`বেড়ালহাতি দুর্গা’! ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো অন্য রকম
এখন এই পুজোয় আগের জৌলুস নেই, স্মৃতিটুকু সম্বল করেই এখন পুজো কাটে বাড়ির অনেক সদস্যের। আজও গলায় আঁচল জরিয়ে বরণ করেন ঘরের মেয়ে উমাকে। জৌলুস না হয় নাই থাকল, মেয়ে যে ঘরে আসছে এই বা কম কী?
ফলকহীন দরজা পার হলেই বিশাল উঠোন। দালানবাড়ি। বাড়িটি এখন নানা শরিকে ভাগ। এই বাড়ির পলেস্তরা খসা দেওয়ালে এখনও লেগে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রাচীনতার কথকতা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বনগাঁ শহর সংলগ্ন ছয়ঘরিয়া এলাকায় প্রত্নস্তূপের মাঝে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংঘর্ষ করছে প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটো ঠাকুরদা গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই শহরে জন্মগ্রহণ করেননি বা এখানে বসবাসও করতেন না। কিন্তু পারিবারিক দুর্গাপুজোর সময় যেখানেই থাকুন না কেন, এখানে চলে আসতেন। আর সেই কারণে আজও এলাকার মানুষজন রাখালদাসকে নিজেদের লোক বলে মনে করেন। এই পুজোর সঙ্গে তাই জড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিকের নাম। সেই ঐতিহাসিকের হাত ধরে ৩০০ বছর পার করা পুজো আজও ইতিহাসের ভার বহন করে চলেছে।
প্রায় ৩০০ বছর আগে রাখাসদাসের ঠাকুরদা গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঠাকুর দালানে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন। গৌরহরি একদিন স্বপ্নে অদ্ভূত দর্শন এক দেবীমূর্তি দেখতে পান। যে দেবীমূর্তির কিনা ১০টি হাতের মধ্যে ২টি হাত কেবল বড়। বাকি ৮টি হাত বেড়ালের মতো ছোট ছোট। স্বপ্নাদেশ পাওয়া আদলেই নির্মিত হয় মূর্তি। তার নাম হয়ে যায় `বেড়ালহাতি দুর্গা’। একসময় সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত বলির প্রথা চালু ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে। পরে তা বন্ধ হয়ে চিনি-নাড়ু দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথা চালু হয়।
জন্মাষ্টমীর দিন আমকাঠের তৈরি নতুন কাঠামোতে সিঁদুর পরিয়ে ঠাকুর দালানে প্রতিমা তৈরি করা হত । সেই পরম্পরা আজও ধরে রেখেছে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার । প্রতিপদের প্রথম দিন বেলতলায় পুজোর পর ঠাকুর দালানে ঘট বসিয়ে দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় । প্রথমা থেকেই পুজো শুরু । একসময় সপ্তমী থেকে নবমী পশুবলি হত । পরে তা বন্ধ হয়ে নৈবেদ্য প্রথা চালু হয়। আজও সেই রীতি চলছে।
আরও পড়ুন-দুর্গাপুজোয় উৎসব নয়, মহিষাসুরের স্মরণসভা পালন করে তার বংশধররা!
