প্রথমবার মহিলাদের খেলা, বাঘকে চুমু! গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের নেপথ্যে ছিলেন এই বাঙালিই
Great Bengal Circus: দুঃসাহসী মহিলা একের পর এক শোয়ে বাঘের সঙ্গে একই খাঁচায় খেলা দেখালেন, বাঘকে চুমু খেলেন। একই সঙ্গে বন্য বাঘ এবং পুরুষশাসিত সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন
শীতকাল মানেই আনন্দ-উৎসবের সময়। মেলা-খেলা, নাটক-জলসা, পিকনিক আরও কত কী! যদিও এই উৎসবের এক বড় অঙ্গই আজ ধুঁকছে। শীতের বিনোদনের অন্যতম নজরকাড়া উপকরণ সার্কাস প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। বর্তমানে সার্কাস শব্দটি শুধুই যেন ব্যঙ্গাত্মক অর্থ নিয়েই টিকে রয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কলকাতার পার্কসার্কাস ময়দান থেকে শুরু করে জেলার শফর, মফসসলগুলির বিভিন্ন মাঠ জুড়ে ছোট-বড় সার্কাসের তাঁবু পড়ত। বাড়ির সকলে মিলে দল বেঁধে সার্কাস দেখতে যাওয়ার চল ছিল। পারিবারিক বিনোদনের এক চমৎকার মাধ্যম ছিল সার্কাসগুলি। তবে, সার্কাস কেবল মাঠে-ময়দানের খেলাতেই আটকে ছিল না। বরং, সার্কাসকে ঘিরে যাদের জীবন, সেই সমস্ত কলাকুশলীদের ছবি সাহিত্যের পাতা থেকে সিনেমার পর্দা- সর্বত্রই ফুটে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে যে প্রজন্ম বড় হয়ে উঠেছে তাদের কাছে মাঠের সার্কাস যেমন বাস্তব ছিল, তেমনই দূরদর্শনের পর্দায় সার্কাস সিরিজের হাত ধরেই তারা চিনেছে শাহরুখ খানকে। আবার ওদিকে, চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য সার্কাস’ হোক কিংবা বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘মেরা নাম জোকার’- সবেতেই দেখা যাচ্ছে সার্কাসকে কেন্দ্র করে মানুষের হাসি-কান্না ভরা জীবন গাথা।
বাঙালির প্রিয় ফেলুদার গল্পেও আমরা পাই সার্কাসের প্রসঙ্গ। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ উপন্যাসে ফেলু মিত্তির হাজারিবাগে সার্কাস থেকে বাঘ পালানোর রহস্য কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এই উপন্যাসেই ফেলুদার সহযোগী তথা উপন্যাসের কথক তোপসে জানাচ্ছে; ”কে জানত আজ থেকে একশো বছর আগে বাঙালীর সার্কাস ভারতবর্ষে এত নাম কিনেছিল? সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল প্রোফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। এই সার্কাসে নাকি বাঙালী মেয়েরাও খেলা দেখাত, …”। কেমন ছিল বাঙালির সার্কাসের সেই ইতিহাস? কে ছিলেন প্রফেসর বোস?
