হাসপাতালের বেডে শুয়ে মিনিট পাঁচেকে 'পলাতকে'র গানে সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত
কিছুক্ষণের মধ্যে সুর দিয়ে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল হেমন্তের। শোনা যায় দিনে তিন চারটে গানে সুর দিতে পারতেন। প্রত্যেকটাই হিট।
ভি. শান্তারামকে প্রযোজক হিসেবে পাওয়াটা তরুণ মজুমদারের জীবনের একটা মাইলস্টোন বলা চলে। বাংলা সিনেমা প্রযোজনা করতে রাজি বম্বের রাজকমল কলামন্দির, ভাবা যায়! তাও আবার 'পলাতক'-এর মতো একটা ছবি। নায়ক অনুপ কুমার। সবার প্রবল আপত্তি ছিল। পরিচালকের জেদের জেরে সে সব ধোপে টেকেনি। মনোজ বসুর 'আংটি চাটুজ্যের ভাই' তাঁর হাতে পড়ে যখন চিত্রনাট্য হয়ে উঠল, তখন দেখা বেশ কিছু অদলবদল হয়েছে গল্পে। নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কোনো মুখ পরিচালক চাইছিলেন না বাউণ্ডুলে চরিত্রটির জন্য। এমনকি ছায়াবাণীর অসিত চৌধুরী, যিনি পরে নিউ থিয়েটার্সের বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্-এর সদস্য হবেন, তিনি পর্যন্ত উত্তমকে নিয়ে এ ছবি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন পরিচালককে। রাজি হননি তরুণ মজুমদার। অবশেষে কাকতালীয় ভাবেই ভি.শান্তারাম স্ক্রিপ্টটা শুনে ফেলেন। এবং শুনতে শুনতে চোখে জল এসে যায় তাঁর। রাজকমল কলামন্দির সমস্ত দায়িত্ব নেবে, বলে দেন পরিচালককে। তরুণ বাবু হতভম্ব। এসেছিলেন অন্য একটা কাজে, জুটে গেল স্বপ্নের ছবির প্রযোজক। শুধু তাই নয়, আন্নাসাহেবের হাত ধরেই তরুণ মজুমদার এমন এক বন্ধুর সন্ধান পেলেন, যাঁর সঙ্গে আগামী পঁচিশ বছর জুটি বেঁধে কাজ করবেন তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বম্বতে হেমন্ত্ কুমার। 'পলাতক'-এর সূত্রেই এক দীর্ঘ বন্ধুত্বের পথচলা শুরু। পরিচালক এবং সঙ্গীত পরিচালকের এত দীর্ঘ জুটি বিশ্বসিনেমার ইতাহাসে আছে কিনা সন্দেহ।
হেমন্ত এবং তাঁর দুই বন্ধু সমরেশ রায় ও পরিমলবাবুকে নিয়ে নিউ থিয়েটার্সেরই একটা ঘরে বসলেন তরুণ মজুমদার। শেষদিন অবধি এই ঘরেই ছিল তাঁর অফিস। তা নিউ থিয়েটার্সের সেই ঘরে বসেই আড়াই ঘণ্টা ধরে চিত্রনাট্য শুনলেন হেমন্ত। প্রচুর তারিফ টারিফ করে গেলেন। পরিচালক এক প্রকার নিশ্চিন্ত। হঠাৎ সেদিন বিকেলে ফের পরিচালকের ঘরে হেমন্তের আবির্ভাব। 'বসুন বসুন' আপ্যায়ন পরিচালকের।
—না। বসতে আসিনি। একটা ব্যাপারে মাপ চাইতে এসেছি। বলেই চলে যাব।
—মাপ? মানে?
