হিন্দু দেবতার দেখভাল করেন মুসলিমরা, ধর্মের ভেদাভেদ মিলেমিশে যায় বাংলার এই শিব মন্দিরে
Famous shishuyeswar shiv mandir : বিভেদের মাঝে যে মহা মিলনের কথা ভারতের প্রসঙ্গে বারবার বলে গিয়েছেন মুনী ঋষিরা, তা যে প্রকৃতই সে কথা মিলে যায় এই মন্দিরের অন্দরে
আদ্যোপান্ত মুসলিম এলাকা, মুসলিম পাড়া বলতে যা বোঝায় আরকি। ঠিক তার মাঝেই রয়েছে একটা আস্ত শিব মন্দির। ধর্ম নিয়ে বিভেদ কেবল মানুষের মধ্যেই, দেবতার যে তাতে কিছুই যায় আসে না তা যেন প্রমাণিত হয় এইখানে এসে। মুসলিম বাসিন্দাদের সেবাতেই শিবের বসবাস এখানে, এমনকী দৈব মহিমা নিয়ে বর্ণনাও করেন তারাই। মুর্শিদাবাদ, বাংলার প্রাচীন স্থাপত্য এবং ইতিহাসের সাক্ষী এই জেলা। এখানেই রয়েছে এমন নিদর্শন। স্থানীয় মুসলিম জমিদার হাজি আরাম হোসেনের জমির ওপরে তৈরি হয়েছে এই মন্দির। ওই জমিদার নিজেই মন্দির তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পরে তাঁর ছেলেরা এই মন্দিরের দেখভাল করেন। সেই থেকে প্রজন্মের হাত ঘুরে হিন্দু দেবতা নিত্যদিন জল বাতাসা পান মুসলিমদের হাতেই।
বিভেদের মাঝে যে মহা মিলনের কথা ভারতের প্রসঙ্গে বারবার বলে গিয়েছেন মুনী ঋষিরা, তা যে প্রকৃতই সে কথা বোঝা যায় মুর্শিদাবাদের ওই শিব মন্দিরে পা রাখলেই। আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে তৈরি হয়েছিল এই মন্দিরটি। সেই থেকে একইভাবে মুসলিমদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে মন্দিরটি। বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠানে যখন বড়ো করে পুজোর আয়োজন করা হয় তখন তার দেখভালও করেন তাঁরাই। দেবতাকে জাগ্রত বলে প্রচার করার দায়ভারটুকুও তাদের ওপরই বার্তায়।
আরও পড়ুন - নাগ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব মেলে এখানে, আজও নিয়মিত পুজো হয় বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এই হিন্দু মন্দিরে
স্থানীয় ভাষায় ওই শিব শিশুয়েশ্বর শিব নামে পরিচিত। মুর্শিদাবাদের ভরতপুর বিধানসভা অঞ্চলে রয়েছে এই মন্দির। কাছাকাছি রেলস্টেশন বলতে সালার। স্টেশনে নেমেই মিলবে টোটো, তারই একটাতে চেপে প্রায় তিন কিলোমিটারের পথ। ওই পথেই পড়বে উজানিয়া-শিশুয়ায়। আর সেখানেই রয়েছে প্রাচীন এই শিশুয়েশ্বর শিব মন্দির। এখানে শিবলিঙ্গ বৃদ্ধিচক্র শিশুয়েশ্বর শিব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
লোকমুখে শোনা যায়, প্রাচীনকালে এখানে চারিদিকে ছিল ঘন জঙ্গল। বেশ খানিকটা দূরে এক গ্রামের বাসিন্দা নফর পালের গোরু নিজে থেকেই এখানে এসে দুধ দিয়ে যেত। গরুর মালিক বিষয়টা নিয়ে বেশ অবাক হন, তার পর খোঁজ নাইট জানতে পারেন, এই এলাকায় পড়ে থাকা একটি ঢিপির ওপর পাথরে রোজ দুধ দিয়ে যায় ওই গোরু। কয়েকদিন লক্ষ্য করার পর তিনি দেখতে পান, পাথরটি ক্রমশ বাড়ছে।
আরও পড়ুন - মহাভারতের ‘ঘৃণ্য’ চরিত্র পূজিত হন ভারতে! দুর্যোধন মন্দিরের যে কাহিনি অবাক করবেই
কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এই শিবের ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তাই। বিশ্বাসের জোরেই এখানে বছরের পর বছর পূজিত হন শিশুয়েশ্বর। গরু বৃতন্তের খবর ছড়িয়ে পড়ে কম দিনের মধ্যেই। খবর পেয়ে বর্ধমানের মহারাজা এখানে এসে ঠিক করেন মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই খোদ মুসলিম পট্টির মধ্যে গড়ে ওঠে আস্ত একটা হিন্দু মন্দির। প্রথম দিকে কাটোয়া থেকে পুরোহিত এনে তিনি এই মন্দিরে নিত্য পুজো শুরু করেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা যায় অন্য, শোনা যায় মন্দিরের শিব লিঙ্গটি নাকি ক্রমশ আরও বাড়তে থাকে। শেষে ভক্তরা প্রার্থনা করেন যাতে আর বৃদ্ধি না পায়। অবাক করা বিষয় হল, সেই প্রার্থনার ফলও নাকি মেলে শীঘ্রই। দেখা যায়, শিবলিঙ্গটি তিনখণ্ড হয়ে গিয়েছে। মূলখণ্ডটির পাশে মন্দিরের মধ্যেই পাওয়া যায় আরও একটি খণ্ড। আর তৃতীয় খন্ডটি গঙ্গার উজানে ভেসে চলে যায়। এই গঙ্গার উজানে এখানে হল আসত বলেই জায়গাটির নাম হয় উজানিয়া। ভৌগলিক ব্যাখ্যায় যদিও পাথর ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া নিয়ে অন্য তত্ত্ব মেলে, কিন্তু তাতে ভক্ত আর বিশ্বাসের পায়ে কুড়ুল মারার ক্ষমতা জন্মায় না। তাই ওই বিশ্বাসের জোরেই এখানে দেবতা জাগ্রত হতে ওঠেন দিনদিন। হিন্দুরা তো বটেই মুসলিম ভক্তরাও আপন করে নিন বিগ্রহকে। ধর্মের ধ্বজা ওড়ে মিলনের সূত্র ধরেই।