যৌনকর্মীদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে খুন, জ্যাক দ্য রিপারের রহস্যের সমাধান আজও হয়নি
Jack The Ripper Serial Killer : সিরিয়াল কিলিংয়ের ইতিহাসে কার্যত মিথ হয়ে আছে এই রহস্যময় মানুষটি। জ্যাক দ্য রিপার – এই নামটি আজও মানুষের গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়।
সাল ১৮৮৮। দিনটা ৩১ আগস্ট, শুক্রবার। ভোর হতে আর হাতে গোনা কয়েকটা ঘণ্টা বাকি। লন্ডনের পাথুরে রাস্তায় আবারও নেমে পড়বে সাধারণ মানুষ। ভিড় বাড়বে, ব্যস্ততাও। ভোর রাতের দিকে নিয়মমাফিক টহল দিতে বেরিয়েছিলেন এক পুলিশ। সেরকম কিছুই নয়, ওই আর কি একটু চারদিক দেখে নেওয়া। এমনিতেও এখন মানুষেরা গভীর ঘুমে মগ্ন। রাস্তার আলো আঁধারির পরিবেশ যতই মনে ভয় ধরাক না কেন, এখন সেরকম বিশেষ কিছু নেই। একটু পরেই দুধওয়ালা, কাগজ বিক্রেতারা বেরিয়ে পড়বে পথে। ব্রিটিশদের সাধের লন্ডন বলে কথা! তাকে একটু দেখে রাখতে হবে না।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি যাওয়ার কথাই ভাবছিলেন ওই পুলিশ কনস্টেবল। একটু বিশ্রাম নেবেন, প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে সময় কাটাবেন। আগামী মুহূর্তগুলোর পরিকল্পনাই করছিলেন। কিন্তু ভাগ্যদেবতা বোধহয় অন্যকিছুই ভেবে রেখেছিলেন সেদিন। ওই কনস্টেবল কল্পনাও করতে পারেননি, এরপর যা ঘটবে তার হদিশ পেতে পেতে ইতিহাসেরও কালঘাম ছুটে যাবে। আর লক্ষ লক্ষ মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাবে ঠাণ্ডা স্রোত।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখেন, একটু দূরে রাস্তার ওপর কেউ একজন শুয়ে রয়েছেন। এ আবার কি ঝামেলা! নিশ্চয়ই মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে রয়েছে কেউ! গজগজ করতে করতে সেদিকে এগিয়ে গেল ব্রিটিশ পুলিশটি। টর্চের আলো জ্বালাতেই কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, চিৎকার করার কথা কিন্তু আওয়াজ বেরোচ্ছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সামনে পড়ে থাকা লাশটার দিকে। জ্বলজ্যান্ত এক মানুষ, সুন্দরী এক তরুণী। ছুরির এক কোপে গলাটা ফাঁক হয়ে গিয়েছে তাঁর। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তবে আসল দৃশ্য তারপরে। তরুণীর তলপেট ছুরি দিয়ে ফালাফালা করা, যেন সেখানে খোদাই করে রক্ত মাংস ঘেঁটে কেউ কিছু নিয়ে গিয়েছে।
একটু একটু করে লোকের সংখ্যা বাড়ল। আর এই খুনের খবর গোটা লন্ডনে ছড়িয়ে পড়ল। এমন নয় যে, খুন একেবারেই হয় না এই শহরে। কিন্তু এমন বীভৎসভাবে হত্যা! কিন্তু কে খুন করল? নিহতের পরিচয়ই বা কী? লাশ নিয়ে যাওয়ার পর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হল। জানা গেল, তরুণীর নাম মেরি অ্যান নিকোলস। পেশায় এক যৌনকর্মী। আরও জানা গেল, খুনি ছুরি চালনায় বেশ দক্ষ। আর মেরির তলপেট ছিন্নভিন্ন করে তাঁর জরায়ু কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! বর্ণনা শুনে গোটা লন্ডনবাসীর হাড় হিম হয়ে গেল। কিন্তু ঘটনা যে এখানেই শেষ হয়নি, সেটা তখনও কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি।
এরপর পুলিশের কাছে বেশকিছু চিঠিও আসতে লাগল। যেখানে সরাসরি তাদের চ্যালেঞ্জ করে বলা হয়, পারলে আমায় ধরে দেখাও। এভাবে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস কে দেখায়! বেশিরভাগ চিঠির তলায় একটাই নামের সই থাকত। তখন কে জানত, এই নামটি পৃথিবীর ইতিহাসে চিরকালের জন্য রয়ে গেল! এরপর আরও অনেক খুন হয়েছে পৃথিবীতে। অনেক সিরিয়াল কিলারও এসেছে। অনেকেই ধরা পড়েছে, কেউ কেউ এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সিরিয়াল কিলিংয়ের ইতিহাসে কার্যত মিথ হয়ে আছে এই রহস্যময় মানুষটি। জ্যাক দ্য রিপার – এই নামটি আজও মানুষের গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়।
