দেশভাগের পরের প্রথম পুজো ছিল থমথমে, আজও গায়ে কাঁটা দেয় সেই ইতিহাস শুনলে
চারশো বছর ধরে পাল্টে পাল্টে গেছে বাঙালির উৎসব।
প্রায় দু'বছরের অতিমারীর চোখরাঙানি এড়িয়ে এ-বছরের দুর্গোৎসব দিনপঞ্জি অনুসারে কম-বেশি মাসখানেক দূরে। এদিক-ওদিক উঁকি দিলে চোখে পড়বে পূজাবার্ষিকীর বায়না থেকে আপামর শহরবাসীর নতুন করে সেজে ওঠার কেনাকাটা। কোথাও টিন ঘেরাও করে চলছে মণ্ডপসজ্জার কাজ, ‘থিম’ ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন শিল্পীরা, দিবারাত্র কাজ করছেন শয়ে শয়ে সাধারণ মানুষ, শহরের কুমোরপাড়াগুলির শিল্পীরাও ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছেন প্রতিমা তৈরির অগ্রিম-সহ বায়না, কেউ কেউ অর্থলাভের আশায় চেয়ে আছেন উৎসবের পাঁচটি দিনের দিকে। পরের মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই হয়তো আলোয়, বিজ্ঞাপনে, গানে গা ঢাকা দেবে শহর। ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে মানুষের স্রোত মজবে পূর্ব গোলার্ধের রিও কার্নিভালে।
২২ অগাস্ট নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে পুজোকমিটির উদ্যোক্তা-কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবারের প্রাক-পুজো বৈঠকে মূলত নজর ছিল পুজোকমিটিগুলিকে রাজ্যের তরফে দেওয়া সরকারি আর্থিক অনুদান ঘোষণার দিকেই। বিগত কয়েক বছর ধরেই কলকাতা-সহ জেলার বিভিন্ন নথিভুক্ত পুজোকমিটি ও উদ্যোক্তাদের ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দিচ্ছে রাজ্য সরকার। এই বৈঠকে সেই অনুদান আরও ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাজুড়ে প্রায় ৪৩ হাজার নথিভুক্ত দুর্গোৎসব উদ্যোক্তা ও ক্লাব-কমিটিগুলি অনুদান পাবে ৬০ হাজার টাকা করে, এর পাশাপাশি ১ সেপ্টেম্বর থেকেই পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে যাওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ৮ অক্টোবর হবে পুজো কার্নিভাল এবং ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে সরকারি ছুটি। গত বছর ১৫ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত আবহমান বিশ্বসংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত ইউনেসকো-র আন্তঃসরকারি কমিটির ষোড়শ সম্মেলনে, কলকাতার দুর্গাপুজো 'মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য'-র তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৩ থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা তপতী গুহঠাকুরতা গবেষণা করছেন কলকাতার দুর্গোৎসবের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে, শোনা যাচ্ছে, তিনিই কিছু ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে ইউনেসকো-র অধিবেশনের পূর্বে আবেদন করেন। বাঙালির ‘রিও কার্নিভাল'-এর এরকম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্তির জন্য, আগামী ১ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী ইউনেসকোকে ধন্যবাদ জানাতে শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে জোড়াসাঁকো থেকে রানি রাসমণি রোড পর্যন্ত মিছিলের ডাক দিয়েছেন।
