হেমন্ত, বিষণ্ণ আঁধারে এক অশরীরি উৎসব
Hemanta and Halloween : হ্যালুইন আর ভূত চতুর্দশী মিলিয়ে হেমন্তকাল যেন বিবিধ ভূতের উৎসবের জন্যই দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
এখনও শীত আসেনি। বাতাসে তার আঁচটুকু লেগেছে মাত্র। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে ধীরে। ইংরেজিতে একে বলে 'twilight, অর্থাৎ, সন্ধিপ্রকাশের কাল। জন মেসফিল্ড হলে এ সময়ের বর্ণনায় লিখতেন,
“Twilight it is, and the far woods are dim, and the rooks
cry and call.
Down in the valley the lamps, and the mist, and a star over all,
There by the rick, where they thresh, is the drone at an end,
Twilight it is, and I travel the road with my friend.”
এমন সময়ে ধৈবত জমে ভালো। পূরবীর কোমল ধৈবত। টোড়ির জাগরণ নেই তাতে। আছে শুধু সন্ধ্যাপূর্ব বিষণ্ণতা। এ বিষণ্ণতাকে ঘিরেই বাঙালির জীবনে আস্ত একটা ঋতু গড়ে উঠেছে। নাম তার হেমন্ত। বঙ্গজীবনের সকল ঋতুরই কোনও না কোনও পরিচিতির তকমা আছে। তার বসন্ত জুড়ে থাকে দোল আর কাফির বন্দিশ,
“দেখো আলী হোরি খেলত, নন্দলাল রে,
সঙ্গ লীনি আপনি কায়ী গোয়াল বাল রে।”
তার গ্রীষ্মের সিংহাসনের থাকে পয়লা বৈশাখ আর তার রাবীন্দ্রিক আহ্বান। কিন্তু হেমন্ত তার কাছে যেন কেমন পরিচিতিহীন। তার হাল হকিকত কতকটা সৌর জগতের এককালীন নবম গ্রহ, প্লুটোর মতো। থেকেও নেই। 'আশ্বিনের শারদপ্রাতের' কোলাহল কেটে গেলে এই বাতিলের পরিচয় নিয়ে হেমন্ত আসে, তারপর একসময় নিশ্চুপে জায়গা করে দেয় শীতকে। কেউ তার খোঁজ রাখে না। যেন বাতাসে মিহি কুয়াশার আস্তরণ সাজানোতেই হেমন্তের দায়িত্ব শেষ।
আরও পড়ুন- হেমন্তে ছিল আলো তৈরির পাঠশালা! কালীপুজোর প্রদীপ যেভাবে তৈরি হত হাতে হাতে
পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে এ সময় মহা হট্টগোল। হ্যালুইন উৎসবের আনন্দ। মধ্যযুগের আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বাস করতেন সেলটিকরা। অনেকে মনে করেন তাঁদের 'সামহাইন' উৎসব থেকেই হ্যালুইনের সূচনা। এ উৎসবের মধ্যে দিয়েই শুরুয়াদ হতো শীতের। হ্যালুইন ছিল আঁধারের উৎসব। হিন্দু বাঙালিদের ভূত চতুর্দশীর মতোই সে উৎসবেও নাকি প্রেতলোক থেকে পৃথিবীতে নেমে আসত রাশি রাশি আত্মা। তবে 'তিন শতকের শহর' কলকাতার আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা আত্মাদের জাগিয়ে তুলতে হ্যালুইনের বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না।
কার্ল মার্ক্স তাঁর 'কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার'-এর শুরুতে লিখছেন,
“A specter is haunting Europe - the specter of communism.”
'Specter' এর আক্ষরিক অনুবাদ যদি হয় ভূত, তবে তাতে এসে পড়ে অতীত প্রসঙ্গ। যে শহর শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অবিচল। উন্নয়নের ঘোর লাগা চোখে যে প্রতিনিয়ত তার আশেপাশের মফসসলগুলিকে গ্রাস করছে, তার খাসজমিনে যে অতীতের ভূত সদা বর্তমান- এ কথা নতুন করে বলে দিতে হয় না। কাকতালীয়ভাবে, হেমন্তের সঙ্গে ভূত শব্দটা যেন বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়েছে। হ্যালুইন আর ভূত চতুর্দশী মিলিয়ে হেমন্তকাল যেন বিবিধ ভূতের উৎসবের জন্যই দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কাজেই, হেমন্তকে হয়ত অনায়েসে অন্ধকারের ঋতু আখ্যা দেওয়া চলে।
অন্ধকারে মিশে থাকে শীতের আবেশ। সে আবেশ ডানায় মেখে এক হেমন্ত রাতেই ওল্ড পার্ক স্ট্রিট কবরখানার দিকে উড়ে যায় চোক্তারদের পূর্বপুরুষ, বৃদ্ধ দণ্ডবায়স। সে সব রাতে কবরখানায় স্লিম্যান ও শেরউড সাহেবের মধ্যে বাঁধে ধুন্ধুমার ডুয়েল। দণ্ডবায়সের উপর তার রেফারিংয়ের দায়িত্ব এসে পড়ে। তবে এ রঙ্গমঞ্চের কুশীলব দণ্ডবায়স একা নন। সঙ্গে আছেন তাঁর ইতিহাসখ্যাত সঙ্গিনী, বেগম জনসন। এ শহর বেগম জনসনকে মনে রাখেনি। দণ্ডবায়সরূপী দাঁড়কাকও আজ তার কাছে উদ্বৃত্ত।