১৮৮৮ সালের ৩১ আগস্টের পর কেটে গিয়েছে বেশ কিছুটা দিন। পুলিশ নিজেদের মতো করে তদন্ত প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। ৮ সেপ্টেম্বর, শনিবার পুলিশের কাছে ফের একটি খুনের খবর আসে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, মেরি অ্যানের দেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছে, প্রায় একই এলাকায় এই দ্বিতীয় লাশটিও পাওয়া যায়। এখানেও ছুরি দিয়ে গলায় গভীর আঘাত করা হয়। তারপর তলপেটের নিচ থেকে ফালাফালা করা হয়েছে সবটা। শরীরের ভেতর থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে জরায়ু। জানা গেল, নিহত মেয়েটির নাম অ্যানি চ্যাপম্যান। এবং আরও একটা ব্যাপার। অ্যানিও ছিল একজন যৌনকর্মী।
অদ্ভুতভাবে, দুটো ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য পুলিশকে ভাবিয়ে তুলল আরও। তাহলে কি এটা কোনও সিরিয়াল কিলারের কাজ? জ্যাক দ্য রিপার নামটিও একটু একটু করে সামনে আসে। কিন্তু তার পরিচয় কী, সেটা জানা যায়নি তখনও। তবে অ্যানি চ্যাপম্যানের হত্যার ক্ষেত্রে নতুন একটি তথ্য পাওয়া গেল। দেহ পাওয়ার মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে নাকি দেখা গিয়েছিল তাঁকে। মাথায় উসকোখুসকো চুল, কিন্তু তাঁর চেহারা কেউ দেখেননি। আপাতত এটুকুই ছিল পুলিশের সম্বল।
সিরিয়াল কিলিং একটি বিশেষ ধরনের অপরাধ। সাধারণ পদ্ধতিতে এর সমাধান সচরাচর করা যায় না। খুনি যদি ধুরন্ধর হয়, তাহলে তাঁকে বাগে আনা খুবই মুশকিল। কিন্তু সব জায়গায় একটাই কথা বলা হয়। কখনও না কখনও সে একটা ভুল করবেই। একটা সূত্র কোথাও থেকে যাবে, পরিকল্পনায় ফাঁক থাকবে। সেটাই সুযোগ তাকে ধরার। কেবল পূর্ব লন্ডন নয় গোটা শহর জুড়ে তল্লাশির পাশাপাশি পুলিশ ওঁত পেতে থাকে সেই মুহূর্তের।
তারই মাঝে চলে আসে ৩০ সেপ্টেম্বর। পুলিশের কাছে ফের খবর পৌঁছয়, দেহ পাওয়া গিয়েছে এবার। তবে এখন একটা নয়, পরপর দুটো! এলিজাবেথ স্ট্রাইড ও ক্যাথারিন এডোজ নামের দুই মহিলার ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায়। এলিজাবেথের ক্ষেত্রে কেবল কাঁধের পাশে ছুরির নিখুঁত কোপ, ব্যস আর কিছু নয়। আর ক্যাথারিনের ক্ষেত্রে ছবিটা আগের মতোই। গলা কাটা, তলপেটের নিচের দিকটা ছিন্নভিন্ন। সেইসঙ্গে জরায়ু ও কিডনি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও দেহ পাওয়া যায় ভোরবেলায়। আর এলিজাবেথ, ক্যাথারিন দুজনেই যৌনকর্মী ছিলেন।
এবার পুলিশ নিশ্চিত হয় জ্যাক দ্য রিপারের ব্যাপারে। মূলত যৌনকর্মীরাই তাঁর টার্গেট, এবং সবকটা খুনই সে করেছে ভোররাতের দিকে। এক্ষেত্রে পুলিশের ধারণা ছিল, ক্যাথারিনকে আগে হত্যা করে তারপর এলিজাবেথকে মারা হয়েছে। সেজন্যই তাড়াহুড়োয় তলপেট অক্ষত রয়েছে। কিন্তু যেভাবে নিখুঁত হাতে ছুরি চালানো হয়েছে, যেভাবে অঙ্গ বের করে নেওয়া হয়েছে, তাতে অনেকেরই সন্দেহ হয়, এটা কোনও ডাক্তারের কাজ। এখানেও জানা যায়, মৃত্যুর আগে ক্যাথারিনকে শেষবার এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা গিয়েছিল, যার চুল উসকোখুসকো।