যদিও এসবকিছুর পাশাপাশি রাজ্যে পুজোকমিটি-ক্লাবদের সরকারি অনুদান একলাফে ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়া নিয়েও যথেষ্টই বিতর্ক দানা বেঁধেছে। রাজ্যের শিক্ষা ও গবেষণাখাতে অর্থনিয়োগের অবস্থা তথৈবচ, এসএসসি-টেট দুর্নীতি নিয়েও সরগরম রাজ্য রাজনীতি, রাজ্যজুড়ে সরকারি স্কুলগুলিতে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ টাকাও সব মিলিয়ে ১০ টাকার গণ্ডি পেরোয়নি, বকেয়া রয়েছে বহু সরকারি কর্মীর মহার্ঘ ভাতা, কিছুদিন আগেই প্রায় তিনটি বছর পেনশন না পেয়ে আত্মঘাতী হলেন ঐতিহ্যবাহী হেয়ার স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ‘শিক্ষারত্ন’(২০১৯) সুনীলকুমার দাস। রাজ্য সরকারের তরফে অনুদান বৃদ্ধির ঘোষণার পর, খাতায়-কলমে দেখা যাচ্ছে এতে রাজ্যের মোট ব্যয় হতে পারে প্রায় ২৫০ কোটি টাকারও বেশি। এর বিরুদ্ধে ২৪ অগাস্ট কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হয়েছে জনস্বার্থ মামলা, একটি আইনজীবীদের সংগঠনের তরফে, দ্রুত শুনানির আবেদনও জানিয়েছেন তারা। আবেদন শুনানির জন্যও গ্রহণ করেছে কলকাতা হাই কোর্ট। এর পাশাপাশি সংসদীয় বিরোধীদের নানা বক্তব্য সবসময়ের মতোই বাতাসে ভাসছে, অনুদান ঘোষণার পরদিন থেকেই। কেউ কেউ হিসেব তুলে ধরছেন, এই অতিরিক্ত অনুদানে রাজ্যের কতটা আর্থিক সমস্যা দূর হতে পারত, কী কী উন্নতিসাধন সম্ভব ছিল ইত্যাদি। কেউ কেউ সরেজমিনে মনে করছেন, ইডি উপদ্রবকালে এই সংস্কৃতিমরমি প্রচেষ্টা পাহাড়প্রতিম কালো টাকাকে ‘সফেদ’ করে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
আরও পড়ুন: ‘চোর চোর’ রব ঢাকতে পুজোয় কল্পতরু || খড়্গ হাতে উন্নয়ন কোথায় দাঁড়িয়ে?
এবার আসা যাক খানিক অন্য কথায়, একটু পুরনো সময়ের হাত ধরে। শহর কলকাতায় এই উৎসবের বয়স প্রায় চারশো বছরেরও বেশি। জানা যায়, এই বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় পাল ও সেন রাজাদের সময়েই, নবম থেকে একাদশ শতাব্দী নাগাদ। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুপ্রাচীন দুর্গাপ্রতিমার সন্ধান পেয়েছেন বহু ঐতিহাসিক, গবেষক। তবে সম্ভবত এই বাংলায় প্রথম শারদীয় দুর্গাপুজো শুরু হয় বর্তমান বাংলাদেশের তাহেরপুরে। তৎকালীন রাজা কংসনারায়ণ রায়বাহাদুর নামাঙ্কিত কংসনারায়ণ মন্দিরে। ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাজা কংসনারায়ণ স্বয়ং এই পুজোর আয়োজন করেন সম্ভবত স্বপ্নাদেশ পেয়ে। কথিত আছে, এই পুজোর আয়োজনে রাজা কংসনারায়ণের সে-যুগে পুঁজি ছিল প্রায় ৯ লক্ষ টাকার কাছাকাছি, বর্তমান মূল্যে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এরপরই আশ্বিন-কার্তিকের দেবীপক্ষে শারদীয় দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু হয় বাংলায়, যা মূলত ছড়িয়ে যায় হিন্দু বাঙালি জাতির মধ্যেই (বাঙালি সংকর জাতি সেকথা স্মরণে রেখেই বলা, এই জাতির ইতিহাসে ধর্মান্তরণের ঘটনাও রয়েছে বহুল)। প্রধানত বিভিন্ন ধনী, রাজপরিবারে এই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় শারদীয় দুর্গাপুজো বা কোথাও বসন্তকালের দেবীপক্ষে বাসন্তীপুজো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র শারদীয় দুর্গাপুজো শুরু করেন। নতুন রীতি প্রচলন করে তিনি মহালয়া অর্থাৎ দেবীপক্ষের সূচনার দিনটি থেকে যজ্ঞ শুরু করেন, যা চলত টানা মহানবমী তিথি পর্যন্ত। নবদ্বীপ গঙ্গা থেকে আনা হতো পূজার জল। