‘লুচি’ নামের আসল রহস্য কী? জানেন কীভাবে জন্ম হল এই জনপ্রিয় খাবারের?
Bengali Food Luchi : জলখাবার অথবা পেটচুক্তি আহার, লুচির প্রতি টান আজও অটুট, জানেন কবে কথায় প্রথম হদিশ মেলে এই পদের?
ফুলকো লুচি আর সাদা আলুর তরকারি, কালো জিরে দিয়ে; চিরাচরিত এ বাঙালি পদের আজও তুলনা মেলে না সহজে। আজকের পিৎজা, পাস্তা কিংবা বর্গারের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লুচির মাহাত্ম্য কমে না এক রত্তিও। বহু যুগ আগে থেকেই লুচির সঙ্গে সঙ্গত করে আরও বেশ কিছু পদ যেমন আলুরদম, ঘুগনি, মাংস অথবা সুজির হালুয়া। শুধু জলখাবার বলেই নয়, এমনকী পেটচুক্তি আহারেও জবাব নেই লুচির। ছাঁকা তেলে ভাজা ময়দার লুচি, ফলে আজকের সময়ের ডায়েটের সঙ্গে অবশ্য একেবারেই খাপ খায় না এই পদ। যদিও তাতে বাঙালির বিশেষ কিছুই যায় আসে না। আজও হেঁশেল থেকে ঘিয়ে ভাজা লুচির গন্ধ পেলে কোন এক অজানা কারণে মনটা কেমন করে ওঠে।
বাংলার প্রিয় পদ হলেও এই নামটি মোটেই কোনও বাংলা শব্দ নয়। এমনকী প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিতেও কোথাও উল্লেখ মেলে না লুচি নামের কোনও পদের। অথচ বাংলার সঙ্গে কিভাবে এমন অটুট বন্ধন গড়ে উঠলো এই খাবারের, তা যেন সত্যিই রহস্য। আসলে সুস্বাদু এই জলখাবারের নামটি একটি হিন্দি শব্দ। ঘি-তে ভাজা লুচি হাতে নিলে তার মধ্যে লেগে থাকা ময়ানের জন্য পিছলে যায়। এই পিচ্ছিল হয়ে যাওয়াকে হিন্দিতে 'লুচ' বলা হয়, আর সেখান থেকেই থাকি এই খাবারের নাম হয়েছে লুচি।
যদিও এই হিন্দির সঙ্গে যোগকে এক কথায় মেনে নেয়নি সকলেই। এ নিয়ে ভিন্ন মতেরও খোঁজ পাওয়া যায়। অনেকের মত, সংস্কৃত শব্দ লোচক থেকে এসেছে লুচি শব্দটি, বাংলায় যার অর্থ হল চোখের মনি। আসলে লুচি যেহেতু চোখের মনির মত গোল, তাই এহেন নামকরণ। যদিও এই দুই মোট ছাড়া আরও বেশ কিছুই মতের কথা শোনা যায় ইতিউতি। কিন্তু কোনওটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মেলে না। তবে সংস্কৃত লোচক অথবা হিন্দি লুচ শব্দ দুটির দিকে পাল্লা ভারী থাকে।
আরও পড়ুন - বাংলায় দেদার চল কচুরি, লুচি এবং পুরির, জানেন আসলে কী তফাৎ এই তিনটি খাবারের?
এ দেশে প্রথম লুচির হদিশ মেলে আজ থেকে বহু বছর আগে, পাল যুগে। সেইসময়কার বিখ্যাত চিকিৎসক চক্রপাণি দত্তের লেখা 'দ্রব্যগুন' গ্রন্থে উল্লেখ ছিল লুচির। সেখান থেকেই জানা যায় এ8 লুচিও বাকি তিন প্রকারে খেত ভারতীয়রা। যথাক্রমে - খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। বেশি ময়ান দিয়ে তৈরি লুচি হল খাস্তা লুচি। ময়ান ছাড়া ময়দা দিয়ে তৈরি লুচি ছিল সাপ্তা লুচি। আর ময়দার পরিবর্তে আটা দিয়ে যে লুচি তৈরি হত তা ছিল পুরি। তবে পাল যুগে মূলত খাস্তা লুচিই বেশি খাওয়া হতো। চিরন্তন সেই ঐতিহ্য মেনে আজও বাঙালির কাছে লুচি নামক পদটির বিশেষত্ব কমেনি একটুও।
আজকাল আটা ময়দা মিশিয়ে লুচি করা হলেও বাঙালি বাড়িতে ধবধবে সাদা লুচির প্রতি টানই সব চাইতে বেশি। অর্থাৎ শুধু ময়দার লুচি। আর যদি আটা দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে রঙ হয় লালচে, যদিও সেটা তখন আর লুচি থাকে না, হয়ে যায় পুরি। আজকাল পথ চলতি বহু দোকানেই এই খাবার পাওয়া যায়।
শুধু স্বাদ অথবা উপকরণ নয় বাংলার নানা প্রান্তে লুচির আয়তনও ভিন্ন ভিন্ন। গ্রাম বাংলা থেকে যত কলকাতার দিকে যাওয়া যাবে লুচির আয়তন তত কমতে কমতে ছোট হতে থাকে। যেখানে গ্রামের দিকে একটি লুচির ব্যাস মোটামুটি ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি, সেখানে কলকাতার দিকে তা কমতে কমতে ৩-৪ ইঞ্চিতে ঠেকে। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, এর নেপথ্যেও রয়েছে লুকনো শ্রেণী বৈষম্য। শিক্ষিত উন্নত শ্রেনী নিজেদের বাবুয়ানার নিদর্শন হিসেবে ছোট আকারের লুচি খাওয়া পছন্দ করেন।
জানা যায় একসময় সবচেয়ে বড় আকারের লুচি পাওয়া যেত এই বাংলায়। দিনাজপুরের কান্তনগরের কান্তজিউ মন্দিরের ঠাকুরবাড়িতে ভোগ দেওয়া হয়তো সেই বৃহৎ লুচির। একেকটা লুচির একার আস্ত একটা থালার মতো। বর্তমানে মালদহ জেলার ইংরেজবাজারের সাদল্লাপুর শ্মশানের কাছে হাতির পায়ের মতো বড় লুচি পাওয়া যায়, যার ব্যাস প্রায় ১০ ইঞ্চির কাছাকাছি। যদিও এর বিপরীতে এবার সবচেয়ে ছোট লুচির চলও রয়েছে এই বাংলায়। মেদিনীপুরের রাধামোহনপুরের পলাশী গ্রামের নন্দী পরিবারের ঠাকুরবাড়িতে ভোগ হিসেবে যে লুচি দেওয়া হয় তার ব্যাস ১-১.৫ ইঞ্চির মত। মনে করা হয় এটিই বাংলার সবচেয়ে ছোট লুচি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে লুচির স্বাদ বাঙালির এই হালফিলের ডায়েট যুগকেও রীতিমতো টেক্কা দিতে সক্ষম।