উগ্র ক্ষত্রিয় রাম নয়, হাওড়ায় পূজিত হয় বাঙালির আদি সবুজ রাম
Rama Navami 2023: বাংলায় (এমনকী উড়িষ্যার কিছু অঞ্চলেও) রামের গায়ের রং সবুজ, এবং এই সবুজ রং হাল আমলের নয়, যুগ যুগান্তর ধরে বাংলায় সবুজ রামের পুজোই হয়ে চলেছে।
২০১৪ পরবর্তী সময়ে বাংলায় রামনবমী সংক্রান্ত উৎসব ও মিছিলের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে অনেক মানুষের মতামত ছিল রামের পুজো বাংলার আদি উৎসব নয় এবং রামের সঙ্গে বাঙালির আত্মিক যোগাযোগ নেই, বরং রামের আরাধ্যা দেবী দুর্গার পুজো বহুকাল ধরে করে আসছে বাঙালিরা। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। বাংলায় বহুকাল রামের আরাধনা হয়ে আসছে, তবে সেই রামের শ্রেণিচরিত্র হিন্দু আগ্রসনের প্রতিভূ মধ্যভারতীয় রামের থেকে আলাদা। আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ অনুবাদ করেন আনুমানিক চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন একসময় মন্তব্য করেন,
“রামায়ণ ও মহাভারতের সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু হয় বাংলার মুসলমান শাসকদের নির্দেশে, মোটামুটি চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ায়। মহাকাব্য দু’টির সেই অনুবাদগুলোই এখনও বাংলায় সর্বাধিক পঠিত।”
তবে এই কথাও পুরোপুরি সত্য নয়। কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক কে ছিলেন এই নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। এই পৃষ্ঠপোষক রাজা যদি রুকনুদ্দিন বারবাক শাহ না হয়ে রাজা গণেশ অথবা কংসনারায়ণ হন তাহলে ইসলামি শাসকদের নির্দেশের তত্ত্ব খাটে না। তবে এ কথা সত্য, কৃত্তিবাস রচিত (এই রচনাকে অনুবাদ বলা যায় না ঠিক, কারণ তিনি বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে রামায়ণকে পুননির্মাণ করেন) ‘শ্রীরাম পাঁচালী’-তে তৎকালীন বাঙালির ধর্মান্তর রোধ ও পাপের হাত থেকে বাঁচতে রামচন্দ্রের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা দিয়েছে। প্রসঙ্গত রামের দুর্গাপুজোর ঘটনাটিও প্রথম ‘শ্রীরাম পাঁচালী’তেই পাওয়া যাচ্ছে।
এখানে থেকে বোঝা যায়, বহু আগে থেকেই হিন্দি বলয়ের ‘রাম চরিত মানস’-এর সমান্তরালে বাংলায় একটি রামচর্চার ধারা শুরু হয়েছিল। বাংলার এমন অনেক স্থান আছে যার নামের সঙ্গে ‘রাম’ শব্দটি জড়িয়ে আছে, শ্রীরামপুর, রামপুরহাট, রামরাজাতলা প্রভৃতি। এদের মধ্যে হাওড়ার রামরাজাতলায় এক বিশেষ রামমন্দির অবস্থান করে, তবে সেখানে রাম পূজিত হন বছরের চার মাস মৃন্ময় মূর্তিতে। এই বিশেষ মন্দিরের বিশেষ রাম বিগ্রহের কথা কিছু মানুষ জানলেও, এক বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে তা অজানা।
আরও পড়ুন- বিরহ শুধুই বিলাপ নয়, বেদনায় যেভাবে শিউলির মতো হয়ে উঠেছেন রামচন্দ্র, যক্ষ
বাংলায় দেবদেবীর যে চিত্র আমাদের স্মৃতিতে ও দৃষ্টিতে থাকে, তা বেশিরভাগ সময়েই আমাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক। আমরা যদি দুর্গাপ্রতিমার দিকে তাকাই, সেখানেও এই আঞ্চলিক সংস্কৃতির ছাপ প্রকট। বিশেষ ‘বাংলা ঢঙের মুখ’-এর কথা যদি ছেড়েও দিই, বিক্রমপুর ঘরানার (রাখাল রুদ্র পাল, যজ্ঞেশ্বর পাল, মোহন বাঁশি রুদ্র পাল ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম) মাতৃপ্রতিমার গড়ন লক্ষ করলে সেখানেও বাঙালি মায়েদের চিত্রই যেন ধরা থাকে। শিবের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলার ‘শিব’ সেই ‘শিবায়ন’ বা ‘অন্নদামঙ্গল’ বা তার পরবর্তীতে শাক্ত পদাবলীর সময়কাল থেকেই চাষা, স্বভাবগতভাবে কিছুটা কুঁড়ে। ‘পুঁজি এবং প্রবঞ্চনা’র ফাঁদে না পড়ার কারণে ব্যবসা করা হয়নি তাঁর, ভিক্ষা করেই সংসার চালাতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। বয়সটাও গৌরীর থেকে অনেক বেশি, একটা সযত্নে লালন করা ভুঁড়ি আছে এবং অনেকক্ষেত্রে চুলটাও পাকা। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে এই শিব বাংলার গ্রামের আরও পাঁচটা সাধারণ গৃহস্থের থেকে ভিন্ন কেউ নন।