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর নীলকণ্ঠ পাখি এসে বিজয়ার জানান দিত অন্দরমহলে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর দালানে বসত চাঁদের হাট। পেটপুরে সকাল-সন্ধে চলত ভোজন। বর্তমানে এই পুজো জৌলুস হারালেও, আজও দেশ-বিদেশের অতিথিদের ভিড় জমে প্রাসাদ দালানে, বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এই দুর্গোৎসবে। এরপর, চিল্কিগড়ে সামন্তরাজা গোপীনাথ গজসিং দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুরু করেন শারদীয় দুর্গোৎসব। বর্তমান বাংলাদেশের বাঘেরহাট, রাজশাহি, নোয়াখালি, কলকাতার বড়িশা, শোভাবাজারে বিপুল জাঁকজমকে শুরু হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। ধনী বনেদি বাড়ি থেকে ঔপনিবেশিক তাঁবেদার-জমিদারদের বাড়ির দুর্গোৎসবগুলি ছিল আশপাশের গ্রামের মানুষদের কাছে এক একটি আশ্চর্য। দিবারাত্র পাত পেড়ে ভোজন, ব্রাহ্মণ ভোজন, কাঙালিভোজন, বস্ত্রদানে ঝরনার ন্যায় অর্থ ব্যয় করতেন সেই সময়ের ধনী-ধার্মিক শ্রেণি।
তবে কলকাতায় প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হয় সম্ভবত সপ্তদশ শতকের পূর্বভাগে। ১৬১০ সাল নাগাদ রাজা সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার, বড়িশায় (বর্তমান বেহালায়) তাঁদের আদি বাসভবনে এই পুজো শুরু করেন। বর্তমানে এই পরিবারের সাতজন শরিক সাতটি পুজোর আয়োজন করে থাকেন। ছয়টি বড়িশায় ও একটি বিরাটিতে। ভবানী রায়চৌধুরীর 'বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা' বইটিতে এই পুজোর সূচনাকালীন ইতিহাসের সুবিবরণ পাওয়া যায়। এরপরই উল্লেখযোগ্য দুর্গোৎসব হিসেবে নাম নিতে হয় তৎকালীন কলকাতার কেন্দ্রে শোভাবাজারের রাজবাড়ির। এই বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনায় যে পুজো আয়োজনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। শোনা যায়, বাংলার নবাব সিরাজের ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে পতনের পর, এই ঘটনা উদযাপনের উদ্দেশ্যে এই পুজো আয়োজিত হয়, মূল অতিথি হিসেবে এসেছিলেন লর্ড ক্লাইভ, তিনি চেয়েছিলেন পলাশির যুদ্ধে নবাবদের পতনের পর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে, নবাবরা কলকাতার একটিমাত্র চার্চও ধ্বংস করে দিলে, তা সম্ভব হয় না। গরু-শূকরের মাংস, মদ, বাইজি নাচ, অর্থের ফোয়ারা-সহ কিছুই বাদ ছিল না শোভাবাজারের রাজবাড়ির দালানে। সেসময় নবাবের বিরুদ্ধে রাজা নবকৃষ্ণ দেব ছিলেন কোম্পানির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, রাজবাড়ির এই পুজোও ‘কোম্পানির পুজো’ হিসেবেই পাওয়া যায় ইতিহাসেও। তাঁর আয়োজিত এই দুর্গাপুজো তখন কলকাতার ধনী-বনেদি-প্রতিষ্ঠিত পরিবারগুলির কাছে একটি মাইলফলকের মতো হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ মালিকের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ধনী জমিদার শ্রেণির মধ্যে প্রাদেশিক রাজা হয়ে ওঠার লালসা জন্মে। নবকৃষ্ণ দেবের নির্দেশিত পথেই, ধনী জমিদার, রাজারা তৎকালীন প্রেক্ষিতে সামাজিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে শুরু করেন দুর্গাপুজো। স্পষ্টত বলা চলে, সাদা চামড়ার আনুগত্য এবং লক্ষ্মীর বসতি পাকা করতেই এই শ্রেণির অস্ত্র হয়ে ওঠে দুর্গাপুজো। এখনকার পুজোগুলির মধ্যেও নানা ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার সূত্রপাত সেই সময়েই। ব্যাপারটা ছিল অনেকখানা বাড়ির সত্যনারায়ণ পুজোয় প্রবাসী ভারতীয় বস-কে আমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর মতো। তাতে পাড়াপড়শির কাছে যেমন ইজ্জত বাড়ে, বসের গুড বুকেও তেমন নাম পাকা হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঠাকুর পরিবার এবং শিবকৃষ্ণ দাঁ-দের গন্ধবণিক পরিবারের দুর্গাপুজোর গল্প। এই দু'খানা পুজোই ছিল সেই সময়ের নিরিখে ‘বড় বাজেটের' পুজো। প্রতিমার সোনার গয়না, দামি রত্নের মুকুট থেকে শুরু করে ঘটা করে লোক খাওয়ানো কিছুই বাকি ছিল না। এমনকী, সাহেবদের মনোরঞ্জনের জন্য পুজোর ক'দিন অনুষ্ঠানে নাচের মুর্শিদাবাদ, লখনউ থেকে নাচিয়েদেরও নিয়ে আসা হতো জমিদারবাড়িতে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময় আবার চরিত্র পালটায় দুর্গাপুজো। এতকাল যা ছিল শ্বেতাঙ্গদের মনোরঞ্জনের কারণ, হঠাৎই ভূমিকা পালটে তা হয়ে ওঠে ইংরেজ বিরোধিতার অন্যতম অনুঘটক। ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর এই সময়ে বাড়ির মেয়ের খোলস বদলে দুর্গাকে যেন দেশমাতার ভূমিকাতেই বেশি করে ভাবতে চেয়েছিলেন অনেকে। অবশ্য শুধু দেশমাতা বললে ভুল হয়, ইংরেজদের শাসন থেকে দেশ বাঁচাতে একদিকে দেবী দুর্গাই হয়ে ওঠেন শক্তির প্রতীক, আবার অন্যদিকে দুর্গাই হয়ে ওঠেন দেশ। দেশ মানে মাতৃভূমি, মায়ের ভূমিকে রক্ষাই যেন হয় বিপ্লবীদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান এবং লক্ষ্য। ইতিহাসবিদদের মতে, দুর্গার এই চরিত্র বদলের পিছনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আনন্দমঠ'-এর (১৮৮২ সালে লেখা) ভূমিকা অসামান্য। সন্ন্যাসী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসেই দুর্গাকে, বা বলা ভাল শক্তির বিভিন্ন মৃন্ময়ী রূপকে আন্দোলনকারীরা কীভাবে দেশের সঙ্গে একই স্থানে রাখছেন, তা একেবারেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে ইংরেজ শাসনের আগের দেশের রূপ, কালীর সঙ্গে বর্তমান দেশের হাল এবং আসলে আমাদের দেশের কী হওয়া উচিত তার রূপ দুর্গার প্রতিমার মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেন ঔপন্যাসিক বঙ্কিম। উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতরম' গান পূর্বতন স্বদেশি বিপ্লবীদের লড়াইয়ের অন্যতম মন্ত্রও হয়ে ওঠে। বাঙালি-চালিত প্রেসগুলিতে দুর্গাপ্রতিমার ছবির ওপর বহু দেশাত্মবোধক গান ছাপা হওয়ার নিদর্শনও পাওয়া যায়। সেই সময়েই লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে বিভিন্ন পত্রিকায় পুজো-বিষয়ক লেখাতেও দুর্গার এই দেশমাতায় বিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ইংরেজদের শাসনে দেশমাতার সন্তানদের দুর্বিষহ যাপন, খরা, বন্যা এবং দুর্গতি থেকে মুক্তির জন্য দুর্গতিনাশিনী হিসেবে দুর্গার উল্লেখ ১৯০৩ সালে প্রকাশিত পত্রিকা ‘বেঙ্গলি’ থেকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলিতেও।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরেই সম্ভবত দুর্গাপুজোয় গুরুত্বপূর্ণ বদল আসে। স্বদেশি আন্দোলনের ব্যপ্তি বাড়াতে এই উৎসবই বিপ্লবীদের কাছে হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। প্রায় প্রতিটা পুজোর বিজ্ঞাপনেই নজরে আসে ‘নাথিং বিদেশী, এভরিথিং স্বদেশী' জাতীয় ‘পাঞ্চলাইন’। সকলের জন্য এবং সকলকে নিয়ে সর্বজনীন দুর্গাপুজোর ধারণাটিও শুরু হয় এই সময় থেকেই। বলা হয়, উত্তর কলকাতার মানিকতলাতেই প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজোর শুরু, সেই সময় যার ডাকনাম ছিল ‘কংগ্রেস পুজো'। এমনকী, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় জেলের