গিনেসে নাম তুলল দেশের অন্যতম বৃহত্তম মেলা! বালিযাত্রার ইতিহাস আজও তাক লাগায়

Bali Yatra 2022: সেই সময় চারটি ছোট ছোট দ্বীপকে একত্রিত করে একটি দেশ গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল, নামকরণ করা হয়েছিল সুবর্ণ দ্বীপ, যা বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া।

মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট। ২২,০০০ কাগজের নৌকো বানিয়ে এই বছর গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা করে নিয়েছে কটকের বালিযাত্রা। করোনা ভাইরাসের কারণে বিগত দু’বছর এই বিশেষ মেলা বন্ধ থাকলেও এই বছর জেলা প্রশাসন ও কটক পৌর কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ব্যাপক আকারে পালিত হচ্ছে এই অনুষ্ঠান। বালি যাত্রা, বৈতা বন্দনা উৎসব নামেও পরিচিত। বৈতা অর্থাৎ নৌকা। মোট ২২ টি স্কুলের ২১০০ জন ছাত্র ছাত্রী মিলে তৈরি করে এই বিশ্ব রেকর্ড। তবে এত বড় অনুষ্ঠানের পেছনের রয়েছে কোন ইতিহাস? বালি যাত্রা আসলে কী?

আক্ষরিক অর্থে ‘বালি যাত্রা’ দেশের বৃহত্তম মেলাগুলির মধ্যে একটি। কার্তিক পূর্ণিমার দিন থেকে শুরু করে সপ্তাহব্যাপী চলে এই অনুষ্ঠান। প্রাচীন কলিঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান উড়িষ্যার সঙ্গে বালি সহ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও, বার্মা (মায়ানমার) এবং সিলনের (শ্রীলঙ্কা) প্রায় দু’হাজার বছরের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করতেই প্রতি বছর এই মেলা আয়োজন করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীনকালে কলিঙ্গ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যে পণ্য দ্রব্যগুলিকে কেন্দ্র করে ব্যবসা বাণিজ্য চলত সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মরিচ, দারুচিনি, এলাচ, রেশম, কর্পূর, সোনা এবং নানা ধরনের কারুকার্য করা গয়না। একসময় কলিঙ্গকে বিপুল সাম্রাজ্যের ভাণ্ডার করে তুলেছিল বিশেষজ্ঞ নাবিকেরা তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধির মাধ্যমে এবং তাদের সেই অবদানকে উদযাপন করার জন্যই পালন করা হয় বালি যাত্রা। তবে ঐতিহাসিক কারণ ছাড়াও এই অনুষ্ঠানের একটি ব্যাবসায়িক গুরুত্বও রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবছর প্রায় ১৫০০ বেশি স্টলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, এই বছর এই অনুষ্ঠান প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করলেও করতে পারে।

আরও পড়ুন- গুয়াহাটির জঙ্গলে ভূতের নাচ! সরাইঘাটের যুদ্ধে যেভাবে মুঘলদের হারিয়েছিল অহমরা

কলিঙ্গ কীভাবে জুড়ল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে?

কলিঙ্গ সাম্রাজ্য মূলত তার গৌরবময় সামুদ্রিক ইতিহাসের জন্যই পরিচিত ছিল। এই সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান এতই অভূতপূর্ব ছিল যে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ এবং ৫ম শতাব্দীর প্রথম দিকে এখানে প্রচুর পরিমাণে বন্দর গড়ে উঠতে দেখা যায়। তাম্রলিপ্ত, মানিকপাটনা, চেলিতালো, পালুর এবং পিথুন্ডা ইত্যাদি বিখ্যাত বন্দরগুলি সমুদ্রপথে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার পথ অনেক সহজ করে দিয়েছিল। এরপরে ধীরে ধীরে কলিঙ্গ সাম্রাজ্যের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, জাভা, বোর্নিও, সুমাত্রা, বালি এবং বার্মার বাণিজ্য সংযোগ শুরু হতে থাকে। সেই সময় চারটি ছোট ছোট দ্বীপকে একত্রিত করে একটি দেশ গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল, নামকরণ করা হয়েছিল সুবর্ণ দ্বীপ, যা বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া।