ওল্ড পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি হয়ে আরও বেশ খানিকটা দক্ষিণের দিকে এগোলেই চেতলা ব্রিজ। তার একধার ঘেঁষে 'কেউ নেই শূন্যতা'-র মতো পড়ে থাকে ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশান। সেখানে তখন হেমন্তকালীন কার্নিভাল। কালীপুজো উপলক্ষে জড়ো হয়েছে শয়ে শয়ে রংবাজ ভূত। এমন চিত্রই পাওয়া যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের 'কাঙাল মালসাট' উপন্যাসে। কে নেই সেই শ্মশান উৎসবে? উনিশ শতকের দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল। নকশাল আমলের খোঁচড়। আর বেপাড়ার অদ্ভূতুড়ে সব মাস্তান। তাঁদের নামের কতই না রকমফের। জগা, ভানু, মংলা, ভুতনি, টালি, লন্ডন।
আরও পড়ুন- অশুভ আত্মা তাড়ানোর উৎসব! হ্যালোউইনের অজানা গল্প জানলে শিউরে উঠতেই হবে
এ উৎসব তো শুধু মৃত্যুর নয়। জীবিতেরাও সেখানে উপস্থিত। হাবিলদারদের পাল্লায় পড়ে টালিগঞ্জ থানার ওসিকেও সেদিন ভূতেদের সঙ্গে বসে মদ্যপান করতে হয়। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ যেমন হেমন্তে এসে মিশে যায়, ঠিক তেমনভাবেই কালীপুজো মিলিয়ে দেয় প্রেতলোক আর জীবলোককে। এছাড়া শহুরে বাঙালি প্রেতলোকের খবর বিশেষ রাখে না। অথচ তার শহরেই রয়েছে প্রেতলোকের বেশুমার বাসিন্দা। এই ভূতের শহরের উপর দিয়েই তো একসময় কত কিছু বয়ে গিয়েছে। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, একটি মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এক শতাব্দীর কত শত আন্দোলন আর পরিকল্পিত গণহত্যা।
আজ থেকে ৫২ বছর আগে ১২ অগাস্ট দুপুরেও উত্তর কলকাতার কাশীশ্বর চ্যাটার্জি লেন বা ভোলানাথ স্ট্রিটের বাসিন্দারা জানতেন না রাতে ঠিক ঘটতে চলেছে। সেদিন রাত নামতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল, কংগ্রেসের সদস্যরা স্রেফ দা, কাটারি দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিল একাধিক নকশালকে। সে হত্যালীলা চলেছিল দু'দিন ধরে। তারপর একসময় ইতিহাসের পাতায় থেকে গেল কাশীপুর-বরাহনগর গণহত্যার কাহিনি হয়ে। যে বারুদ সেদিন নিষিদ্ধ ইস্তেহার হয়ে গণ্ডারের চামড়ার চেয়েও পুরু কলকাতার মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল, তার খোঁজেই পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে এসেছিল 'যুদ্ধ পরিস্থিতি'-এর রণজয়। সেও এক হেমন্ত সন্ধ্যায়। একসময় যাদবপুর অঞ্চলে যে সমস্ত রাইফেলকে সে শীতঘুমে পাঠিয়েছিল, তাদের উদ্ধার করতেই হবে তাকে। সেদিনও ছিল কালীপুজোর রাত। দিকে দিকে বিস্ফোরণের শব্দ। যেন যুদ্ধ লেগেছে শহরে। যে যুদ্ধ জোয়ারে গা ভাসিয়েই সত্তর-একাত্তর সালে একদল মানুষ অন্য অনেকের মতো পড়াশুনো ছেড়েছিলেন। কিন্তু অভ্যুত্থানের ক্ষত শুকিয়ে যাওয়ার পর আর পাঁচজন শখের বিপ্লবীর মতো তাঁরা বিদেশ পালাতে পারেননি। সে সামর্থ্য তাঁদের ছিল না। এঁদের না ছিল কফি হাউস, না ছিল মায়কভস্কি। কেউ এঁদের মৃত্যুতে ইন্টারন্যাশনাল গায়নি কোনওদিন। অতীতের রাইফেল আগলাতে আগলাতে একদিন 'যুদ্ধ পরিস্থিতি'-র সেই বৃদ্ধ ইস্তিরিওয়ালা হয়ে উঠলেন তাঁরা। তারপর রণজয়রা বাউন্ডুলের মতো এ পথ সে পথ ঘুরে পাতালঘরের গোপন অস্ত্রাগারের সন্ধান করলে পরাজিত গলায় তাদের একটি উত্তরই দিতে পারলেন, “ওর উপর বাড়ি উঠে গেছে। সব ফ্ল্যাটবাড়ি। কিচ্ছু নেই।”
আসলে হেমন্ত শুধুই বিষণ্ণতার গল্প বলে না। সে তার বুকে বিস্তর অস্ত্রও লুকিয়ে রাখে। যে সব অস্ত্র আর কোনওদিন জাগবে না। বা হয়তো কালের ফেরে জেগে উঠবে একদিন। কে বলতে পারে?