মধ্যে থেকেও বিপ্লবীদের দুর্গাপুজোর আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন, এমন উদাহরণও রয়েছে প্রচুর। ১৯২৫-এর সেপ্টেম্বর মাস, জেলে বসেই বন্ধুকে চিঠি লেখেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। জানান, জেলের মধ্যে থেকেও পুজোর আয়োজনের অনুমতি মিলেছে। সেই সময়ে পুজো কেন্দ্র করে লাঠিখেলার মতো প্রদর্শনী চালু হয়। যা আদতে বিপ্লবীদের অনুশীলনেরই অঙ্গ ছিল। সেই প্রথা মেনে আজও বাগবাজারে অষ্টমীর দিন বীরাষ্টমী পালন হয়। স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোয় প্রতিমাকে তখন খাদি বস্ত্র পরানো হতো। পুতুল ও অন্যান্য খেলার প্রদর্শনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হতো।
এরপর স্বাধীনতা ও দেশভাগের গা ধরেও দুর্গোৎসব এগিয়েছে সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবেই। ভাঙা বাংলায় কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজোর কাহিনিও যথেষ্ট রোমহর্ষক। ১৩ অক্টোবর, সাল ১৯৪৭। দু'-মাসও সম্পূর্ণ হয়নি দেশভাগের। দেখতে দেখতে চলে আসে মহালয়া, উৎসবের মরশুম। কিন্তু মানুষের মনে কি উৎসবের হাওয়া বইছিল আদৌ? এই দু’মাস খবরের কাগজ খুললেই কোনও-না-কোনও অশান্তির খবর-সহ আতঙ্ক। ওপার বাংলা থেকে দলে দলে মানুষজন চলে আসছিলেন এপারে। পূর্ববঙ্গের ইতিউতি হামলার খবর। অবশ্য একটা চাপা অশান্তি চলছিল গতবছর থেকেই। আগস্টে কলকাতায় দাঙ্গা হল, তারপর নোয়াখালি-সহ আরও কত জায়গায়। দেশভাগের পর আক্রোশ বাড়ল বই কমল না। রোজই কিছু-না-কিছু লেগেই আছে ওপারে। আর এসবের মধ্যেই চলে এল পুজো। পুজোর মেজাজ নিশ্চয়ই ধরা থাকার কথা সংবাদপত্রেও! কিন্তু কোথায় কী! 'যুগান্তর'-এর প্রথম পাতার হেডলাইন— ‘বহু মুসলমান ও মন্ত্রিসভার সদিচ্ছা সত্ত্বেও পূর্ব্ববঙ্গে অশান্তির আতঙ্ক’। যেমন মহালয়ার পরের দিনের কাগজটি, ১৪ অক্টোবর, ১৯৪৭। একটি খবরের শিরোনাম— ‘দুর্গাপূজা ও বকর ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় শান্তিরক্ষার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা’। খবর থেকে জানা যায়, ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্যোগে একটা মিটিং আয়োজিত হয়েছিল। সেই মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যেক বছরের মতো এ-বছরও হিন্দু বাড়িগুলিতে নির্বিঘ্নেই দুর্গাপুজো হবে। সেই পরিস্থিতিতে অন্যতম চ্যালেঞ্জের বিষয়টি ছিল, সাম্প্রদায়িক শান্তি স্থাপন ও তা বজায় রাখা। 'যুগান্তর'-এ প্রথম জাতির উদ্দেশে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল চক্রবর্তী রাজাগোপালচারীর মুদ্রিত বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, "শারদীয় পূজার এই পক্ষকাল আনন্দ ও সম্প্রীতির আনন্দ ও সম্প্রীতির আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠুক, শান্তিই যে কাম্য বাঙ্গলা পুনরায় তাহা সর্ব্বজনসমক্ষে ঘোষণা করুক।" ঠিক তার পাশের কলামেই দেখা যাচ্ছে ময়মনসিংহে ‘অপ্রীতিকর ঘটনা’-র উল্লেখ। খুলনায় প্রতিমা ভাঙার খবর। ছয় নম্বর পাতায় যশোহর জেলার মুসলিম নেতৃবৃন্দের আবেদন— "২০শে অক্টোবর হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উৎসব শারদীয় পূজা আরম্ভ হইতেছে ও ২৪শে শেষ হইবে। ২৫শে আমাদের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কোরবানীর দিন ইদুজ্জোহা। পূজা ও ইদুজ্জোহার দিন আমাদের দুই সম্প্রদায়ের মিলনের দিন হিসাবে উদযাপন করা প্রয়োজন।" ভাঙা বাংলায় এরকমই পরিস্থিতিতে পথ চলা শুরু করে বাঙালির আবেগের এই ‘রিও কার্নিভাল’। স্বাধীনতার পরের বছরগুলিতেও এই বাংলার তথা এই শহরের সমাজজীবন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথেই তালে তাল মিলিয়েই বিবর্তনের দিকে গেছে দুর্গোৎসব।
