কলেজস্ট্রিটের প্রাচীন দোকানে এখনও উদ্বাস্তু গন্ধ! কেমন আছে পুরনো বইয়ের ব্যবসা?

College Street Old Book Shops: পাঁচ বছর আগে পুরনো বই বিক্রি করে ফিবছর টার্নওভার ছিল অন্তত ১০ থেকে ১২ কোটি। বর্তমানে টার্নওভার দাঁড়িয়েছে ৫ থেকে ৭ কোটির কাছাকাছি।

ব্যস্ততা গোটা কলেজস্ট্রিট চত্বর জুড়ে। একে তো যানজট, তার উপর ট্রাম লাইনে আটকে রয়েছে তার ছেঁড়া ট্রাম। রিকশার গায়ে ধাক্কা মারছে ট্যাক্সি। আর এই নিয়ে তুমুল বিবাদ। শীত এসে চলেও গিয়েছে কিছুদিন আগে। শীতকালে একসময়ে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোত। শীতের কাঁপুনির সঙ্গে স্কুলের পড়ুয়াদের সইতে হতো রেজাল্টের টেনশন। বেশ কয়েক বছর মার্চে স্কুলের নতুন সেশন চলার পরে ফের জানুয়ারি থেকে চালু হয়েছে বিভিন্ন বোর্ডের নতুন সেশন। কলেজ স্ট্রিটে দুপুর থেকেই উপচে পড়ে নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের ভিড়। নতুন বই কিনে দেওয়ার সাধ্য অনেক অভিভাবকেরই নেই। করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলেও জীবন সংগ্রাম কঠিন হয়েছে। সাংসারিক দায়দায়িত্ব বাড়লেও রোজগার তেমন বাড়েনি। অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম থেকে শুরু করে জ্বালানির দামও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সন্তানকে লিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করাটা অভিভাবকদের কাছে ব্যাপক চাপের ব্যাপারই। আবার এই চাপ এড়িয়ে যাওয়াও অভিভাবকদের কাছে কর্তব্য অবহেলার সামিল। নতুন বইয়ের গন্ধ নতুন ক্লাসে ওঠার পরে ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনেকটা পুরস্কারের মতো। বাবা-মায়ের আর্থিক সঙ্গতি সেই পুরস্কারের ছায়া থেকেও দূরে রাখে অনেককেই। বাবা-মায়ের হাত ধরে কলেজস্ট্রিটে তাই এখনও পুরনো পাঠ্যবই কিনতে ভিড় জমায় অনেক পড়ুয়াই।

প্রেসিডেন্সি কলেজ, হেয়ার স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ঘেঁষা ফুটপাথ কিংবা কলেজ স্কোয়ার সংলগ্ন ফুটপাথে শয়ে শয়ে বইয়ের দোকান। সেখানে নতুন সিলেবাসের পাঠ্যবই কেনার জন্য তুমুল ভিড়। সেই কলরবে কান পাতা দায়। কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় পুরনো বইয়ের ব্যবসা এক প্রাচীন ব্যবসা। ভূভারতে নেই এমন কোনও বইপাড়া। কলকাতা সেই হিসেবে ব্যতিক্রম। কেবল তাই নয়, কলকাতার এ এক ঐতিহ্য, যা আন্তর্জাতিক মানচিত্রেও ঠাঁই পেয়েছে। ফিবছর যে বিদেশি পর্যটকরা কলকাতায় আসেন তাঁরাও ঘুরেফিরে দেখেন বইপাড়া। হয়তো দেশে ফিরে সেই কাহিনি সাতকাহন করে বলেন!
কলেজস্ট্রিটের পুরনো বইয়ের ব্যবসা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ঘটনাও। দেশভাগের পরে যে মানুষরা উদ্বাস্তু হিসেবে দলে দলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন তাঁদের কঠোর জীবন সংগ্রাম নিয়ে রচিত হয়েছে সাহিত্য, সিনেমা।

