কে প্রথম প্রচলন করেন ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার? রইল ভাইফোঁটার অজানা কিছু তথ্য

Bhai Phota 2022: মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটা ভাইবিজ নাম প্রচলিত। আবার নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে, অর্থাৎ মূলত পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসবকে ভাইটিকা নামে ডাকা হয়।

”ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।

যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥"


হিন্দুদের মহোৎসবের মধ্যে ভাইফোঁটাও একটি ছোট্টো উৎসব, যেখানে বোনেরা তাঁদের ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে, তাঁদের কপালে চন্দনের বা দইয়ের ফোঁটা দিয়ে থাকে। এর অক্ষরিক নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে অর্থাৎ কালীপুজোর মাত্র দুই দিন পরেই এই উৎসব পালন হয়ে থাকে। সুতরাং এটি বাঙালিদের জন্য বছরের শেষ উৎসব।

ভাইফোঁটা কেন পালন হয়ে সেটা তো সকলেরই জানা কিন্তু প্রশ্ন হল, এই উৎসব কেবল এই সময়েই কেন পালন করা হয়ে সেটা কি আদৌ জানা? এ বিষয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, যম অর্থাৎ ধর্ম ও মৃত্যুর দেবতা এই দিন তাঁর বোন যমুনার বা যমীর ঘরে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান এবং হাতে ফোঁটা নিয়ে এসেছিলেন । তাই এই উৎসবের আরেক নাম যমদ্বিতীয়া। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় তিথির এই শুভক্ষণে ভাইয়ের কপালে তিলক লাগিয়ে ঘরে আমন্ত্রণ করেন যমুনা। সেই দিনে বোন যত্ন করে নিজের হাতে খাওয়ান দাদাকে। বোনের হাতের রন্ধনের স্বাদে এবং আতিথেয়তায় তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে যম এই দিনে যমদ্বিতীয়া প্রচলন করেন। অর্থাৎ এই শুভ দিনে যে সকল ভাইরা তাঁদের বোনের হাত থেকে ফোঁটা নেবে তাঁদের নরক যাত্রা হবে না।

আরও পড়ুন- বাংলায় অবহেলিত পড়ে থাকে দেবী চৌধুরাণীর মন্দির, উপন্যাস যেখানে বাস্তবে নেমে আসে

পৌরাণিক, প্রচলিত গল্পের পাশাপাশি মহাভারতেও এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। নরকাসুর নামে একজন দুষ্ট দানবকে বধ করতে কৃষ্ণ স্বয়ং নগর ত্যাগ করেন। এমতাবস্থায় ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় বোন সুভদ্রা বিশেষ পুজোর আয়োজন করেন। অবশেষে নরকাসুরকে বধ করে যখন কৃষ্ণ দ্বারকায় ফেরেন, দাদার আগমনের খবর পেয়ে বোন অবশেষে পুজো ছেড়ে ওঠেন এবং ভাইয়ের কপালে পুজোর তিলক লাগিয়ে তাঁকে ঘরে বরণ করে নেন সুভদ্রা। বলা হয়, সেই দিনটাও নাকি কার্তিক মাসের দ্বিতীয় তিথি ছিল। মনে করা হয়, সেই কারণেই ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাঁদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে থাকে এবং এই উৎসব সারা দেশে পালন হয়ে থাকে।

তবে এক এক জায়গায় এই উৎসবের এক এক নাম, এক এক ধরন। যেমন মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটা ভাইবিজ নাম প্রচলিত। আবার নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে, অর্থাৎ মূলত পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসবকে ভাইটিকা নামে ডাকা হয়। বিজয়াদশমীর পর এটিই সেখানকার সবচেয়ে বড় উৎসব। 'যমদ্বিতীয়া'র ব্যাখ্যা তো আমরা আগেই পেয়েছি। পশ্চিম ভারতে অনেক রাজ্যে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও প্রচলিত। সেখানে পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসব পালনের পর একেবারে শেষদিনে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালন হয়।

