বাংলায় লেখা একমাত্র ঘড়ি! ভীম নাগের এই ঘড়ির সঙ্গে জড়িত দীর্ঘ ইতিহাস অনেকেরই অজানা

Bhim Nag Bangla Clock: এই বাংলা ডায়ালের ঘড়ি এখনও পর্যন্ত সচল রেখেছেন দোকানের কর্মকর্তারা। হয়তো ঘড়ির মেশিনারি কিছু পাল্টেছে।

৭৫ বছর হয়ে গেল ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছে। তবে তাদের রেখে যাওয়া অনেক কিছুই এখনও রয়ে গিয়েছে এদিক-ওদিক। কলকাতার বউবাজার এর ভীম চন্দ্র নাগের মিষ্টির দোকানটির কথা কে না জানে! মিষ্টি প্রেমী বাঙালির কাছে এই দোকান ইতিহাসের এক অধ্যায়! মিষ্টি প্রিয় বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে বহু বছর ধরে নিরলস প্রচেষ্টা করে চলেছে এই শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টির দোকানটি। বউবাজারে অন্যতম একাধিপত্য এই প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান ভীম চন্দ্র নাগের। সাল ১৮২৬ হবে, হুগলি জেলার মনোহরা খ্যত জনাই থেকে প্রাণচন্দ্র নাগ নামের একজন ব্যক্তি কলকাতার বউবাজারে খুললেন একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান। সে সময় এই দোকানটির তেমন কোনও নাম ছিল না। সে ছিল নেহাতই এক সাধারণ মিষ্টির দোকান।

পরে প্রাণচন্দ্র নাগের এই দোকানের দায়িত্ব নিলেন তাঁর পুত্র ভীম চন্দ্র নাগ। আর সেই আমলেই খুবই দ্রুত ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে এই দোকান। মিষ্টির সুদক্ষ কারিগর ভীম একের পর এক তৈরি করেন নতুন নতুন মিষ্টি। বাঙালির মিষ্টির ইতিহাসে কড়া পাক নামক অধ্যায়ের সংযোজনে এঁর ভূমিকা অপরিসীম বললেও কম বলা হবে হয়তো। বউবাজারে এখনও সেই একই জায়গায় রয়েছে এই দোকানটি। একই চেহারায় না থাকলেও অনেক কিছুই এক রয়ে গিয়েছে এই দোকানে। নাম লেখা থেকে শুরু করে বাংলা ডায়ালের ঘড়ি- অনেক ঐতিহ্যই রেখে দিতে পেরেছেন এই দোকানের বর্তমান মালিকরা। বউবাজার মোড় থেকে ওয়েলিংটনের দিকে ঘুরলে পাঁচ নম্বর নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটে এখনও এই দোকানটির অনড় অবস্থান। আর এই দোকানটির দেওয়াল ঘড়িতেই সময় যেন এখনও থমকে রয়েছে। এই দোকানের বাংলা দেওয়াল ঘড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক দুরন্ত ইতিহাস। 

আগে একটি মাত্র শাখা থাকলেও এখন ভীমচন্দ্র নাগকে একটি ফুডচেন বললে ভুল বলা হবে না। কলকাতার অনেক জায়গাতেই নিজেদের শাখা তৈরি করেছেন তারা। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন, একটি দোকান তাদের লোগোর মাঝখানেও কেন একটি ঘড়িকে রেখেছে? কেবলই বয়স বোঝানোর জন্য? একেবারেই নয়। এখন বাজারে অনেক ধরনের অনেক নকশার ঘড়ি দেখতে পাওয়া যায়। তবে, বাংলায় ডায়ালের নম্বর লেখা ঘড়ি কখনও দেখেছেন? কখনও সময় সুযোগ পেলে ভীম নাগের লোগোটিকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখা উচিত। সেখানে দেখা যাবে বাংলায় ডায়ালের নম্বর লেখা একটি ঘড়ি। আর ঘড়িটির মাঝখানে গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লেখা রয়েছে কুক অ্যান্ড কেলভি।

আরও পড়ুন- ৭৭ বছর ধরে নতুন-পুরনো কলমের অসুখ সারাচ্ছে ধর্মতলার এই পেন হাসপাতাল

১৮৫৮, অর্থাৎ যে বছর ভীমচন্দ্র নাগ তৈরি করলেন লেডিকেনি, সেই একই বছরে একটি ব্রিটিশ সিলভার ওয়্যার কোম্পানি কলকাতায় এসেছিল ব্যবসা করতে। সেই কোম্পানির নাম ছিল কুক অ্যান্ড কেলভি। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন থমাস কুক এবং চার্লস কেলভি। ডালহৌসি স্কোয়ারের লালদিঘি থেকে যে রাস্তাটি পূর্ব দিকে চলে যায়, সেটির তখন নাম ছিল ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিট। পরবর্তীতে ১৭৯২ সালে কোর্ট হাউজের জায়গায় সেন্ট অ্যাড্রিউজ চার্চ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এই রাস্তাটির নাম বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমন্ত বসুর নামে নামাঙ্কিত হয়েছে। তবে ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলে এই রাস্তাতেই ছিল কুক এন্ড কেলভির সেই বিখ্যাত দোকান। ঘড়ি থেকে শুরু করে দামি পাথর, হিরে জহরত সব কিছুর ব্যবসাই করত এই কুক অ্যান্ড কেলভি।

উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সে সময় বাংলায় ঘড়ির আগমন ঘটেনি। শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের কিছু বাড়িতে দেখা মিলত ঘড়ির। এছাড়া চার্চে এবং রাস্তায় ঘড়ি থাকত সেই সময়ে। ফলে ব্রিটিশদের ভারতে এসে ব্যবসা করতে সমস্যাই হতো। বোম্বে, মাদ্রাজ এবং কলকাতার বন্দরগুলিতে এসে ব্যবসা করার সময় ঘড়ি না থাকার কারণে সমস্যার মধ্যে পড়তেন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা। সেই কারণে ঘড়ির প্রয়োজন পড়তে শুরু করে তাদের। আর সেই সূত্রেই ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে ব্যবসা শুরু করে কুক এন্ড কেলভি।

জানা যায়, ১৮৫৮ সালে এই কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থমাস কুক বউবাজারের ভীম চন্দ্র নাগের দোকানে মিষ্টি খেতে এসেছিলেন। সে সময় লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রী লেডি ক্যানিংয়ের নামে মিষ্টি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছেন ভীম নাগ। তাই, থমাস কুক এসে ওই মিষ্টিটিই খেতে চাইলেন ভীম চন্দ্র নাগের কাছে। ভীম নাগের মিষ্টি খেয়ে এতটাই তিনি প্রসন্ন হলেন যে, আরও বেশ কিছু মিষ্টির অর্ডার করে দিলেন তৎক্ষণাৎ।

আরও পড়ুন- সূর্যের ছায়া বা জলে চলা ঘড়ি থেকে স্মার্ট ওয়াচ, ঘড়ির যে ইতিহাস অজানা

সেই সময় মিষ্টি খেতে খেতেই তাঁর নজরে পড়ল একটা অদ্ভুত বিষয়। বিলিতি ঘড়ি নির্মাতা এই কোম্পানির বড়বাবু দোকানে কোনও ঘড়ি না দেখতে পেয়ে একেবারে চমকে যান। ভীমচন্দ্রকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, দোকানে ঘড়ি নেই কেন? লাজুক স্বরে তিনি জানান, কেনা হয়ে ওঠেনি। সেই শুনে বড় বাবু বলেন, পরের দিন তাদের অফিসে লোক পাঠিয়ে একটি ঘড়ি নিয়ে আসবার জন্য। ভীমচন্দ্র নাগ সংকোচ না করেই জানান, তাঁর কর্মচারীরা ইংরেজি সংখ্যা লেখা ঘড়িতে সময় দেখতে পারবেন না। তাঁরা একেবারেই ইংরেজিতে সড়গড় নন। তাই যদি বাংলায় লেখা কোনও ঘড়ি পাওয়া যায়, তাহলে ভালো হয়।

সেই সময় পর্যন্ত কুক এন্ড কেলভি বাংলায় লেখা ঘড়ি বানাতে পারত না। আর এখান থেকেই শুরু হয় খেলা। ভীমচন্দ্র নাগের কথা শুনে থমাস কুক চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেন। নিজেই বাংলা হরফে লিখে ইংল্যান্ডে তাঁদের ওয়ার্কশপে পাঠিয়ে দেন একটি স্যাম্পেল। সেখানকার কর্মচারীরা সুইজারল্যান্ডের মেশিন ব্যবহার করে সেই ঘড়ির উপরে বাংলা হরফে লিখে ফেলেন সংখ্যা। ব্যাস, কয়েক দিনের মধ্যে এই দোকানে পৌঁছে যায় বাংলা লেখা ডায়ালের একটি পেল্লাই আকারের ঘড়ি। সেখানে সময়ের জায়গায় লেখা রয়েছে, এক, দুই, তিন... কেবল তাই নয়, বাংলাতেই বড় বড় করে লেখা কুক এন্ড কেলভির নাম। আর নিচে লেখা রয়েছে লন্ডন।

কেলভি সাহেব হয়তো ভেবেছিলেন, বাঙালির সবই ভালো, তবে সময়জ্ঞানটা যদি একটু শোধরানো যেত.... সে যাই হোক, এই বাংলা ডায়ালের ঘড়ি এখনও পর্যন্ত সচল রেখেছেন দোকানের কর্মকর্তারা। হয়তো ঘড়ির মেশিনারি কিছু পাল্টেছে। তবে, ঘড়িটির আকার আকৃতির কোনও পরিবর্তন হয়নি একটুও। এখনও ভীম নাগের দোকানে ঢুকে শান্তভাবে কান পাতলে শোনা যায় কুক এন্ড কেলভির ঘড়ির হৃদস্পন্দন, সেই যেমন পাওয়া যেত ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলে।

 

More Articles