আরও পড়ুন- বইমেলা থেকে নিষিদ্ধপল্লি- সব একাকার ছিল কলেজস্ট্রিটের এই আড্ডায়

এই উদ্বাস্তু মানুষদের মধ্যেই হাতেগোনা কয়েকজন কলেজস্ট্রিটে প্রেসিডেন্সি কলেজের লাগোয়ো ফুটপাথে পুরনো বইয়ের ব্যবসার সূত্রপাত করেন। বইপাড়ার পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সেই সময়ে বিক্রি হতো মূলত বাঙালি লেখক-লেখিকাদের রচিত গল্প-উপন্যাসের পুরনো বইপত্র। টিনের বাক্স থেকে বই বের করে ফুটপাতের রেলিংয়ে দড়ি টাঙিয়ে প্রদর্শন করা হত। বঙ্গ সাহিত্যের প্রসিদ্ধ লেখক-লেখিকাদের বই ফুটপাতেএখনকার মতোই তখনও পাঠক টানত। পাঠক-পাঠিকা অল্প দামে কিনে পড়তেন। এছাড়া গবেষকরা খুঁজে বের করতেন দুর্লভ বইপত্র। দিনকাল পাল্টে গিয়েছে। বইয়ের স্থান দখল করেছে টিভি, মোবাইল। মানুষ পড়ে কম, দেখে বেশি। বইয়ের পাতা উল্টানোর আনন্দ কেড়েছে প্রযুক্তি। ফলে পুরনো বইয়ের রমরমা ব্যবসায় ভাঁটা পড়েছে গত ২০-২৫ বছর ধরে, জানালেন কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীরাই।

পাঠক-পাঠিকারা বাংলা সাহিত্যের পুরনো বই তবু কিনছেন। তবে কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানিদের অনেকেই জানালেন, বাংলা গল্প-উপন্যাসের পুরনো সংস্করণগুলি মোটামুটি বিক্রি হচ্ছে ঠিকই, যদিও ইংরেজি উপন্যাসের কদর তুলনায় বেশি। মূলত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাই এর পাঠক-পাঠিকা। কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় পুরনো বইয়ের জোগান বরাবর এসেছে পাবলিক লাইব্রেরি কিংবা পারিবারিক লাইব্রেরিগুলো থেকে। পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীরা জানালেন, কলকাতা তো বটেই, শহরতলি কিংবা গ্রামাঞ্চলের লাইব্রেরিগুলো পাঠক-পাঠিকার অভাবে বছরের পর বছর ধুঁকছে। সেজন্য লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ পুরনো বেচে দিচ্ছে। পারিবারিক লাইব্রেরিগুলোও পুরনো বই বেচে দিচ্ছে। দালাল মারফত খবর পেয়ে সেই বইগুলি খানিক সস্তায় বইপাড়ার পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ী কিনে নিচ্ছেন। কলেজস্ট্রিট বইপাড়ার পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অনেকেরই আক্ষেপ, "বাঙালির লেখাপড়ার পাট জাহান্নমে যাচ্ছে"।

বিধানচন্দ্র রায় বাংলার মু্খ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথে প্রথম ৪০০ থেকে ৫০০টি পুরনো বইয়ের দোকান চালু হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই ব্যবসা ফুলেফলে বিকশিত হয়। সেই সময়ে বইপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম হকার্স ইউনিয়নও। পুরনো বই বিক্রেতাদের কাছে জানা গেল, বর্তমানে পুরনো বইয়ের স্টলের সংখ্যা অন্তত ১,৫০০টির মতো। এই ব্যবসা থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়েক হাজার মানুষ। যার ভিতর স্টলের মালিক ও কর্মীরাও রয়েছেন।

কলেজস্ট্রিটের পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের একাধিক ইউনিয়ন রয়েছে। সব মিলিয়ে ইউনিয়নের সংখ্যা অন্তত ৯টি। 'কলেজস্ট্রিট ব্যবসায়ী সমিতি'র কোষাধ্যক্ষ অমরসিং রায় ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ। তিনি জানালেন, তাঁদের ইউনিয়নের সদস্য দেড় শতাধিকের কাছাকাছি পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ী। ৬০ শতাংশ দোকানের মালিক একাধিক কর্মীর মাধ্যমে দোকান চালান। আর পাঠ্যবই না রেখে উপায় নেই। কারণ যে ব্যবসা একসময়ে রমরমিয়ে চলত, সেই ব্যবসার এখন অধোগতি মোবাইল, কম্পিউটারের দৌলতে। পাঠক-পাঠিকাদের বড় অংশ বই পড়ছেন মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে। অমরসিং রায়ের অনুযোগ, গুগল পুরনো বইয়ের ব্যবসার ক্ষতি করেছে। টিভির নেশাও আরেক আততায়ী।