জায়গা ও স্থান অনুসারে, বিভিন্ন পরিবারে বিভিন্নভাবে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানটি প্রবর্তিত হয়ে এসেছে। অনুষ্ঠানের সময়ে বোনরা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে যে ছড়া কেটে থাকে, সেটিও পরিবার বিশেষে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ছড়া কাটার সময়ে বাঙালি ঘরের বোনরা, ভাইয়ের কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে রাখে। অতঃপর, বোন তাঁর ভাইয়ের মাথায় ধান এবং দুর্বা ঘাসের শিষ রাখে। এই সময় শঙ্খ বাজানো হয় এবং উলুধ্বনিও দিতে হয়। এরপর আশীর্বাদের পালা। যদি বোন বড় হন তাহলে বোন ভাইকে আশীর্বাদ করে থাকেন আর যদি উল্টোটা হয়, তাহলে বোন দাদাকে প্রণাম করেন। তারপর নিজের হাতে ভাইকে মিষ্টিমুখ করান এবং দু'জনেই দু'জনকে উপহার দিয়ে থাকেন। ভাইও তাঁর সাধ্যমতো বোনকে উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে।

আরও পড়ুন- কেন কালীপুজোর দিন হয় অলক্ষ্মী বিদায়

ভাইফোঁটার বিশেষ নিয়ম আছে যা সঠিক ভাবে পালন করাও অত্যন্ত জরুরি। চন্দন কাঠ জল দিয়ে ঘষে, তাতে কেউ কেউ আবার দইও মিশ্রিত করেন তিলকের জন্য। এই মিশ্রণ বোনরা নিজের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের কপালে তিনবার ফোঁটা দিয়ে দিয়ে থাকেন। কিন্তু ফোঁটা দেওয়ার সময়ে তিনবারই সম্পূর্ণ মন্ত্রটি পড়া হচ্ছে কিনা তার খেয়াল রাখতে হবে। ফোঁটা দেওয়ার সময়ের কোনদিকে বসে দেওয়া হচ্ছে সেটিও খেয়াল রাখা দরকার। অর্থাৎ এই বিষয়ে দিকেরও বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। শাস্ত্র অনুযায়ী পূর্ব দিকে মুখ করে ফোঁটা নেওয়া অত্যন্ত শুভ। তবে কোনও কারণে সেটি সমস্যাজনক হলে, সেই ক্ষেত্রে উত্তর দিক বা উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে ফোঁটা নেওয়া যায় । কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, দক্ষিণ দিকে মুখ করে কখনই ভাইফোঁটা নেওয়া উচিত নয়, এ অত্যন্ত অশুভ ইঙ্গিত করে।

এই উৎসব কেবলই একটি উৎসব নয়, এটি ভাই ও বোনের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসার বন্ধন, যা এই সকল উৎসবের দ্বারা আরও মজবুত হয়ে থাকে। ভাইফোঁটার অর্থ কেবল ফোঁটা বা কোনও রীতি-নিয়মই নয় বরং তার সঙ্গে জুড়ে আছে ভূরিভোজ এবং উপহার দেওয়া নেওয়ার পালা। এটি অত্যন্ত একটি ঘরোয়া উৎসব যা কেবল ঘরের ও পরিবারের মানুষদের নিয়েই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেখানে পরিবারের সকলেই অত্যন্ত আনন্দের সহকারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগদান করে থাকে। বলাইবাহুল্য শারদীয়া উৎসবের এই শেষ উৎসবের দিনটি মানুষ নিজের পরিবারের মানুষের সঙ্গে নিজের মতোন করে উপভোগ করে থাকেন। এই ভাবেই, এই সকল ছোট ছোট আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে অটুট থাকুক বাংলার সকল ভাই-বোনের সম্পর্ক। প্রতি বছর বাঙালির ঘরে ঘরে এই দীর্ঘায়ুর প্রদীপে পালিত হোক ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।

More Articles