খেলা, মোক্ষলাভ নাকি কর্মফল? সাপ লুডোর যে ইতিহাস চমকে দেবে
Snake and Ladder Ludo: সাপ সিঁড়ির ইতিহাস এবং ‘মোক্ষপটে’র ধারণা প্রথম সকলের সামনে আসে দীপক সিংখাদার হাত ধরে।
লুডো। ভারতের জনপ্রিয়তম ইনডোর গেম। বসে বসে সময় কাটানো বলতেই এখন চোখের সামনে ফুটে ওঠে সেই চার খোপের বোর্ড। ছুটির দিনে দুপুরবেলা সপরিবারে খেলতে বসে যাওয়া, তারপর এর ওর গুটি খাওয়া, ছক্কার দান, চোট্টামি, খুনসুটি সবই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে। ছোটবেলায় লুডো খেলেনি এমন বাঙালি পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। বাড়ির বয়স্কদের সঙ্গে ছোটরাও মজে যেত এই খেলায়। এখন মোবাইল ফোনেই গুটি খাওয়া, একে ওকে টেক্কা দেওয়া চলে। চরিত্র বদলে বদলে লুডো কিন্তু একই থেকে গেছে। তবে, খেলাটি কিন্তু আজকের নয়, ইতিহাসের অনেক পথ ঘুরে এই খেলা আজকের রূপ পেয়েছে।
লুডো খেলার ইতিহাস
লুডো বা লুডু ল্যাটিন শব্দ লদো থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ল্যাটিন লদো শব্দের অর্থ আই প্লে বা আমি খেলি। লুডু খেলা ষষ্ঠ শতকের মধ্যযুগের একটি খেলা। ভারতীয় পঁচিশি বা পাশা খেলা থেকে এই লুডু খেলার উৎপত্তি। ভারতীয় ইতিহাসে এই খেলাকে কখনও ‘চৌপদ’ আবার কখনও ‘পিচিসি’ আবার কখনও বা ‘চৌজার’ নামে ডাকা হয়। চিনা সংস্করণকে বলা হত ‘চতুষ্পদ’ এবং আফ্রিকায় এটি ‘লুডো’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মহাভারতের সময় থেকেই লুডোর জনপ্রিয়তা। মহাভারতে উল্লিখিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধই হয়েছিল ‘পাশা’ খেলাকে কেন্দ্র করে। মনে করা হয় যে, শকুনি যে ডাইসটি বা ছক্কা দিয়ে চাল দিতেন তার কিছু 'অলৌকিক' ক্ষমতা ছিল যে কারণে তাঁর এবং কৌরবদের জয় নিশ্চিত ছিল। কেবলমাত্র মহাভারতে নয় ঐতিহাসিকদের মতে, মুঘল রাজবংশের সময়ও এই খেলার প্রচলন ছিল। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এই খেলাটির নিদর্শন পাওয়া যায়। সম্রাট আকবরের পছন্দের খেলা ছিল এটি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর নিজস্ব প্রাসাদ ও ফতেপুর সিক্রির প্রাসাদগুলি থেকে।
আরও পড়ুন- পুলিশ কেন ‘আব্বুলিশ’? অভিধানে নেই, কোথা থেকে এল লুকোচুরি খেলার এই চেনা শব্দ
এক জনপ্রিয় পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, লুডোর সঠিক উৎস সম্বন্ধে আজও কিছু স্পষ্ট জানা যায় না। তবে ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, বেশ কিছু গুহার দেওয়ালে লুডো খেলার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই খেলার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় মহারাষ্ট্রের ইলোরা গুহা থেকে। এই গুহার দেওয়ালে চিত্রিত ছিল লুডোর ছক। যদিও ইলোরার গুহায় অঙ্কিত প্রাচীন লুডোর ছবি ও আধুনিক যুগের লুডোর মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই।
প্রাচীন কালে লুডো খেলা হতো হাতে তৈরি কাপড় বা স্লেটের উপরে এবং গুটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হতো বীজ অথবা কোনও কিছুর বাইরের আস্তরণ বা বিভিন্ন আকারের পাথরের। কিন্তু আজকের দিনে লুডোর ক্ষেত্রে বোর্ড, গুটি ও ডাইস ব্যবহৃত হয়। তবে, ডাইস আবিষ্কারের ইতিহাস নিয়ে বহু মতভেদও আছে। ফক্স নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি গবেষকরা লুডু খেলার ডাইসের সঙ্গে রোমান সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনের আবিষ্কার করেছেন। ২৪০০-২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ রাইন নদীর তীরে রোমান সেনাদের একটি ঘাঁটি ছিল এবং সেই এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে গবেষকরা জানতে পারেন, যে ডাইসটি পাওয়া গেছে তা আজ থেকে প্রায় ১৯০০ বছর আগে ব্যবহৃত হতো।