এই পুজোর সঙ্গে বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা জড়িয়ে আছে। ২০০০ সালে পুজোর আগে বন্যায় গোটা বনগাঁ মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা জলে ভেসে যায়। ষষ্ঠীর দিন কীভাবে দেবীর বোধন হবে, তা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না পরিবারের সদস্যরা। কারণ বোধনতলা জলের তলায় চলে গিয়েছিল। ষষ্ঠীর দিন ঘটেছিল এক আশ্চর্য ঘটনা। প্রথম শিবমন্দিরের উঁচু ঢিবিতে বোধন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। হঠাৎই ষষ্ঠীর আগে বোধনতলায় দুই তিন হাত জল কমে যায়। নির্দিষ্ট স্থানেই বোধন হয়েছিল। এখন বাড়ির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায় এরকম নানা গল্প।
একসময় পুজোর ক’টা দিন বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে একাধিক হাঁড়ি চড়ত। আশপাশের গ্রামের বাড়িগুলিতে পুজোর সময় রান্না হতো না। এই বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করতেন গ্রামের মানুষ। বর্তমানে সেসব আর করা হয়ে ওঠে না। শুধু নিষ্ঠাভরে এখনও পুজোর আয়োজন হয়ে আসছে। পুজোর দিনগুলিতে এখনও প্রচুর মানুষ আসেন এই বাড়িতে। কর্মসূত্রে নানাদিকে ছড়িয়ে থাকা এই বংশের সদস্যরা পুজোর সময় একত্রিত হন।
এই পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের ব্যবস্থাতেও রয়েছে অভিনবত্ব৷ দশমীর দিন সন্ধ্যাতারা ওঠার পরই প্রতিমা নিরঞ্জনের ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় নাওভাঙা নদীতে নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিমা। দু’টি নৌকার উপর রেখে সাত পাক ঘুরিয়ে নৌকা দু’টিকে আস্তে আস্তে দু’দিকে সরিয়ে বিসর্জন করা হয়।
শতাব্দী প্রাচীন থালা-বাসনগুলো এখনও সযত্নে তুলে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। পূর্বপুরুষের স্মৃতি বহন করছে এগুলো। সেই থালা-বাসনগুলি আজও পূজার্চনাতে ব্যবহৃত হয়। আগে পুজো এলে পরিবারের সবাই বাড়িতে চলে আসতো। রাতে ঘরে ঘুমানোর জায়গা হত না। কিন্তু আগের মতো জৌলুস নেই। পুজো এলেই সেইসব পুরনো স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় পরিবারের সদস্যদের।
রাখালদাস জন্মসূত্রে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের হলে কীহবে পারিবারিক দুর্গাপুজোর সময় এই বাড়িতে চলে আসতেন। দাদা, দিদি, ভাই, বোনদের সঙ্গে কটাদিন হৈহৈ করে কাটাতেন রাখালদাস। নিজের হাতে গ্রামবাসীদের বস্ত্র দান করতেন। দরিদ্র ভোজন করাতেন। আশেপাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে পুজো দেখতে আসতেন। তাঁদের তাদরকি করতেন রাখাসদাস। পুজোর দিনগুলিতে প্রতিদিন নিজে হাতে বস্ত্র বিতরণ করতেন, তারপর খেতেন।
রাখালদাস চিরকালই জমিদারি মেজাজের মানুষ ছিলেন। জমিদারি আদব কায়দা বজায় রাখতে প্রচুর টাকা খরচ করতেন। বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। পুজোর ক’টাদিন তাঁকে ঘিরে সঙ্গীসাথীদের উৎসাহের সীমা থাকত না।
বিজয়া দশমীর দিন রাখালদাসের খুব উৎসাহ ছিল প্রতিমা নিরঞ্জনে। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে প্রতিমা নিরঞ্জনে থাকত অনেক চমক। যেমন দশমীর দিন সন্ধ্যাতারা ওঠার পরই হত প্রতিমা নিরঞ্জন। রাখালদাস থাকতেন প্রতিমা নিরঞ্জনের দায়িত্বে। পুরাতাত্ত্বিক রাখালদাস যেখাবে ভারতের বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্রগুলো ঘুরে বেরিয়েছেন, ঠিক তেমনই ইছামতীর তীরে নিজেদের পরিবারিক এলাকাগুলোতেও খোঁজ চালিয়েছেন তিনি।
রাখালদাসের গুরু ছিলেন পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। গুরু হরপ্রসাদ রাখালদাসের মনের মধ্যে পুরাতত্ত্বের প্রতি আগ্রহ তৈরি করেন। আর গুরুর কথা মতো রাখালদাস ঠাকুরদার বাড়ি এলেই তাই খুঁজে বেড়াতেন ইতিহাসের মণি মুক্তো। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার বাড়িটিকে `হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। আসলে হাজার প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে ঐতিহাসিক রাখালদাস আবিষ্কার করেছিলেন মহেঞ্জোদারো, আর অনেক প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে তিনি স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন ছয়ঘরিয়ার মানুষের মনে।
এখন এই পুজোয় আগের জৌলুস নেই, স্মৃতিটুকু সম্বল করেই এখন পুজো কাটে বাড়ির অনেক সদস্যের। আজও গলায় আঁচল জরিয়ে বরণ করেন ঘরের মেয়ে উমাকে। জৌলুস না হয় নাই থাকল, মেয়ে যে ঘরে আসছে এই বা কম কী?