—অনেক ভেবে দেখলাম, আপনার ছবির মিউজিক দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
শুনে পরিচালকের মাথায় হাত। বলে কী! সকালেই অত তারিফ করে গেল। এটুকু সময়ের মধ্যে এমন কী ঘটল। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, স্ক্রিপ্ট খুবই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আবহসঙ্গীত এবং নেপথ্যসঙ্গীত যেহেতু পুরোটাই ফোক বেসড্, অর্থাৎ মেঠো ধরনের, আর সে ব্যাপারে হেমন্ত নিতান্তই 'মাটো', তাই ছবির যাতে ক্ষতি না হয়, তিনি সরে যেতে চান। উঠে চলেই যাচ্ছিলেন। ডেকে তাঁকে থামান পরিচালক। বহুরকম ভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে অবশেষে রাজি করানো যায় তাঁকে। সামান্য ঘটনা। কিন্তু মনে রাখা দরকার, সে সময় মুম্বাই পর্যন্ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে একডাকে চিনত লোকজন। পোস্টারে তাঁর নাম থাকলেই ছবি আদ্ধেক হিট। সেই ব্যক্তিত্ব কী পরিমাণ নিরহংকার হলে এত সাবলীলভাবে নিজের খামতির কথা স্বীকার করতে পারেন! যাই হোক, রাজি তো হলেন, এবার নতুন সমস্যা দেখা দিল। গানগুলো লিখবে কে? হেমন্ত একবার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম তুললেন বটে, কিন্তু পরিচালকের ইচ্ছে আনকোরা কাউকে দিয়ে গানগুলো লেখানোর। অবশ্যই হেমন্তের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আপত্তি করলেন না হেমন্ত। বললেন একটু ভেবে জানাবেন।
ইতিমধ্যে দুজনেই বম্বে এসেছেন। সেখানেই গান নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। পরিচালক উঠেছেন হোটেল ডি লা মেয়ারে। চার্চগেট আর মেরিন ড্রাইভের মুখোমুখি। একদিন লাঞ্চের জন্য রিসেপশনে চাবি জমা দিতে গেছেন, দেখলেন এক শার্ট-ট্রাউজারস পরা ভদ্রলোক রিসেপশনিস্টের কাছে তরুণ মজুমদারের খোঁজ করছেন। টালিগঞ্জের বৃহৎ চিত্রনাট্যে এই প্রথম মুকুল দত্তের প্রবেশ। মুকুল দত্তের নাম হয়তো এখন অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর কাজ বিস্মৃত হওয়া সম্ভব নয়। যতদিন বাংলা সিনেমা নিয়ে চর্চা থাকবে, বারংবার ফিরে আসতে হবে মুকুল দত্ত রচিত গানগুলির কাছে। তবে আপাতত মুকুল দত্ত বিখ্যাত নন। তরুণ মজুমদারকে নমস্কার করে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, 'হেমন্তদা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।' জানা গেল ভদ্রলোক টুকটাক গান লেখেন, তেমন কিছু না। পরিচালক নতুন কাউকে খুঁজছিলেন বলে হেমন্ত ওঁকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেমন লেখেন সেটা তো বাজিয়ে দেখতে হয়! স্ক্রিপ্টের সিচুয়েশনগুলো শুনতে চাইলেন মুকুলবাবু। পুরো চিত্রনাট্যটাই পড়ে শোনালো হল। পরেরদিনই একটা কাগজ নিয়ে হাজির ভদ্রলোক।
'আহা, কৃষ্ণ কালো আঁধার কালো
আমিও তো কালো সখি,
তবে কেন আমায় ভালোবাসলে না?
ভালোবেসে মরণ ভালো
আমিও তো মরিতে চাই…'
পরিচালক অবাক হয়ে মুকুলবাবুর দিকে চাইলেন। মুকুল দত্ত নিরুত্তাপ। ভালো না লাগলে অন্য কিছু লিখে আনবেন। লাফিয়ে উঠলেন তরুণ মজুমদার। ভালো না লাগলে মানে? এমনটাই তো চাইছিলেন তিনি। এক্ষুণি হেমন্তকে শোনাতে হয়। বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরতে যাবেন, মুকুল বাবু মানা করলেন। হেঁটে যাবেন। অতটা পথ? পাগল নাকি। তখন জানা গেল হেমন্ত বাসায় নেই, নার্সিংহোমে ভর্তি। অ্যাকিউট স্পন্ডেলাইটিস। ট্র্যাকশন নিয়ে শুয়ে আছেন। দশ মিনিটের হাঁটাপথ নর্থ কোর্ট নার্সিংহোম। সেখানেই হাজির দুইমূর্তি। কাগজে হিজিবিজি লেখা আর অজস্র কাটাকুটি দেখে হেমন্ত বললেন, 'ফেয়ার করে আনোনি?' সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই ফেয়ার করা হল। কাগজটা শূন্যে তুলে নিয়ে কয়েকবার চোখ বোলালেন। পরিচালকের উৎকণ্ঠা চরমসীমায়। এত ভালো গানটা যদি পছন্দ না হয়! চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট কী যেন ভাবলেন হেমন্ত। তারপর শুয়ে শুয়েই গেয়ে উঠলেন সেই বিখ্যাত গান—'আহা, কৃষ্ণ কালো আঁধার কালো'। অন্তরা, সঞ্চারী, দ্বিতীয় অন্তরা পেরিয়ে একটানে গোটা গান শেষ। নার্সিংহোমের ঘর সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। পরিচালক এবং মুকুল দত্ত, দুজনেই বাক্যহারা। কয়েক মিনিটে অমন হিট গান নির্মাণের সাক্ষী রইল নর্থ কোর্ট নার্সিংহোমের সেই ঘরটি।
কিছুক্ষণের মধ্যে সুর দিয়ে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল হেমন্তের। শোনা যায় দিনে তিন চারটে গানে সুর দিতে পারতেন। প্রত্যেকটাই হিট। বিকাশ রায়ের 'মরুতীর্থ হিংলাজে'র গান তৈরির সময়েও এমনটা ঘটেছিল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখে কাগজটা হেমন্তের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। দু-তিনবার চোখ বুলিয়ে হারমোনিয়াম টেনে নিলেন হেমন্ত। দু একটা রিডে প্যাঁ পোঁ করে সরাসরি গাওয়া শুরু—
"তোমার ভুবনে মা গো এত পাপ
এ কী অভিশাপ
নাই প্রতিকার—"
পলাতকের তিনটি গান—'মন আমার কেমন কেমন করে', 'দোষ দিয়ো না আমায় বন্ধু ', 'জীবনপুরের পথিক রে ভাই' তিনদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই হলেন হেমন্ত। অথচ প্রথাগত কোনো শিক্ষা ছিল না। সারা জীবন এ নিয়ে নানা কথাও শুনতে হয়েছে। অথচ সুরের ওপর আশ্চর্য দখল। তেমনই ইশ্বর প্রদত্ত গলা, ও দরদ লাখে একটা মেলে হয়তো। তবে গায়ক পরিচিতির নিচে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনার অসামান্য প্রতিভা অনেকটাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল—এও সত্য।
আরেকদিন তুমুল বৃষ্টি। অফিসের জানলা দিয়ে পরিচালক তাঁর প্রিয় গুলঞ্চ গাছটির দিকে তাকিয়ে আছেন। বৃষ্টির তোড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে গাছটার শরীর। অঝোরে বৃষ্টি, হাতে চা। আলগা চুমুক। এমন সময়ে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ এল। এই দুর্যোগে আবার কে এল! ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকলেন হেমন্ত। পরিচলক অবাক। হেমন্তের যেখানে বাসা, মানে লেকের দিকটা পুরোপুরি জলের তলায়। সেই জল ঠেলে বৃষ্টি কাঁধে এসেছেন ভদ্রলোক! 'আপনার এখানে কেউ আছে?' এসেই প্রশ্ন। তরুণ জানালেন, তিনি ছাড়া আর কেউ আসেননি আজ। 'ঠিক আছে' বলে বেরিয়ে গেলেন হেমন্ত। কিছু বোঝার আগেই ফের নিজের হারমোনিয়ামটা নিয়ে হাজির। চৌকির ওপরে জিনিসটা নামিয়ে লাজুক গলায় বললেন, 'এমন বাদলা! একটু গান গাইতে মন চাইল। তাই, মানে—'। পিছনে সেই খোলা জানলা, বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ। কেঁপে কেঁপে উঠছে গুলঞ্চ গাছ। প্রচণ্ড হাওয়ার দাপটে দু একখানা ফুলে ঝরে পড়ছে। আর পরিচালকের মুখোমুখি বসে একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছেন হেমন্ত। হেমন্ত কুমার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কখনও 'লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে', কখনও 'ওরে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি', আবার কখনও 'কল্যাণ হোক তব কল্যাণী'। যেন বাস্তব মহাকাব্য লেখা হয়ে চলেছে এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে। সেইসব দিন!
আর মুকুল দত্তের কথা না হয় আরেক দিন হবে। যুবকটি যখন তখন গান বাঁধতে পারে। মেয়েটি স্নান সেরে ফেরার পথে পড়ে যায় তার সামনে। প্রমাণ চায়, নইলে বিশ্বাস করবে না। গা থেকে তার টুপটাপ জল ঝরছে। ফুলেশ্বরীর একটি দৃশ্য। সেই দৃশ্যের উদ্দেশ্যে যিনি লিখতে পারেন, 'টাপুর টুপুর বৃষ্টি ঝরে কোন সে আকাশ থেকে / ও আমার কমলিনী শিহরিয়া যায়!", তিনি এক নিজস্ব গল্প দাবি করেন, নিজের কলম-জোরেই।
তথ্যঋণ-
সিনেমাপাড়া দিয়ে (দু খণ্ড), তরুণ মজুমদার, দে'জ প্রকাশনী