আরও পড়ুন: ২,৫০০ টাকার দুর্গাপুজোর জাঁকজমক চোখ ধাঁধিয়ে দিত, সেই কলকাতা ধরা আছে প্রবাদে
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-র নেতৃত্বে বামপন্থী আন্দোলন পাঁচ থেকে ছয়ের দশকে শহরে শক্তি সংগ্রহ করে, বিশেষত শিল্প-শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের তৎকালীন দুর্দশা থেকে মুক্তি ও তাদের স্থায়ী ঠাঁই পাওয়ার সংগ্রামের সঙ্গে। এই সমস্ত সংগ্রামগুলি একটি বৃহত্তর, সম্মিলিত উদ্দেশ্যর জন্য 'নিঃস্বার্থ' কাজ, ত্যাগ এবং আত্ম-নিষ্পাপের একটি বাগধারার মধ্যে আবদ্ধ ছিল, খুব প্রাথমিকভাবে বলতে গেলে। সুতরাং, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তে কারণগুলিই জনসাধারণের সামনে অগ্রসর হয়েছিল। দুর্গাপুজো উদযাপনের ক্ষেত্রেও পাড়ার (পাড়ার সম্প্রদায়) পুজোর আয়োজকদের পরিচয় পাড়া থেকে আলাদা ছিল না কখনওই। প্রতিবেশীদের প্রাধান্য দেওয়া ও সামাজিক সংহতি এবং পুজোর মাধ্যমে এর পরিচয় তুলে ধরাই ছিল অন্যতম উদ্দেশ্যের দিক।
পাড়া কী এবং কেন পাড়ার পূজা বা সর্বজনীন দুর্গোৎসব (সবার জন্য দুর্গাপূজা) এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? পাড়া একটি সমজাতীয় সম্প্রদায় বা কেন্দ্রীভূত এলাকা ছিল না। কারিগরদের প্রাথমিক বসতি থেকে পাড়াগুলির নাম ও চরিত্র লাভ করে। বৃহত্তর বসতিগুলি ছিল টোলা এবং একটি ছোট এলাকা নিয়ে গঠিত হতো টুলি, উদাহরণস্বরূপ কুমোরটুলি, যেখানে মৃৎশিল্পীরা বাস করে এবং কাজ করে। একইভাবে, একটি নির্দিষ্ট এলাকার ব্যবসায়ীদের বসতিগুলিও পাড়া নামে পরিচিত ছিল, যেমন দর্জিপাড়া (দর্জিদের বসতি বা পাড়া), তেলিপাড়া (তেলি বর্ণের লোকদের বসতি), কাঁসারিপাড়া (ধাতব ব্যবসায়ীদের বসতি) ইত্যাদি। সামাজিক এই মিথষ্ক্রিয়াজনিত ম্যাপিং হয়েছিল। এই একত্রে বসবাসের রীতি ও বাসিন্দাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংহতি প্রদান এই পাড়া গড়ে ওঠার অন্যতম দিক ছিল এই শহরে।
গত শতকের ছয়ের দশকের শেষের দিকে এবং সাতের দশকের গোড়ার দিকে যখন মাওবাদীরা সংসদীয় বাম দলগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি কৃষি বিপ্লবের ডাক দেয়, তখন শহরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং তাই এটি প্রদর্শনীমূলক শাস্তির জন্য একটি উপযুক্ত স্থান হিসেবে ভাবা শুরু হয়। শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকদের একটি ছোট অংশের মধ্যে, ধর্মীয় উৎসবগুলিকে তুচ্ছ বলে প্রত্যাখ্যান করার এবং কুসংস্কারের উচ্ছ্বাসের বিপরীতে ধাবিত হওয়ার সময় এসেছিল। তাদের হস্তক্ষেপের সামগ্রিক প্রভাব প্রান্তিক হলেও, এটি পুজো উদযাপন এবং উৎসবের সঙ্গে দরিদ্র-অভাবীদের প্রয়োজনের পরিচর্যার মতো সংশ্লিষ্ট সামাজিক সেবার দৃঢ়তাকে প্রাধান্য দিয়েছিল। এটিও সেই সময় সংসদীয় বাম দলীয় সাহিত্য বিক্রির জন্য ত্রিপল-চালা স্থাপনের মাধ্যমে পুজোর প্রকাশ্য স্থান রাজনৈতিক প্রচারের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল।