আরও পড়ুন-সিংহের শিকার হয়ে উঠতে পারত তরুণী, কলকাতার সার্কাসের সেইসব দিন আজও রোমাঞ্চকর
সার্কাসের সঙ্গে আপামর বাঙালির পরিচয় ঘটে উনিশ শতকের শেষ ভাগে। তৎকালীন ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ভারতীয়দের মধ্যে শরীরচর্চার, শরীর সঞ্চালনের কলাকৌশলের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে। ১৮৬৮-এ কলকাতায় নবগোপাল মিত্র একটি শরীরচর্চার আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। শরীর সঞ্চালনার কৌশল ও পশুর খেলাকে একত্রিত করে তাঁর উদ্যোগেই জন্ম নেয় প্রথম দেশজ সার্কাসের দল- ‘ন্যাশানাল সার্কাস’। কলাকুশলী ছাড়া তাঁর দলের একমাত্র সম্বল ছিল টাট্টু ঘোড়া। কিন্তু, বেশিদিন টিকল না সে দল। এর পর পরই বম্বেতে বিষ্ণুপন্থ ছত্রে নামক এক ব্যক্তির উদ্যোগে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সার্কাস দলে পরবর্তীতে নাকি বেশ কিছু বিদেশি কলাকুশলীরা যোগ দিয়েছিলেন।
জাতীয়তাবাদের জোয়ারে সেই সময় কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় শরীরচর্চার আখড়া গড়ে উঠছিল। নবগোপাল মিত্রের বন্ধুস্থানীয় নাট্যকার মনোমোহন বসুর ছেলে ছিলেন প্রিয়নাথ বসু। অল্প বয়সেই তিনি শরীরচর্চায় আগ্রহী হয়ে আহিরিটোলার এক বিখ্যাত আখড়ায় যাতায়াত শুরু করেন। কিছুদিন পর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে সিমলে পাড়া (বর্তমান বিবেকানন্দ রোড) অঞ্চলে নিজেই খুলে ফেলেন নতুন একটি আখড়া। জানা যায়, এই আখড়াতে নরেন্দ্রনাথ দত্তেরও যাতায়াত ছিল। নাট্যকার বাবা, ছেলের এই শরীরচর্চার বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি। ছেলেকে আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলের কেরিয়ার শিল্পের কোনও এক শাখাতে তৈরি হোক। কিন্তু, ছেলে অর্থাৎ প্রিয়নাথ বসু শরীর সঞ্চালনের কাজেই জুড়ে দিলেন এক শৈল্পিক মাত্রা। একবিংশ শতকে এসে যে কাজকে আমরা পারফর্মিং আর্টসের আওতাভুক্ত করতে পারি।
কলকাতায় বসেই প্রিয়নাথ দেখে ছিলেন উইলসনের বিখ্যাত ‘গ্রেট ওয়ার্ল্ড সার্কাস’ এবং চিয়ারিনির ‘রয়েল ইটালিয়ান সার্কাস’। বিদেশি সার্কাস দেখে তিনি এতটাই অভিভূত হয়ে গেলেন যে বেশকিছু জিমন্যাস্টিকসে পারদর্শী সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নতুন একটি দল তৈরি করলেন। যেহেতু এই কাজে বাবার সম্মতি ছিল না তাই, অল্প কিছু অর্থ আর অদম্য ইচ্ছে সম্বল করেই বাড়ি ছাড়লেন তিনি। জোর কদমে শুরু করলেন সার্কাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সার্কাস দলে প্রশিক্ষণের কাজ, প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড়, যন্ত্রপাতির নকশা তৈরি করা- সব একা হাতে সামলাতেন প্রিয়নাথ। প্রথম দিকে, তাঁর দলে পশু-পাখি প্রায় কিছুই ছিল না। জিমন্যাস্টিকের উপর ভিত্তি করেই তিনি মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, বীরভূম অঞ্চলে বেশকিছু জমিদারের আমন্ত্রণে খেলা দেখালেন। বাংলার গাঁ-গঞ্জের মানুষ সেই প্রথম সার্কাস দেখল দু’চোখ ভরে, তাও আবার বাঙালির হাতে তৈরি সাকার্স! সেখান থেকে রোজগারপাতি যা হল তা দিয়েই কলকাতায় ফিরে তিনি কিনে ফেললেন কুকুর, বাঁদর, ঘোড়া ইত্যাদি পশু। নতুন শোয়ের জন্য একটি তাঁবু কিনলেন। শ্যামবাজারের নন্দ ঘোষের আখড়া থেকে ধার করলেন ঘোড়া। ব্রিটিশরা প্রিয়নাথের কর্মকুশলতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে প্রফেসর আখ্যা দিল। সেই থেকে প্রিয়নাথ হয়ে উঠেলেন প্রফেসর বোস। শেষ পর্যন্ত, ১৮৮৭ তে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হল প্রফেসর বোসের ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’। বাঙালির সার্কাস এবার শৈশব ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিল।
