কুয়াশার ভিতর তিনি ধ্যানে ডুবে থাকেন

Late Autmn : অমাবস্যার রাতে কালীপূজা। গ্রামের দু-প্রান্তে 'হুলা' জ্বালিয়ে 'ধো-মশা' করতে করতে ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেরোয়।

মা লক্ষ্মী মা কী বললেন ?
--খামার খলা চাঁছতে।
মা লক্ষ্মী মা কী বললেন ?
--বড়্ শিকল বাঁধতে।
মা লক্ষ্মী মা কী বললেন ?
তুমি চল আগু আগু, আমি যাচ্ছি পিছুপিছু।

আশ্বিন সংক্রান্তির দিন জিহুড় পরব। গৃহস্থ বাগাল (রাখাল) মালিক-কৃষকের ধানখেতে শাল-ডালে শালুক বেঁধে গেড়ে দিয়ে গৃহস্থে ফেরে। ফিরে এসে দরজার আড়ালে সে বসলে, গিন্নি মা তাকে উপরের তিনটি প্রশ্ন করে। সে তার উত্তর দেয়। হেমন্তের শুরুতে এভাবেই লক্ষ্মীর আগমন বার্তা বাগাল-বাহিত হয়ে আসে। কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে যেভাবে লক্ষ্মী প্যাঁচা উড়ে আসে গৃহস্থ ঘরের পাশে। মঙ্গলশঙ্খ বাজে, উলু ওঠে।

ধানখেত থেকে কাটা-ধান তোলা হয়। একটি দু'টি শিষ পড়ে থাকে। পাখি এসে বসে শিষগুলোতে। ছোট ছোট বাচ্চারা খেতের পর খেত ঘুরে এরকম ধানশিষ কুড়োয়। শীতে যখন মেলা বসবে, মেলায় যাওয়ার জন্য টাকা দরকার। শিষগুলো থেকে ধান সংগ্রহ করে তা বিক্রি করলে দু-চার টাকা হয়। ওদের কাছে দু-চার টাকা কম নয়। জ্যোৎস্নারাতে গোরুর গাড়ি ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করতে করতে এগোয়। গাড়ি 'পেছাড়' হয়ে থাকলে চাষি বসে 'ব'তে। 'আগাড়' থাকলে চাষির বাচ্চা ছেলেটি। সাইকেলের 'ব' সকলেই বুঝি, গোরুর গাড়ির 'ব' কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? ওই যেখানে লাঠি হাতে বসে গাড়োয়ান গোরুদের নিয়ন্ত্রণ করে, ওখানটা 'ব' আকারের। খামারে যখন গাড়ি ঢুকতে থাকে বাড়ির স্ত্রী-কন্যারা টর্চ বা হ্যারিকেনের আলো দেখিয়ে গাড়ি খামারে তোলে। খেত খালি হয়, খামার ভরে। এখানে রিক্ততার সম্পর্ক নেই, খেত ও খামার মিলেই কৃষিকাজ সম্পূর্ণ। গাড়িতে ফসল তুলে বিদায় জানানোর সময় খেত যেন বলে, 'গ্রহণ করো'। কৃষক কৃতজ্ঞ চিত্তে তার ভূমিকে প্রণাম করে।

আরও পড়ুন- হেমন্তে ছিল আলো তৈরির পাঠশালা! কালীপুজোর প্রদীপ যেভাবে তৈরি হত হাতে হাতে

