
সোনার চামচটা অবশ্য কোনওদিনই মুখে ছিল না রিঙ্কু সিংয়ের। মধ্যবিত্ত নয়, বরং বলা ভালো, নিম্ন বিত্ত পরিবারে জন্ম তাঁর। ১৯৯৭ সালে উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে খানচাঁদ সিং-এর পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ভবিষ্যতের বাঁ-হাতি ব্যাটার রিঙ্কু। ছোট থেকেই অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছে তাঁর জীবন। ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম তো দূর, দুবেলা দুমুঠো অন্ন পর্যন্ত জুটত না তাঁর। বাবা খানচাঁদ সিং বাড়ি বাড়ি গ্যাস সিলিন্ডার বিলি করে কোনওক্রমে সংসার চালাতেন। গ্যাস এজেন্সির স্টোরেজ কম্পাউন্ডে ছোট ছোট দুটি ঘর, আলুথালু স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশেই চার ভাই-বোন ও মা-বাবাকে নিয়ে ছিল রিঙ্কুর সংসার। যদিও এতো অভাব সত্বেও স্বপ্ন হাতড়ে বেড়িয়েছেন তিনি আজীবন। ব্যাটে বলে উড়ান দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ওই পরিবেশে থেকেই। একটু বড় হওয়ার পর সংসারের অভাব যখন চরমে তখন রিঙ্কুর দাদা বাধ্য হয়েই ভাইকে ঝাড়ুদারের কাজে ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু এতেও তাঁর ২২ গজে খেলার স্বপ্নকে ধামাচাপা দেওয়া যায়নি কিছুতেই। সেই স্বপ্ন নিজের মতো করেই ডাল পালা মেলেছে বিস্তর।
আরও পড়ুন - রঙিলা আইপিএল এবং ভারতীয় ক্রিকেটের বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ
হাজার প্রতিকূলতাকে সঙ্গে করেই নিজের খেলাকে চালিয়ে যান রিঙ্কু সিং, ক্রিকেটেই যেন ছিল তাঁর একমাত্র মুক্তির স্বাদ। একবার দিল্লিতে একটি স্থানীয় টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য তিনি একটি মোটরবাইক জেতেন। আর এই ভালোবাসা এবং খেলার জেদের প্রকৃত ফল মেলে ১৭ বছর বয়সে। উত্তরপ্রদেশের রাজ্য দলে ডাক পান। এরপর ২০১৬ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। ২০১৭ সালে আইপিএল-এ পাঞ্জাব কিংস তাকে দলে নিলেও মাঠে নামার সুযোগ দেয়নি। আর তার দু’বছর পরই নাইট শিবিরে সুযোগ। কেকেআর-এর জার্সি গায়ে চাপিয়ে আর্থিক সংকট কাটালেও মানসিক শান্তি পাননি রিঙ্কু। খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য বারবার নেট মাধ্যমে ট্রোলড হতে হয়েছে তাঁকে।
আর এই সমস্ত ট্রোলডই তাঁর প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠে, আর তার সঙ্গে যোগ হয় তাঁর এতদিনের লড়াই এবং ওই পরিবেশ থেকে বেড়ে ওঠার জেদ। নিজেকে যেন খুব আড়ালে, খুব সন্তর্পনে সজ্জিত করে তুলেছিলেন রিঙ্কু। যার সবটুকু হিসেব কড়ায় গন্ডায় দর্শকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন গত রাতের শেষ পাঁচটি বলে।গুজরাটের মাটিতে রাতারাতি ম্যাজিক ম্যান হয়ে উঠেছেন ছাপোষা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেটি। আজ অবশ্য সে তারকা, রাতারাতি বদলে গিয়েছে চারপাশের পরিস্থিতি, কেবল বদলায়নি রিঙ্কু সিংয়ের মধ্যে থাকা প্রকৃত মানুষটা। যে মানুষটা কেবল জানে লড়াই করতে, যে মানুষটার কাছে জীবনের সব জয়ের নেপথ্য কেবল তাঁর লড়াকু পরিবারের প্রতিচ্ছবি। তাই হয়তো এতো উত্তেজনার মধ্যেও স্থির তিনি। আসলে শেষ রাতের যে পাঁচটি বল তিনি মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন, সেই প্রতিটাতেই লেখা রয়েছে এতদিনের লড়াইয়ের গল্প এবং আগামীর জন্য আরও আরও অনেক সম্ভাবনার খতিয়ান।