তাম্রলিপ্ত বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার আধুনিক তমলুক। কিন্তু আসলে প্রাচীন কলিঙ্গে ব্যবসায়ী এবং ভ্রমণকারীদের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করত তাম্রলিপ্ত, রাজপরিবার ছিল কৈবার্তা বর্ণের। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমি একে ‘ট্যামালাইটিস’ নামে অভিহিত করেছেন। এছাড়াও খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে ফা-হিয়েন একে বৌদ্ধদের শক্তিশালী সামুদ্রিক বসতি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এই বন্দর থেকেই তিনি সিলনের (শ্রীলঙ্কা) উদ্দেশ্যে রওনা হন। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর পিথুন্ডাকে খারভেলার হাতিগুম্ফা শিলালিপিতে কলিঙ্গের মহানগর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কলিঙ্গদের ব্যাবসায়িক জাহাজগুলি কেমন ছিল?

কলিঙ্গরা আসলে ‘বৈতাস’ নামে বড় বড় নৌকা তৈরি করত এবং এগুলির সাহায্যে ইন্দোনেশিয়া সহ বিভিন্ন দ্বীপগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করত। জানলে অবাক হতে হয়, বঙ্গোপসাগরে এক সময় কলিঙ্গদের জাহাজ ভিড় করে থাকত, যে কারণে এটি সেকালে কলিঙ্গ সাগর নামেও পরিচিত ছিল। এমনকী কালিদাসও তাঁর রঘুবংশে কলিঙ্গ রাজাকে ‘সমুদ্রের প্রভু’ বলেও সম্বোধন করেছিলেন। যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সেই সময় সমুদ্রপথে কলিঙ্গদের আধিপত্য কতটা ছিল।

আরও পড়ুন- বারাণসী থেকে এক ক্রুজেই বাংলাদেশ, যে ভ্রমণপথে তাকিয়ে সারাবিশ্ব

বালির অধিবাসীদের ধর্মীচারণ-খাদ্যাভ্যাস অবস্থান

ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা ইত্যাদি দ্বীপ ছাড়াও বালি দ্বীপের সঙ্গেই কলিঙ্গদের মূল ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। এবং দু’টি অঞ্চলের মধ্যে ক্রমাগত পণ্য আদান-প্রদান ছাড়াও বিশ্বাস ও ভাবের আদানপ্রদানও শুরু হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে উড়িষ্যার প্রচুর বণিক বালিতে নিজেদের বসতি গড়ে তোলেন এবং সেখানেই নিজেদের মতো করে নিজেদের সংস্কৃতি ধর্ম এবং রীতিনীতির বিকাশ ঘটান। যার ফলে সেই অঞ্চলে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু ধর্ম। ‘বালিনিজ’দের সঙ্গে হিন্দুধর্ম আজও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ আজও হিন্দু দেব দেবীদের পুজো করেন। বালির অধিবাসীরা শিবকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের বড় ভাই হিসেবে মনে করতেন। হিন্দু ভারতীয়দের মতো বালিনিজরাও শিবরাত্রি, দুর্গাপুজো এবং সরস্বতী পুজো উদযাপন করেন। ‘মাসাকাপন কে টুকাদ’ অনুষ্ঠানটি বালিতে পালন করা হয়, যা উড়িষ্যার বালি যাত্রা উৎসবের অনুরূপ। দুই অনুষ্ঠানই বিভিন্ন দেশের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যে সামুদ্রিক সম্পর্ক ছিল তাকে স্মরণ করেই পালন করা হয়।

বালিনিজ এবং উড়িষ্যার মানুষদের খাদ্যাভাসের পছন্দ-অপছন্দের তালিকাও অনেকটা একই রকম। বাংলা এবং উড়িষ্যার মানুষের মতো বালির মানুষও কলা পাতায় খাবার খেতে পছন্দ করেন। এছাড়াও চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পিঠেপুলি খেতেও পছন্দ করেন। রয়েছে পান খাওয়া এবং কাঠের বাক্সে মূল্যবান গয়না রাখার অভ্যাস। সুতরাং সমুদ্রের প্রায় শেষ প্রান্তে হলেও ভারতীয় পূর্ব পুরুষরা ইন্দোনেশিয়ার ছোট্ট দ্বীপগুলির সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন তা আজও দু’টি দেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে এক রয়ে রয়েছে।

More Articles