'লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন', জানেন এই গৌরী সেনের ইতিহাস?
একদিকে প্রভূত সম্পত্তি অন্যদিকে গৌরী সেনের দানশীল মনোভাব, এই দুই কারণেই উদ্ভব ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’-এর মতো প্রবাদের।
সময়টা ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিক। ভারতের বুকে তখনও সেভাবে শোনা যায়নি ইংরেজদের পদধ্বনি। হ্যাঁ, ইংরেজরা তখনও ভারতবাসীকে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ করেনি বটে, কিন্তু তার জন্য বিদেশিদের ভারতের মাটিতে বাণিজ্য করতে বাধা কোথায়? ইংরেজদের পরিবর্তে ভারতের মাটিতে তখন পর্তুগিজদের আধিপত্য। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে, ভাস্কো দা গামা নামক এক পর্তুগিজ পর্যটক পঞ্চদশ শতকে প্রথম ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখেন। ভাস্কো দা গামাই প্রথম ইউরোপীয়, যিনি সাতসমুদ্র তেরো নদী পার করে ভারতে এসে উপস্থিত হন। সুতরাং, ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে পর্তুগিজ আধিপত্য যে প্রশ্নাতীতভাবে থেকে থাকবে, তাতে বোধহয় বিশেষ আশ্চর্যের কিছু নেই। পর্তুগিজদের প্রসঙ্গ এই প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ এই গৌরী সেন নামক ব্যক্তিটি পর্তুগিজদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন ওতপ্রোতভাবে।
সালটা ১৫৮০। এমন সময় হুগলির বালগ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন গৌরীশঙ্কর সেন। পরবর্তী সময়ে সময়ের দাবি মেনে হুগলির বালগ্রাম পরিবর্তিত হয় আজকের বালিতে, যা বর্তমানে হাওড়ায় অবস্থিত। তবে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, গৌরী সেনের প্রকৃত নাম এবং জন্মস্থান নিয়ে বহু মতভেদ লক্ষ করা যায়। ‘বাংলা প্রবাদের গঠন ও উৎসকথা’ গ্রন্থে কমলকুমার পাল লিখছেন– “গৌরী সেন, যার মূল নাম গৌরীকান্ত সেন। সুবর্ণবনিক সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী তিনি। ১৫৮০ সালে হুগলীতে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম নন্দরাম সেন। থাকতেন ৩৫ নম্বর কলুটোলা ষ্ট্রীটে।’’
আবার ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা’ বইটিতে গৌরী সেনের পিতার নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে হরেকৃষ্ণ মুরুলীধর সেনের। অর্থাৎ, গৌরী সেনের প্রকৃত নাম এবং তার বাবার নাম নিয়েই সমালোচক মহলে মতভেদ আছে। ব্যতিক্রম নয় গৌরী সেনের জন্মস্থানের বিষয়টিও। কারণ বেশিরভাগ সমালোচক গৌরী সেনের প্রকৃত জন্মস্থান হিসেবে হুগলির বালগ্রামের, অর্থাৎ বর্তমানে হাওড়ার বালির কথা বললেও এক শ্রেণির সমালোচকের মতে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম গৌরী সেনের। আবার অন্যান্য অনেক সমালোচকের মতে গৌরী সেন আদতে একটি রূপক চরিত্র, প্রবাদের প্রয়োজনেই এর জন্ম।
আরও পড়ুন: জাহাজে লুকোনো রত্ন পেয়ে ভাগ্য ফিরেছিল গৌরী সেনের! বাংলা প্রবাদগুলিতে লুকিয়ে যে ইতিহাস
পূর্বেই বলেছি, তৎকালীন সময়ে ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যর ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত। পর্তুগিজরা ভারতের বুকে মশলার ব্যবসার ক্ষেত্রে অতি দ্রুত তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। একসময় ব্যান্ডেল শহরকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতে থাকে পর্তুগিজদের ব্যবসা-বাণিজ্য। সেই সময় দিল্লির গদিতে ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। তিনি পর্তুগিজদের হুগলিতে শহর স্থাপনের অনুমতি দিলে ১৫৭৯ সাল নাগাদ পর্তুগিজদের হাত ধরে হুগলি নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে তৈরি হয় একটি দুর্গ, পরবর্তী সময়ে, ১৫৯৯ সালে নির্মাণ করা হয় ব্যান্ডেল চার্চ। গৌরী সেন এই ব্যান্ডেল চার্চের দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না- ‘চিরকাল কাহারও সমান নাহি যায়।’ ১৬৩২ সাল নাগাদ যেন মহাকালের রথের চাকা একবার ঘুরল। দিল্লিতে আরও বৃদ্ধি পেল মুঘল তৎপরতা। এই সময় ব্যান্ডেলের গির্জাটিকে একপ্রকার ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয়। এর ফলে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল গৌরী সেনের। গির্জার দেওয়ান পদে এতদিন যে চাকরিতে বহাল তবিয়তে দিন কাটছিল তার, এবার সেই সুখের চাকরিটি গেল চিরতরে।
চাকরি তো না হয় গেল, এদিকে গৌরী সেন পড়ে গেলেন মহা আতান্তরে। নতুন বিয়ে হয়েছে তাঁর, চোখে নতুন সংসারের সোনালি স্বপ্ন। অথচ গৌরী সেন একপ্রকার বেকার। কিন্তু তিনি হেরে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। এই সময় গৌরী সেনের পরিচয় হল তৎকালীন সময়ের অন্যতম ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠের সঙ্গে। দু'জন মিলে শুরু করলেন বৈদেশিক ব্যবসা। আর ঠিক এখানেই যেন মহাকালের রথের চাকা আরও একবার পাক খেল। ব্যবসা করে কিছুদিনের মধ্যেই প্রভূত সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠলেন গৌরী সেন। শুধু তাই নয়, বৈষ্ণবচরণ শেঠের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি কিনে ফেললেন একটি জাহাজ। আর এরপরেই যেন ভাগ্য খুলে গেল তাঁর। লোকমুখে প্রচলিত সেই জাহাজেই গৌরী সেন পেয়ে যান প্রচুর রুপোর মোহর। অবশ্য এই নিয়েও দ্বিমত আছে। কেউ কেউ বলে থাকেন জাহাজে নয়, গৌরী সেনের পূর্বপুরুষরা চাষের কাজ করার সময় জমি থেকে পেয়েছিলেন সোনাভর্তি ঘড়া, যা পরবর্তী সময় ব্যবসার কাজে ব্যবহার করে লাভবান হয়েছিলেন গৌরী সেন।
তবে একথা ভাবলে ভুল ভাবা হবে যে, গৌরী সেন শুধুমাত্র দু'হাত ভরে উপার্জন করেছেন। তা কিন্তু একেবারেই নয়। উপার্জন তিনি যেমন করেছিলেন, তেমনই বহু মানুষকে সেই সময় সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এককথায় তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘দানবীর’ হিসেবে। তৎকালীন সময়ে বহু মানুষ রাজকর না দিতে পেরে জেলের ঘানি টানতে বাধ্য হতেন, কিন্তু গৌরী সেনের দরজায় কড়া নাড়লে তাঁদের কখনও ব্যর্থমনোরথে ফিরতে হতো না। এমনকী, কথিত আছে, সেই সময় হুগলির সমস্ত খাবারের দোকানে কড়া নির্দেশ ছিল, কোনও অসহায় মানুষ গৌরী সেনের নাম করে খাবার চাইলে তাকে যেন সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত খাবার দিয়ে সাহায্য করা হয়। তাঁদের সবার খরচ বহন করবেন গৌরী সেন।
১৬৬৭ সালে মারা যান গৌরী সেন। আহিরীটোলাতে তিনি তৈরি করেছিলেন বিরাট একটি বাড়ি। এখানেই শেষ নয় বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশন অবস্থিত যে স্থানের ওপর, সেই জমিটিও নাকি ছিল গৌরী সেনের। এমনকী, হুগলির গৌরীশঙ্কর শিবের মন্দিরও নাকি তৈরি করেছিলেন এই গৌরী সেন।
একদিকে প্রভূত সম্পত্তি অন্যদিকে গৌরী সেনের দানশীল মনোভাব, এই দুই কারণেই উদ্ভব ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’-এর মতো প্রবাদের। গৌরী সেনের অনেক ইতিহাসই হয়তো অজানা, কিন্তু তারপরেও কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি গৌরী সেনের মহৎ গুণটি, হারিয়ে যাননি গৌরী সেন নিজেও। শত শত বছর পরেও গৌরী সেন বেঁচে আছেন তাঁর কৃতিত্বের মধ্য দিয়ে, বাংলা প্রবাদের মধ্য দিয়ে।