এক দাদা ছবি আঁকে। তাঁর ক্যানভাসে কুয়াশার অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে কুয়াশাকে ভালোবাসতে শিখি। কোনও এক বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা ঠিকই বলেছিলেন, ফ্রেমের ভিতর ধরলে সমস্ত কিছুর সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। হেমন্তের এমন অপূর্ব কুয়াশায় জলের রঙ দেখি। জলে দেখি নিজের মুখ। অনেকটা গেভা কালারের ছায়াছবির মতো। খেতে পড়ে থাকা কবন্ধ কণিষ্কের মতো ধানের গোড়াগুলির পাশ দিয়ে ইঁদুর ছুটে বেড়ায়। তাহাদের আহারে কি কম পড়িয়াছে? মহাজনের গোলায় সব ধান চলে গেলে কৃষক যেভাবে অস্থির সময় কাটায়। আমরা মহাজন দেখিনি, উঠতি বণিক দেখেছি। অসহায় অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে, মানুষ যেমন নিজেই নিজের সঙ্গে ঠাট্টায় মেতে উঠতে পারে, তেমনই চেনা বণিকদের ধুরন্ধর বুদ্ধি দেখে মজা করে বলেছি, 'চদু তুমি যেই হউ বা'ন্যা তুমার মাথায় হাত বুলাবেকই।' হেমন্তের পর চাষির ধান ঘরে এলে, সেই ধান কত কমে কিনে কত বেশিতে বিক্রি করা যায় তার হিসেব কষতে থাকে এরা। কলিম খানের বচনে অনুৎপাদনশীল অথচ ক্ষমতাভোগী শ্রেণি। গরিব চাষি যার আজ ধান বিক্রি করলে কাল 'খোরাকি' জোগাড়, তার পক্ষে ঠকে যাওয়া এড়ানো একটি অলৌকিক ঘটনা। হেমন্তে সে তাই জলের দরে ধান বিক্রি করে, আবার চড়া দরে সুদে টাকাও ধার করে। এছাড়া তার উপায় নেই। খেতে ইঁদুর ধরতে আসে আদিবাসী জাতির মানুষেরা। গর্তের মুখে তাদের নিজেদের তৈরি 'কল' পেতে দেয়, অভুক্ত ইঁদুর কলে রাখা খাবার খেতে এসে ধরা পড়ে। সারারাত পেঁচার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যুদ্ধ-ক্লান্ত ইঁদুর এভাবেই দিনের আলোতে মারা যায়। জীবনানন্দের 'শিকার' কবিতার কথা মনে পড়ল? হেমন্ত বললে তাঁর কথা মনে পড়বেই, কিন্তু তাঁর হেমন্তের মতো করে হেমন্তকে আমি খুঁজে পাই না।

হেমন্তের মাঝামাঝি মোতালেফরা দলে দলে আসে। খেজুর গাছ বায়না করে। কালো পিচ রাস্তার পাশে তাদের অস্থায়ী ছাওনি দেখা যায়, দু-তিন কিমি পরপর। গাছগুলোর ডগা কাটারি দিয়ে ছেঁচে দেওয়া হয়, যেন একটি দীর্ঘ যোনি চিহ্ন। হেমন্ত যত শীতের দিকে গড়াবে তা থেকে রস গড়িয়ে নীচে বাঁধা হাড়িতে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়বে। আমাদের মধ্যে যারা বখাটে ছেলে তারা খুব ভোরে উঠে হাঁড়ি খুলে রস চুরি করে খেয়ে নিত। যেকোনও প্রকার রস নিষিদ্ধ হলে নেশা লাগে। বখাটে ছেলেদের অত্যাচারে ওরা ভয় দেখায়, হাঁড়িতে 'বাখর' দেওয়া আছে, খেলে মাথা ঘুরবে। কিন্তু আঠারো বছর বয়স কি মাথা ঘোরাকে ডরায়? শুনেছি, গাছ থেকে রস বার করে নিলে গাছে ফল ধরে না। আমাদের বাড়ির খেজুর গাছ কখনও তাই মোতালেফদের দেওয়া হয় না। খেজুর হলে যে পারে সেই গাছ থেকে খেজুর পেড়ে খায়। পাড়তে গিয়ে গাছে আটকা থাকা পাথর পড়ে অনেকের মাথাও ফাটে। আমি একবার ধান সেদ্ধ হাঁড়ি ফাটিয়ে দিয়েছিলাম পুরুলিয়ার রাসমেলা দেখতে যাব বলে। গ্রাম থেকে রাসমেলা দেখতে যাওয়ার গাড়ি হয়েছে। সকলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি যেতে পাব না? তখন তো বুঝতাম না, যাব বললেই যাওয়া যায় না, যাওয়ার জন্য টাকা লাগে! বাবার করে দেওয়া পাটার ব্যাট দিয়ে দিলাম মাটির হাঁড়ি ভেঙে। ধান ঝুরঝুর করে পড়ল জ্বলন্ত উনুনে। যেন আমার মনের ক্রোধে ধানগুলো পুড়ে গন্ধ উঠল! রাসমেলা কি এখনও বসে? সার্কাস আসে? পুতুলনাচ হয়? বসে কি বসে না তার চেয়ে বড় কথা একজন কিশোর তার খবর রাখে কি রাখে না, সেই উত্তর জানতে ইচ্ছে হয়।

