মমিতে লুকিয়ে অবিশ্বাস্য রহস্য! মিশরের এই সম্রাটকে নিয়ে যে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি

প্রাচীন মিশর যুগে যুগে প্রত্নতত্ত্ববিদ থেকে ঐতিহাসিকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বিশালাকৃতি পিরামিড, পাথর, হায়ারোগ্লিফিক্স রহস্যের জাল এতটাই ঘন করে তুলেছে যে একের পর এক মিথের জন্মস্থল হয়ে উঠেছে মিশর। বিশেষত ওই গঠনগত উপাদান আশপাশে কোথাও যখন উপলব্ধ নয়, তখন পাথরের শহর তৈরি হল কীভাবে? দানিকেন তত্ত্ব নিয়ে এর মধ্যে জলঘোলা হয়েছে আরও। যতই খণ্ডন হোক সে ভিনগ্রহী তত্ত্ব, মানুষ অতিলৌকিককে জিইয়ে রাখার যা ক্ষমতা রাখে, বিপরীত বৈজ্ঞানিক যুক্তি ধারণের ক্ষমতা তার তত না। তার ওপর মিশরের ইতিহাস, সম্পূর্ণ নিজস্ব দেবতাদের নির্মাণ, ফ্যারাও— এদের স্তরবিন্যাস কিছুটা জানা হয়ে উঠলেও এখনও বিপুল পরিমাণ তথ্য অজানা। ঔপনিবেশিক আলোর বয়স তত নয়, যত দীর্ঘ সময় মিশরীয় সভ্যতা তার নিজস্ব অন্ধকার জমা করেছে একটু একটু করে। তবে খোঁড়াখুঁড়ি এখনও জারি। শেষ বড় ধরনের যে আবিষ্কারটি হয়েছিল, তা তুতেনখামেনের সমাধি। ১৯২২ সাল। সেই নিয়ে এখনও জল্পনার শেষ নেই। আর্জের টিনটিন থেকে ‘দ্য মামি’- ফিরে ফিরে এসেছে এই রহস্য। অথচ, অতিপ্রাকৃতের পথে হেঁটে এইসব কীর্তিকলাপ আরও রহস্য বাড়িয়ে তুলেছে। মিশর বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি তুতেনখামেন রাজত্বের যেসব ঐতিহাসিক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, যে রহস্যগুলির অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানিয়েছেন– সেগুলো একটু ফিরে দেখা যাক। 

তুতেনখামেনের পিতামাতা কারা?

১৩৪২ খ্রিস্ট্রপূর্বাব্দে তুতেনখাতেনের জন্ম। সেই সময় মিশরের সম্রাট আখেনাতেন। ‘তুতেনখাতেন’ নামটির অর্থ ‘আতেনের জীবন্ত প্রতিমূর্তি’। আখেনাতেনের মৃত্যুর পর তাঁর নাম পালটে রাখা হয় সূর্যদেবতা ‘আমেন’ বা ‘আমুন’-এর নামে। তখন নামটি হয়ে দাঁড়ায় ‘তুতেনখামেন’ বা ‘তুতেনখামুন’। কেউ কেউ মনে করেন, আখেনাতেনের প্রধান রানির গর্ভে তাঁর জন্ম। এই প্রধান রানির নাম নেফারতিতি। আবার অনেকে মনে করেন, আখেনাতেনের এক দুয়োরানি কিয়া তুতেনখামেনের জননী। তবে এ সব ধারণামাত্রই। এমনকী, তুতেন তথা ‘তাত’-এর বাবা আদৌ আখেনাতেন কি না, এই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাত ফ্যারাও স্মেংখকারা-র পুত্রও হওয়া সম্ভব। কারণ তাত রাজা হওয়ার ঠিক আগেই স্মেংখকারা কিছুদিন সিংহাসনে বসেন। ডিএনএ অ্যানালিসিস করে দেখা গিয়েছে, তাতের বাবার কবর রয়েছে সমস্ত উপত্যকার পেরিয়ে এককোণে, কেভি৫৫, আর মায়ের কবর আরও পশ্চিমে, কেভি৩৫। এই দু'টি কবরে শায়িত ব্যক্তিদের কোনও পরিচয় উদ্ধার সম্ভব হয়নি। ইজিপ্টোলজিস্ট মেরিএন ইটন ক্রউস তুতেনখামেন বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে, মমিদু'টির অবস্থান দেখে একথা স্পষ্ট যে, তাঁরা তুতেনের নিকট আত্মীয়। কিন্তু ঠিক কী ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে, একথা শুধুমাত্র ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বলা সম্ভব নয়। তবে পিতামাতার হদিশ খুঁজে পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে কী পরিস্থিতির মধ্যে মাত্র ন'বছর বয়সেই সিংহাসনে বসতে হয়েছিল তুতেনকে, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

তুতেনখামেনের আগে সিংহাসনে কে ছিলেন?

আখেনাতেনের রাজত্বকালের শেষের দিকে, ১৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তিনি ‘নেফারনেফারুয়াতেন’ নামক এক সহ-শাসক বহাল করেন। মনে করা হয়, এটি নেফারতিতিরই আরেকটি নাম। আখেনাতেনের মৃত্যুর পর এই নেফারনেফারুয়াতেন তিনটি বছর রাজত্ব করেন। এরপরে স্মেংখকারা গদি দখল করে নেন। যদিও এই স্মেংখকারাকে নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই এঁকে নেফারতিতিরই লোক বলে মনে করেন। আবার অনেকে এঁকে আখেনাতেনের আত্মীয় বলে মনে করেন। যদি তুতেনের সমাধিতে আরও পুরনো কোনও মমি আবিষ্কৃত হয়, তবে তুতেনখামেনের অনতিপূর্বে সিংহাসনে কে ছিলেন– এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে।

আরও পড়ুন: মিথ্যে অপবাদের জেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল এই প্রতিভাবান কবিকে

তুতেনখামেনের পরে কার রাজত্ব?

মাত্র বছরদশেকের মাথায় ১৯ বছর বয়সে তুতেনখামেন রহস্যজনকভাবে মারা যান। তাঁর কোনও বংশধরের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বরং শিলালিপি থেকে জানা যায় আংখসেনামুনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। এই আংখসেনামুন হলেন নেফারতিতির কন্যা। সেই অর্থে নিজের সৎ বোনকেই বিয়ে করেন তুতেন। তাঁদের দু'টি মেয়ে জন্মের পরেই মারা যায়। সেই মেয়েদের মমিও তুতেনের সমাধিতে পাওয়া গিয়েছে। তুতেনের মৃত্যুতে আংখসেনামুন এতটাই বিচলিত হন, যে, হিতিতি রাজ্য, যা বর্তমানে তুর্কি ও সিরিয়া অঞ্চল, সেখানকার রাজাকে চিঠি লিখে ফেলেন। সেই চিঠিতে নিজের জন্য একজন সঙ্গী চেয়েছিলেন, যে রাজত্বের দায়িত্ব ভাগ করে নেবে। রাজ্যপাট ধরে রাখার এ ছিল আংখসেনামুনের শেষ চেষ্টা। নথি বলছে, বিয়ের জন্য হিতিতি যুবরাজ জান্নাঞ্জা-কে প্রেরণ করাও হয়েছিল ইজিপ্ট। কিন্তু যুবরাজ মধ্যপথে নিখোঁজ হয়ে যান।

 

তুতেনখামেনের সমাধি আদতে কার জন্য তৈরি হয়েছিল?

রিভস্‌-সহ অনেক বিশেষজ্ঞের কাছেই তুতেনের সমাধি বাকিদের তুলনায় আকারে ছোট বলে মনে হয়েছে। এর ফলে অনেকেই মনে করেন, সমাধিটি অন্য কারও জন্য সম্ভবত আগেই নির্মিত হয়ে গিয়েছিল। তুতেনের অপঘাতে মৃত্যুতে সেটিকেই ব্যবহার করা হয়। যদিও সমাধিতে বিপুল পরিমাণে ধনরাজি পাওয়া গিয়েছে, চারটি কক্ষের মধ্যে কেবলমাত্র একটির দেওয়ালেই পলেস্তরা ও রঙ পাওয়া গিয়েছে। এই কক্ষটিতেই মমিগুলি রয়েছে। সমসাময়িক অভিজাত সমাধিগুলি তুলনায় অনেক অনেক বেশি পরিপাটি, সুসজ্জিত। রিভস্‌ দেখিয়েছেন, আশি শতাংশেরও বেশি সমাধি পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকী, আখেনাতেনেরটিও তাই। তাই রিভস্‌ মনে করেছেন, এটি খুব সম্ভবত বড় একটি সমাধিই ছিল। পরেরবার ব্যবহারের সময় দেওয়াল তুলে তুতেনের সমাধি আলাদা করা হয়েছে। নব্য আবিষ্কৃত কক্ষগুলির একটিতেই সম্ভবত এর ভূতপূর্ব মালিকের মমি রয়েছে।

 

তুতেনখামেনের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল?

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তুতেনের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল? কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সমাধিটির সম্বন্ধে লব্ধ নতুন তথ্যেও সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। ডিএনএ পরীক্ষা করে পাওয়া গিয়েছে ম্যালেরিয়ার চিহ্ন, এবং সিটি স্ক্যানে পাওয়া গিয়েছে ‘কোহলার’ নামের একটি বিরল হাড়ের অসুখে ভুগছিলেন তুতেন। এই রোগেই তার বাঁ পা-টি ক্রমে বিকৃত হয়ে যায়। তুতেনের সমাধিতে ১৩০ খানা হাঁটার ছড়ি পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যবহৃত। তবে রুহ্‌লি এই দু'টি অসুখের কোনওটিকেই প্রাণঘাতী বলে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মতে, একটা মারাত্মক ফ্র্যাকচারের ফলে মারা গিয়েছিলেন তুতেনখামেন। হাঁটুটি নাকি এত বাজেভাবে ভেঙে গিয়েছিল যে, ওপরের চামড়া ছিঁড়ে হাড় বেরিয়ে আসে। এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্তক্ষরণের ফলেই মৃত্যু হয় তুতেনখামেনের। কারণ তুতেনের মমির একটি পায়ের হাড় বিশ্রীভাবে ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে জীবিত অবস্থায় ভেঙেছিল, এমনটা নাও হতে পারে। মারা যাওয়ার পরেও কোনও কারণে ওই হাড় ভেঙে যাওয়া সম্ভব।

More Articles