রামের সঙ্গেও বাংলার এই নিয়ম বজায় থেকেছে, তবে এখানে রামের দেশিয়করণ ঘটলেও তা শ্রীরামচন্দ্রকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়নি। রাম বাংলায় রাজা রাম হিসাবেই মূলত পূজিত হন। যে মূল পরিবর্তনটি রামের ক্ষেত্রে এসেছে সেটি তাঁর শারীরিক গঠনে। বাংলার রাম কিছুটা গোলগাল (মধ্যভারতীয় রামের মতো মুগুড় ভাঁজা পেটানো চেহারা নয়), শিবের মতো একটা ছোট্ট ভুঁড়িও আছে, আছে একটা পেল্লায় গোঁফ, এবং যে জিনিসটি আমাদের রামকে সম্পূর্ণ ভিন্ন করে দিয়েছে ভারত তথা দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশের রামের থেকে, সেটি হলো রামের গায়ের রং।
জনমানসে একটা ধারণা আছে যে, গেরুয়া রং হিন্দুত্বের প্রতীক এবং সবুজ রং ইসলামের প্রতীক। এই ধারণা বহুদিন ধরে আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়ার সফল কাজটি হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীরা করে এসেছে। তবে সব বিজয় রথকেই বোধহয় বাংলায় এসে থামতে হয়। যে পৌরাণিক চরিত্রকে বেশ কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বলে মনে করেন সেই শ্রীরামচন্দ্রের কাছে থমকে যেতে হয় এইসব গোষ্ঠীকে। যার কারণ আর কিছুই নয়, বাংলার রামের অভিনব গাত্রবর্ণ, যা গাঢ় সবুজ। যে সবুজ রঙকে ইসলামের রং বলে দাগিয়ে দিতে চায়, বাংলায় (এমনকী উড়িষ্যার কিছু অঞ্চলেও) সেই রামের গায়ের রং সবুজ, এবং এই সবুজ রং হাল আমলের নয়, যুগ যুগান্তর ধরে বাংলায় সবুজ রামের পুজোই হয়ে চলেছে।
এবার আবার ফেরা যাক হাওড়ার রামরাজাতলার রামচন্দ্রর ব্যাপারে। এই রামের মূর্তি একাধারে অদ্ভুত, বিচিত্র ও চমকপ্রদ। প্রতিমার সম্পূর্ণ কাঠামো প্রায় ২৫ ফুট ও তিনটি প্যানেলে বিভক্ত, মাঝে অবস্থিত সবুজ গাত্রবর্ণে রামচন্দ্র ও সীতা, রামের ডানদিকে শিব ও বাঁদিকে ব্রহ্মা। উপরে সিংহবাহিনী, পঞ্চ সরস্বতী, বাসুদেব, নিচে লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, জাম্বুবান, বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র সহ বিভিন্ন দেবদেবী। এই পুজো চলে রাম নবমী থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত।
আরও পড়ুন- জয় শ্রীরাম: ছিল নিরীহ স্লোগান, গেরুয়া ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠল যেভাবে…
শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার রামের বিগ্রহ সহ প্রায় সম আকৃতির ‘সমী চণ্ডী’, ‘পুরাতন নবনারী’, ‘নূতন নবনারী’র মূর্তি নিয়ে এক বিশাল নিরঞ্জন শোভাযাত্রা বের হয় মধ্য হাওড়ার বুকে। এই পুজো এবং শোভাযাত্রার বয়স ২৫০ বছরেরও বেশি। এখানে আরও একটি জনশ্রুতির কথা জানা যায় (জনশ্রুতি বলার কারণ, এই ঘটনার কোনও ঐতিহাসিক সূত্র বহুকাল খুঁজেও বের করা সম্ভব হয়নি)। এ ঘটনা সত্য যে, একসময় হাওড়া ময়দানে জি টি রোড ধরে ট্রাম চলাচল করত। ব্রিটিশ শাসকরা এই নিরঞ্জনের রাস্তায় ট্রামের তার খুলতে অস্বীকার করেন ও রামের প্রতিমা ছোট করার কথা বলেন বা অন্য কোনও বিকল্প পথ বাছতে বলেন। সাধারণ জনতা ক্ষেপে যাওয়ায় ও সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি হওয়ায় সরকারপক্ষ ট্রামের তার খুলতে বাধ্য হয় এবং শোভাযাত্রা পূর্ব নির্ধারিত পথেই হতে থাকে।
আধুনিকতা কখনওই শিকড়কে ভুলে গিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। তবে হাল আমলের সব থেকে বড় অসুবিধা সেই শিকড়কে গুলিয়ে দেওয়ায়। আমরা যে আর্থ-সামাজিক-ভৌগোলিক পরম্পরা ও উত্তরাধিকার বহন করছি, তা আমাদের পূর্ণিমায় সত্যপীরকে শিরনি প্রসাদ দিতে শেখায়। আমাদের রাম সবুজ, আমাদের শিবের বৃদ্ধ বয়স, এর কিছুই যেন হিন্দি বলয়ের আগ্রাসনের সঙ্গে মেলে না, আর মেলে না বলেই আমরা স্বতন্ত্র। এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক আদর্শের যে রাজনীতি এতদিনে ধরে চলে আসছে, সেই ঢেউয়ে শিকড় আঁকড়ে থাকা কতটা কঠিন, যারা চেষ্টা করেন একমাত্র তারাই জানেন। রাম আমাদের কতটা আর ওদের কতটা, এইসব দ্বন্দ্বে না গিয়ে নিজের সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথের এই সামান্য কথাটি মাথায় রাখলেই সম্ভবত সকল সমস্যার সমাধান করা যায়-
“কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”...