আরও পড়ুন- চাটের দোকানের বয় থেকে সার্কাসের জোকার, তুলসী চক্রবর্তীকে কি ভুলেই গেল বাঙালি
তিনি দলবল নিয়ে অবিভক্ত বাংলার ঢাকা, বরিশাল, নৈহাটি, মুর্শিদাবাদ, কাটোয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখাতে থাকলেন। একের পর এক দেশিয় রাজাদের আমন্ত্রণ আসতে লাগল প্রিয়নাথের কাছে। বাংলা ছাড়িয়ে কাশী, গোয়ালিওয়র, রেওয়া এমনকী কাশ্মীরেও তিনি পৌঁছে গেলেন সার্কাস দেখাতে। এই সব রাজারা তাঁর সার্কাসে মুগ্ধ হয়ে ব্যক্তিগত পশুশালা থেকে হাতি, ঘোড়া, বাঘ ইত্যাদি ভেট দিলেন। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় তিনি প্রথম বড় আকারে সার্কাসের আয়োজন করেন। তাঁবু পড়ল ময়দানে। দর্শক আসন আলোকিত করলেন কাপূরথালা, কুচবিহার ও বর্ধমানের রাজা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রিয়নাথের প্রশংসা ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। ১৯১১-১২ সাল পর্যন্ত প্রতি শীতে কলকাতার ময়দানে ভিড় জমত বোসের সার্কাস দেখার জন্য।
প্রিয়নাথ শুধুমাত্র বাংলার সার্কাসের নিজস্ব ধারাকে শুরুই করলেন না, তিনি আরও একটি দুঃসাহসিক কাজ করলেন । সেই সময় সার্কাসে মহিলাদের খেলা দেখানোর চল ছিল না। শুধু সার্কাস কেন? তখনকার সমাজে বাড়ির বাইরে মহিলাদের সামগ্রিক উপস্থিতি বড়ই কম ছিল।
প্রিয়নাথ তাঁর সার্কাস দলে নিযুক্ত করলেন এক মহিলা জিমন্যাস্টকে। কলকাতা জুড়ে হই-চই পড়ে গেল। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আলোচনা, সমালোচনা হতে থাকল। আর সেই দুঃসাহসী মহিলা একের পর এক শোয়ে বাঘের সঙ্গে একই খাঁচায় খেলা দেখালেন, বাঘকে চুমু খেলেন। একই সঙ্গে বন্য বাঘ এবং পুরুষশাসিত সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন যে মহিলা তাঁর নাম সুশীলা সুন্দরী। খেলা দেখাতে গিয়েই বাঘের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত হন সুশীলা দেবী। ছেদ পড়ে তাঁর সার্কাস জীবনে।
প্রফেসর বোস ভারত ছাড়িয়ে সিলন, ইয়াঙ্গন, মালয়, জাভা, সিঙ্গাপুর সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে খেলা দেখিয়েছেন। ফি বছর তিনি তাঁর সার্কাস দল নিয়ে ট্যুর করতেন। ১৯২০ সালে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান বাঙালির সার্কাস জগতের অভিভাবক প্রিয়নাথ বসু।
আজকের পৃথিবীতে জীব-বৈচিত্রের অবলুপ্তি সার্কাসে পশু-পাখির ব্যবহারকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বন্য পশু সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তায় ভারত সরকার সার্কাসে পশু-পাখির ব্যবহার আইন করে বন্ধ করেছে। নিষিদ্ধ হয়েছে বন্য পশুর কেনাবেচাও। পশু-পাখি ছাড়াও শহরের আনাচে-কানাচে কিংবা মফসসলের কোনও ময়দানে শীত পড়লেই এখনও টিমটিম করে চলে জিমন্যাস্টিকসের খেলা। তবে কি পশু-পাখির খেলার অভাবেই শেষ হতে বসেছে সার্কাস? হয়তো না। কিন্তু ডিজিটাল পৃথিবীতে ছোট বড় সকলের হরেক কিসিমের আনন্দ-বিনোদনের উপকরণ মজুত রয়েছে টিভি, ল্যাপটপ কিংবা মুঠোফোনের স্ক্রিনে। তাই, আকর্ষণ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সার্কাস থেকে। আগামী পৃথিবীতে হয়তো সার্কাস আর থাকবে না, কিংবা ফিরে আসতেও পারে নতুন আঙ্গিকে। কিন্তু এসবের পরেও তথাকথিত কাব্যপ্রিয়, মাছে-ভাতে বাঙালি যে সফল ভাবে সার্কাসের দল চালাতে পারে, বাঙালি মহিলারা সমাজের আগল ভেঙে বাঘের সঙ্গে খেলা দেখাতে পারে- সেই কাহিনি আজও আমাদের ছক ভাঙার, ঝুঁকি নেওয়ার সহায়-সম্বল।