সাপ-সিঁড়ির ইতিহাস
চার খোপের লুডোর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও সাপ-সিঁড়ির জনপ্রিয়তাও বিন্দুমাত্র কমেনি। কথিত আছে, সাপ সিঁড়ির খেলা নাকি আধ্যাত্মিক খেলা, যার ইতিহাস নিয়েও আছে রহস্য। জানা যায় এই সাপ লুডোর উৎস নাকি ভারতে। প্রাচীনকালে এই সাপ লুডোর আদি ভারতীয় নাম ছিল ‘মোক্ষপট’। নীতিশিক্ষা দেবার লক্ষেই নাকি ভারতে সাপ সিঁড়ি খেলা চালু হয়। ছক্কাকে ‘কর্ম’ হিসেবে ধরা হয় আর সাপ আসলে ‘পাপে’র প্রতীক। তার মুখে পড়লে পতন অনিবার্য। আর অন্যদিকে এই মইগুলিকে পুণ্যকর্ম বোঝায়। কর্মফল অনুযায়ী উত্থান পতন নির্ধারিত হয়। ছকের চূড়ান্ত স্থান হল ১০০ নম্বর ঘর – যা পূর্ণতা, সমগ্রের প্রতীক। এখানে পৌঁছতে পারলে মুক্তি সম্ভব। পুরনো দিনের খেলায় কোন কোন সাপের মুখে পড়লে কী কী পতন হবে তা লেখা থাকত। মইয়ের গায়ে লেখা থাকত পুণ্যকর্মের নাম। ১৯০০ বছর আগে ছিল এই সনাতন লুডো খেলা।
সাপ সিঁড়ির ইতিহাস এবং ‘মোক্ষপটে’র ধারণা প্রথম সকলের সামনে আসে দীপক সিংখাদার হাত ধরে। ১৯৭৭ সালে দীপক সিংখাদা নামে এক যুবক শিকাগো শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এক অদ্ভুত ছবির দেখা পান। জাদুঘরের রেজিস্টারে ছবিটি নিয়ে শুধু বলা আছে– ‘রিলিজিয়াস ওয়ার্ক’। ছবিটি দেখে অবাক হওয়ার কারণ ছিল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের উপস্থিতি। তাঁর কাছে এই বিষয়টি ধর্মীয় মনে হলো না বরং তাঁর মনে হলো এর সঙ্গে অন্য কোনও বিষয়ের যোগ আছে। তিনি সত্যিটা জানতে নেপালের মিউজিয়ামে যান এবং গিয়ে জানতে পারেন, এই চিত্রপটের নাম ‘নাগপাশ’। এটি নেপালিদের খেলা, একে তাঁরা ‘বৈকুণ্ঠ খেল’ বলেও অভিহিত করেন।
আরও পড়ুন- দুর্গ, ইতিহাস আর বিলাস যেখানে মাখামাখি, এই শীতে ছুটির গন্তব্য হোক নীল শহর
নেপালে পাওয়া নাগপাশেও রয়েছে ছক। তবে তা আমাদের ছকের থেকে ভিন্ন। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, নেপালের নাগপাশে দু'টি সাপ দেখতে পাওয়া যায়। লাল আর কালো। লাল সাপ শুভ আর সৌভাগ্যের প্রতীক এবং কালো সাপ দুর্ভাগ্যের চিহ্ন। আর নেপালি নাগপাশ শুরু হয় ১ নম্বর ঘর থেকেই। জীবনের পথচলার মতোই শৈশব, যৌবন, জরার পথ ধরে খেলোয়াড়কে এগোতে হয় যা নিয়ন্ত্রণ করে লাল ও কালো সাপ। ৭২ ঘর অতিক্রম করতে পারলেই মোক্ষলাভ সম্পন্ন। শুধু মজা পাওয়ার জন্য আমরা সাপ লুডো খেললেও নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল ভিন্ন। প্রাচীনকালের এই খেলার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার যোগ আছে।
ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করার পর এই খেলাটির প্রতি তারাও বেশ আকর্ষিত হয়ে পড়ে। লুডোর চিন্তা ভাবনা তাদেরকে মুগ্ধ করে। তাই এই খেলায় কিছু বদল আনে ইংরেজরা। ধর্মীয় ভাবনা বাদ দিয়ে নিজেদের কিছু চিন্তা ভাবনা এই খেলায় যোগ করে। ইউরোপ, আমেরিকাতেও এই খেলা ব্যাপক জনপ্রিয়।
মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরেও দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে লুডো খেলা বেশ জনপ্রিয়। আর তা খেলতে হলে প্রয়োজন হয় সেই আদ্যিকালের বোর্ড ও গুটি। আর সঙ্গে থাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মান অভিমান! কিছুকাল হলো মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লুডো খেলা আবার ঘরে ঘরে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একসঙ্গে না থেকেও এখন নানা ভাবে নানা জনের সঙ্গে খেলা সম্ভব। পাশাপাশি বসে বন্ধুর হাত ধরার সময় কই আর?