শুরু হল তল্লাশি অভিযান। সন্দেহজনক ব্যক্তিকে দেখলেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের ওই এলাকার চারিদিকে নজরদারি বাড়ানো হয়। রাস্তাঘাটে, বিশেষ করে ভোররাতে তক্কে তক্কে থাকে পুলিশ। এরপর এক্মাস সেভাবে কিছু হয়নি। পাঁচ নম্বর ঘটনাটি ঘটল ১৮৮৮ সালের ৯ নভেম্বর। এবার রাস্তায় নয়, খোদ ঘরের ভেতর একজনের লাশ পাওয়া গেল। আর ভোররাত নয়, সকাল ১১টা নাগাদ আবিষ্কার করা হয় মেরি কেলির দেহ। জ্যাক দ্য রিপারের সবথেকে ভয়ানক খুন ছিল এটি। মেরি কেলির বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। গলা নিখুঁতভাবে কাটা, তারপর মেরুদণ্ড অবধি সেটি বিস্তৃত হয়েছে। তলপেট ছিন্নভিন্ন, শরীরের ভেতরে কিচ্ছু নেই। এমনকী হৃদপিণ্ডটিও কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! এবং মেরি কেলিও ছিলেন একজন যৌনকর্মী।
হত্যার এই বর্ণনা শুনে অনেকেই অতিকষ্টে বমি আটকে রেখেছিলেন। মানুষ এতটা নৃশংস হতে পারে? তখন থেকেই জ্যাক দ্য রিপারকে নিয়ে অজস্র মিথ, গল্প, রহস্য শুরু হল। না, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও পারেনি তাকে ধরতে। মেরি কেলির মৃত্যুর পরও আরও ছয়জন মহিলা মারা গিয়েছিলেন লন্ডনে। পদ্ধতি মোটামুটি একই ছিল। কিন্তু সবগুলোই জ্যাক দ্য রিপারের কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। এমনও হতে পারে, জ্যাক দ্য রিপার কোনও একজন ব্যক্তি নয়। প্রথম পাঁচটি খুনের বর্ণনা শুনে আরও অনেকে সেই পদ্ধতিতে খুন শুরু করে। সব মিলিয়ে নিজেই জ্বলজ্যান্ত একটা অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায় জ্যাক দ্য রিপার।
তারপর ১৩০ বছরেরও বেশি পেরিয়ে গিয়েছে। আসল প্রশ্ন এখনও রয়ে গিয়েছে। জ্যাক দ্য রিপার আসলে কে? কী তাঁর পরিচয়? সে কি সত্যিই কোনও ডাক্তার ছিল, না অন্য কেউ? লন্ডন জুড়ে এমন অবস্থা হল যে, রাত হলে বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পেতেন মানুষেরা। পুলিশ অন্তত ২০০০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, ৮০ জনকে জ্যাক দ্য রিপার সন্দেহে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু কোনও জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জ্যাক দ্য রিপারের পরিচয়ও সামনে আসেনি।
কিন্তু এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাকে নিয়ে জল্পনা, গবেষণা থামেনি। একসময় বলা হল, রানি ভিক্টোরিয়ার নাতি প্রিন্স অ্যালবার্ট নাকি জ্যাক দ্য রিপার! পরে বলা হল, জ্যাক দ্য রিপার আসলে এক মহিলা। সম্প্রতি এক বিশেষজ্ঞের দাবি, সেই সময় লন্ডনের এক ইহুদি অভিবাসী অ্যারন কসমিনস্কি নাকি আসলে জ্যাক দ্য রিপার। উল্লেখ্য, এই ব্যক্তিকে সেই সময় গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু তথ্যপ্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়।
তবে বেশকিছু জিনিস পুলিশের নজর এড়ায়নি। প্রথমত, যেভাবে খুনগুলো হয়েছিল, তাতে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে, খুনি মানুষের শরীর আর তার কলকব্জা নিয়ে অনেক কিছুই জানে। দ্বিতীয়ত, জ্যাক দ্য রিপার হয়তো পূর্ব লন্ডনেরই বাসিন্দা এবং সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন। কারণ, খুনের পর সাত তাড়াতাড়ি উধাও তখনই হতে পারবে, যখন কেউ সেই অঞ্চলটিকে হাতের তালুর মতো চিনবে। এছাড়াও, প্রতিটা খুন হয়েছে হয় শনিবার নয়তো রবিবার। অর্থাৎ, বাকি দিনগুলো কাজের জন্য সময় পায়নি জ্যাক দ্য রিপার। তথ্য, তত্ত্ব আর রহস্যের মেঘ এখনও ঘিরে রয়েছে তাকে। সিনেমা থেকে সাহিত্য, সর্বত্র তার যাতায়াত। এমনকী, জ্যাক দ্য রিপারকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েও অনেকে সিরিয়াল কিলিং শুরু করেছিল। ইতিহাসের কুখ্যাততম ও রহস্যময় এই মানুষটি এখনও যেন চেপে বসে আছে।