এই ধরনের পরোক্ষ অংশগ্রহণ সত্ত্বেও, বাম দলের কর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে পুজোর ধর্মীয় উৎসব থেকে তাঁদের দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। রাজ্যে দীর্ঘ ২৫ বছরের বাম শাসনের পরে এই দূরত্বটি লঙ্ঘন হওয়ার প্রয়াস চোখে পড়ে, বামফ্রন্ট সরকার অবশেষে তার নেতাদের জনপ্রিয়তার স্বীকৃতিতে পুজো উদ্বোধন করার অনুমতি দেওয়া শুরু করে। এই দেরি অবশ্যই কিছু বাম নেতাদের তাদের স্থানীয় পুজোর ‘কত্তা’-স্থানীয় হয়ে থাকতে বাধা দেয়নি। তদুপরি, আটের দশক থেকে সম্প্রদায়ের পুজোর ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিকীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে, বিখ্যাত শহরের পুজোর জন্য বিজ্ঞাপন এবং স্পনসরশিপের মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিলের অনুপাত স্থানীয় চাঁদা থেকে সংগৃহীত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি হতে শুরু করে। বিজ্ঞাপন এবং কর্পোরেট স্পনসরশিপ পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সহায়তা অপরিহার্য বলে মনে করার সময়ও এটিই। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সুপ্রতিষ্ঠিত কর্পোরেট একজিকিউটিভরা সাম্প্রদায়িক পুজোর তহবিলের জন্য অনন্য এক মাধ্যম হয়ে ওঠার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হয় এই সময়েই।
মাতৃদেবীর মূর্তি বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, বংশধরদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, বাঙালির দুর্গাপুজোর ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিমাকে এক চালচিত্রে একটি যৌগিক পটভূমিতে চিত্রিত করা হয়েছিল। নতুন ধারার পুজোয়, প্রতিমায় বদল এলে, মায়ের বংশধররা ব্যক্তিগত চালচিত্রর ছাউনিতে চলে যায়। প্যান্ডেলের স্থানও প্রসারিত করতে হয়েছিল। প্যান্ডেলগুলির আলংকারিক ধরনগুলিও বিস্তৃত হয়ে ওঠে এবং বিভিন্নতা পায়। সারা ভারতের সুপরিচিত মন্দির এবং উপাসনালয়ের ধাঁচ নেয়। শীঘ্রই কেবল মন্দিরই নয়, এমনকী, সাঁচি স্তূপ, একটি সুমেরীয় প্রাসাদ, ট্রেভিসের ফোয়ারা বা ল্যুভরের মতো স্মৃতিস্তম্ভ বা আইকনিক পাবলিক ভবনগুলিও প্যান্ডেলগুলিতে চিত্রিত করা শুরু হয়েছিল।
তোষামোদের আয়োজন থেকে বিপ্লবের সঙ্গে সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্তির পন্থা বা কর্পোরেট বাজার নির্ধারক উৎসব হিসেবে দুর্গাপুজোয় বিবর্তনের আঁচগুলো নিঃসন্দেহে স্পষ্ট। তবে নেহাতই এই সময়ের প্রেক্ষিতে পুজো নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যদি বলা হয়, তোষামোদ এবং তাঁবেদারির উদ্দেশ্যই কেমন যেন মুখ্য হয়ে উঠছে দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে আবারও, এই একবিংশ শতাব্দীতেও- তবে খুব একটা ভুল হবে না হয়তো। শাসক বদলালে উৎসবেরও চরিত্র বদল হয়, হয়েছে ইতিহাসের স্রোতেই। ক্লাইভকে তুষ্ট করা হোক বা জমিদারিত্ব পাকা করতে টেক্কা দেওয়া ঝাড়লণ্ঠন আর দামি আয়োজন কোথাও যেন ঘুরেফিরে মিশে যাচ্ছে এইসময়ের থিম-টক্কর, স্পনসরশিপ-টক্করের সঙ্গে। শাসকের মুখের ওপর কখনও সুপার ইম্পোজ হতে থাকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের আদল, কখনও বা বর্তমান রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডার রঙ। গল্প আসলে একই। বহুকালের শিকড়ওয়ালা, ঐতিহ্যবাহী উৎসব, পোশাক বদলে ক্রমে হয়ে উঠছে কার্নিভাল, থিতিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা।