ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণ থেকে চামড়ার জটিল রোগ নিরাময়, সস্তার জামের গুণ জানলে জুড়বেনই ডায়েটে
হজমের দোষ থেকে ব্লাড সুগার, এমনকি ব্রণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে জাম। শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখে এমনকি নানা রকম চোখের অসুখেও উপকারী জাম। সালাদ, জুস বা স্মুথিতেও আজকাল জাম ব্যবহার করা হয়।
দক্ষিণ বাংলার কথাসাহিত্যের কল্যাণে যে কয়টি ফল গোটা বাংলায় পরিচিতি লাভ করেছে জাম তাদের মধ্যে অন্যতম। সেখানে বাগান মানেই আম, জাম, কাঁঠালের বন। গাছ গুলি পরিমাণে অন্যান্য গাছের তুলনায় একটু বেশিই দেখা যায় এ অঞ্চলে। সেটা তাদের অত্যধিক ফলনের জন্যেও হতে পারে, আবার যে কোনও পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার জন্যেও হতে পারে। এলাকা বিশেষে সচেতন ভাবে মানুষের বাগান করার সংস্কৃতির সঙ্গেও ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকায় এই ফলগুলি চোখে পড়ে বেশি। লক্ষ্যনীয়, কুল এতখানি ‘কৌলিন্য’ পায়নি। যাই হোক, জাম মূলত পাম গোত্রীয় ফল। ‘ব্ল্যাক পাম’ও বলা হয় একে। বাড়ির জামগাছ থেকে জাম পাড়ার বিশেষ দক্ষ লোক থাকত এককালে। সেই জাম নুন মাখিয়ে খানিক রেখে তারপর তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া। কষা ভাব তখন আর থাকত না। কিন্তু আপনারা কি জানেন এই ফল পুষ্টিগুণে ভরপুর? আসুন আজ জেনে নেওয়া যাক।
জাম ঠিক গরমের ফল না। বর্ষাকালের গোড়ার দিকে জাম পাকতে শুরু করে। হজমের দোষ থেকে ব্লাড সুগার, এমনকি ব্রণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে জাম। শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখে এমনকি নানা রকম চোখের অসুখেও উপকারী জাম। সালাদ, জুস বা স্মুথিতেও আজকাল জাম ব্যবহার করা হয়।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
জামে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে, যা উচ্চরক্তচাপের আশঙ্কা কমায়। জাম রক্ত পরিষ্কার করে, এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখে।
ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণ
জামে জাম্বোলনা নামে একটি ডায়াবিটিস-রোধী উৎসেচক থাকে। এই উৎসেচক রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। জামের বীজ শরীরে ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়ায়। জামের বীজেও মধুমেহ নিয়ন্ত্রিত হয়। জাম টাইপ টু ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগও কমানোর ক্ষমতা রাখে। এই রোগে বারবার তেষ্টা পায়, বারবার মূত্রত্যাগ করতে হয়।
আরও পড়ুন-আমেরিকার বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় এই নিরামিষ ভারতীয় আইসক্রিম
ওজন কমাতে সাহায্য করে
জামে প্রচুর পরিমানে ফাইবার থাকে। এছাড়া এই ফলে ক্যালোরিও কম, শরীরের কোথাও জল জমলে তাও কমাতে সাহায্য করে। এইসব নানা কারণে জাম ওজন কমানোর জন্য আদর্শ ফল।
হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি
আপনার যদি হজমের সমস্যা থাকে, জাম খান। এই সমস্যায় জামে উপকার পাবেন। প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি থাকে এই ফলে, যা নানা রকম পেটের রোগ (বাতরোগ, বাওয়েল স্পাজম এবং পেট খারাপ জাতীয়) সারাতে সাহায্য করে। পাকস্থলীতে অনেকক্ষণ থাকে এই ফল। পেট ব্যাথা নিরাময়েও এর তুলনা নেই। ব্যথা নিরাময়ের ক্ষেত্রেও জামের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। হজম জনিত ব্যাথা বা আর্থেরাইটিসের ব্যাথায় জাম খাওয়া খুবই উপকারী।
ত্বকের যত্ন
এই ফলে থাকা অ্যাস্ট্রিজেন্ট চামড়ায় ব্রণ জাতীয় সমস্যার প্রবণতা কমায়। জামে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে যা ত্বকের নিজস্ব টেক্সচার বজায় রাখতে সাহায্য করে। ত্বকের দাগ, বয়েসজনিত ভাঁজ ইত্যাদি লক্ষণ কমাতে সাহয্য করে। ত্বকের প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিদিন জাম খাওয়া অকালবার্দ্ধক্য জাতীয় রোগ কমাতে সাহায্য করে।
হার্টের স্বাস্থ্য
জামে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পটাসিয়াম জাতীয় মিনারেল থাকে। ফলে জাম আর্টের স্বাস্থ্যও ভালো রাখতে সাহায্য করে।
মুখের স্বাস্থ্য
জামের ব্যাক্টিরিয়া প্রতিরোধের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে জাম মুখের নানা রকম ইনফেকশন, দাঁতের রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। দাঁত ও মাঁড়ি সুস্থ রাখার জন্যে জামের ব্যবহার অতি পুরনো। জামপাতায় থাকা অ্যাস্ট্রিজেন্টও গলার নানা সমস্যার জন্যে উপকারী।
ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট এবং হেলথ হ্যাবিটাটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রাচি শাহ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “গরমের সময় জাম ম্যাজিকের মতো কাজ করে। জামের ওজনের ৮৪ শতাংশই জল। ফলে শরীর ঠাণ্ডা তো করেই, ডিহাইড্রেশন এবং হার্ট-স্ট্রোকের প্রতিরোধেও সাহায্য করে। প্রচণ্ড গরমের জ্বালা জুরাতে এ ফলের তুলনা নাই, তাছাড়া ফসফরাস, আয়োডিন, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়াম–রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদান। গরমে প্রচণ্ড ঘাম হলে কী হয়, আমাদের শরীর থেকে জল, ইলেকট্রোলাইট–এ গুলো ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে থাকে। ফলে শরীরে নানা রকম অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সেখানে জাম জল এবং ইলেকট্রোলাইট—দুইয়েরই জোগান দেয়।” তিনি আরো বলেন, “এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। ফলে ক্রনিক অসুখ এবং হজমের অসুখে বেশ কাজে দেয় জাম। প্রচুর ফাইবারের জন্য অনেকক্ষণ পেট ভরে থাকে জাম খেলে, খিদে পায় না, এই কারণে ওজন কমাতেও সাহায্য করে জাম। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকায় আপনার ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায় জাম। ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। মধুমেহ, চর্মরোগ, হাঁফানি, পেট ব্যাথা, বাতরোগ ইত্যাদি নানা ধরনের অসুখে জাম ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হত।”
জামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বায়োঅ্যাক্টিভ ফাইটোকেমিক্যালস তথা নানা পলিফেনোলিক যৌগ এবং ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে। এ সম্বন্ধে প্রাচী শাহের মত, “গবেষণায় দেখা গিয়েছে জামের অ্যান্টি-ক্যান্সার এবং কেমো-প্রতিরোধের গুণাগুণ রয়েছে। এবং ক্যান্সার, হার্ট এবং লিভারের অসুখের চিকিৎসায় ব্যবহার করে অত্যন্ত সুফল পাওয়া গিয়েছে। এতে আয়রন রয়েছে প্রচুর। যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী, বিশেষত অ্যানিমিয়ার রুগীদের এই ফল নিয়মিত খাওয়া উচিত। এই আয়রনের প্রাচুর্যের জন্যই জাম রক্ত পরিষ্কার করে, লোহিত রক্ত কণিকা বাড়ায়, এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।”