আরও পড়ুন- হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা…

অমাবস্যার রাতে কালীপূজা। গ্রামের দু-প্রান্তে 'হুলা' জ্বালিয়ে 'ধো-মশা' করতে করতে ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেরোয়। প্রকরণের ভিতরে যাই ফুটে উঠুক, মূলত মশাকে ধোঁয়া দিয়ে তাড়ানোর উৎসব 'ধো-মশা'। ধো-মশা করতে গিয়ে কোনও কোনও দুষ্টুবুদ্ধির ছেলে জ্বলন্ত হুলা ছুড়ে দেয় গাছে। সারারাত গাছ ধো ধো করে জ্বলে, তার আলো পড়ে পাশের পুকুরে। ভোরবেলায় ধাঙড় আসে ভগবতী অর্থাৎ বাড়ির গোরুদের জাগাতে। গোরু কৃষকের সখা, সজন। বর্ষায় তারা কৃষকের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। হেমন্তে ঘরে ধান উঠলে তাদের মাথায় ধানশিষের মুকুট, গায়ে রঙের ছাপ দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে কৃষক। ধাঙড়েরা গোরুকে উদ্দেশ্য করে, মাদল, টিন, ধামসা ইত্যাদি বাজাতে বাজাতে অহিরা গায় : অহিরে… এতদিন তো খালি বরদা/ বোঝা বোঝা ঘাস ওরে বাবু হো/ আজিকেত খাবেক ভেঁগুয়ান….। বাঁদনা পরবের সকালে 'লে হাগি' গেয়ে সারা গ্রাম ঘুরে ধাঙড়ের দল। বিকালে কাড়াখুঁটা বা গরুখুঁটা দেখা। কার কাড়া কেমন খুঁটলো এই নিয়ে হয় জোরচর্চা। তেল চিকচিকে কাড়ার পিঠে চেপে মাঠে যেতে যেতে পাতার বাঁশি দিয়ে রাখাল হয়ে ওঠে রাখালরাজা। পাতার বাঁশি আমি কখনও বাজাতে পারিনি, কোনও বাঁশিই না। হেমন্তের সুর শুনতে তো তাতে অসুবিধা হয়নি। ঘাসে ঘাসে যে গন্ধ ওঠে, সেই গন্ধের টানে আমরা চলে যাই মাঠে। আমাদের টেনিস বল ছুটতে ছুটতে গিয়ে ঢোকে ধান খেতের ভিতর। ক্ষয়ে যাওয়া টেনিস বল আর আধপাকা ধান গাছের রঙ এক হওয়ায় বল খুঁজতে খুব অসুবিধা। যেভাবে ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ একই রঙের হয় বলে চিনতে পারি না। পড়ন্ত বিকেলে চেনা-অচেনার বাইরে এক ফ্রেম : যেখানে সবাই ঘরে ফেরে। মাঠের সব চাষি, সব পাখি, সব নদী, সব মানুষ। খেলার মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে মনখারাপ হয়, কোনও কারণ ছাড়াই।

কারণ ছাড়াই বিকেল হলে, জোড়ের কাছে গিয়ে বসে থাকি। বক জল ছুঁয়ে উড়ে যায় দূরে। হেমন্তের অরণ্যের পাশের সেই সংক্ষিপ্ত স্রোত কি কোনও চিঠি বয়ে আনবে এই প্রত্যাশায় বসে থাকি? সন্ধ্যার শিশিরে ফড়িং ভিজে যায়, ব্যাঙ এগিয়ে আসে। সাপেদের নিজের নিজের গর্তে ফেরার পালার চিহ্ন পড়ে থাকে ঝোপেঝাড়ে। আমরা তখন বাক্স থেকে বার করি হাফ-সোয়েটার। আমাদের প্রতিবেশী কালিন্দী ছেলেমেয়েরা একটা জামার উপর আরেকটা জামা পরতে শুরু করে। সর্ষে ও আলু লাগানো হবে বলে, বাইদ খেতগুলো প্রস্তুত হতে থাকে। মাটির ঢেলা ভাঙছে কেউ, কেউ সার দিয়ে বীজ পুঁতছে। বিকেলে রাণুর বোন বাড়ি বাড়ি খবর দিয়ে গেল, ওদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো হবে, সকলেই যেন পাঁচালি শুনতে যায়। রাণুও তখন হৈমন্তী, যেন শীতটা পেরোলেই বসন্তে পড়বে। বসন্তে ওর সঙ্গে রঙ মাখার অগ্রিম অধিকার আদায়ে বেশ কয়েকটি যুবক হৃদয় উদগ্রীব। তারা সবাই রাণুর মন বোঝার চেষ্টা করে চলেছে। সত্যনারায়ণের পাটালি রাণুই বিলি করবে। কাকে সে অন্যের চেয়ে একটু বেশি দেয়, এটিই দেখার। কার রাতে প্রজাপতি উড়বে, কাকে কামড়ে দেবে হেমন্তের পিঁপড়ে? দেখতে দেখতে কার্তিকের ঘ্রাণ পেরিয়ে অঘ্রান সংক্রান্তি আসে। প্রিয় জল থেকে উঠে আসেন টুসু। তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠে গ্রাম। হেমন্তের পাতাগুলো ঝরতে থাকে জোড়ের জলে। এই ঝরা নিঃস্পৃহ, নির্মোহ, ঋষিতুল্য। কুয়াশার ভিতর তিনি ধ্যানে একটি বছরের জন্য ডুব দেন।

More Articles