কলেজস্ট্রিট ব্যবসায়ী সমিতির আরও অভিযোগ, এজন্য শুধুমাত্র সাহিত্য ছেড়ে স্কুল-কলেজের পুরনো পাঠ্যবই বিক্রির দিকেও ঝুঁকছেন তাঁরা। নতুন কৌশল না নিলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এই কৌশল অবলম্বন করে সংসার কষ্ট করে হলেও চলছে। ইউনিয়ন নেতা অমরসিং কিছু গুরুত্বপুর্ণ খবরাখবর জানালেন। জানা গেল, পাঁচ বছর আগে পুরনো বই বিক্রি করে ফিবছর টার্নওভার ছিল অন্তত ১০ থেকে ১২ কোটি। বর্তমানে টার্নওভার দাঁড়িয়েছে ৫ থেকে ৭ কোটির কাছাকাছি। এই সঙ্কটের কারণ নানাবিধ। পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পাঠ্য বইয়ের প্রকাশনা সংস্থাগুলি সিলেবাস অক্ষুণ্ণ থাকা সত্ত্বেও বইয়ের প্রথম অধ্যায়টা পাল্টে দিয়ে বাকি অংশের কোনও রদবদল ঘটাচ্ছে না। এতে ছাত্রছাত্রীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। পুরনো বইয়ের ব্যবসায় টান পড়েছে এই কারণেও।

আরও পড়ুন- নস্টালজিয়া না লজ্জা? কলকাতার হাতে টানা রিকশার আড়ালে রয়েছে যে কাহিনি

বইপাড়ার পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীরা জানালেন, বাংলা সাহিত্যের বইয়ের চেয়ে বর্তমানে ইংরেজি উপন্যাসের চাহিদা যুব সম্প্রদায়ের কাছে বেশি হলেও এখনও ভালোই বিকোচ্ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুথোপাধ্যায়ের বই। এছাড়া ব্যোমকেশ, ফেলুদার চাহিদা বেশি। সে তুলনায় এই সময়ের সাহিত্যিকদের বইয়ের চাহিদা খুবই কম। চাহিদা কমেছে শরৎ সাহিত্য কিংবা রবীন্দ্র সাহিত্যের।

অনলাইনে বই পড়া বইপাড়ায় আসার প্রয়োজনীয়তা কমিয়েছে। অনলাইনে বাড়িতে বসেই চাহিদামতো বই পাওয়া যায়। বইপাড়ায় ঘোরাঘুরির ঝামেলা নেই। এছাড়া বড় বড় সংস্থাগুলি অনলাইনে বইপিছু দামে ছাড় দিচ্ছে বেশি টাকা। পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের এও অভিযোগ, বাজার ছেয়ে গিয়েছে পাইরেটেড সংস্করণে। বিশেষত ইংরেজি গল্প-উপন্যাসের পাইরেটেড কপি ঢালাওভাবে তৈরি হচ্ছে মুম্বইয়ে। আর পাঠ্যবইয়ের পাইরেটেড কপি তৈরি হচ্ছে দিল্লিতে। পাইরেটেড কপি বিক্রির চক্রের সঙ্গে জড়িত চক্রটি কেন ভাঙা হচ্ছে না, এই প্রশ্ন তুলেছেন বইপাড়ার পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের ইউনিয়নগুলির নেতারা।

'আদি পুরাতন পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি'-র অন্যতম নেতা মইনুদ্দিন মিদ্যা। 'কলেজস্ট্রিটের আদি পুরাতন ব্যবসায়ী সমিতি' পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের যে আটটি ইউনিয়ন রয়েছে তার ভিতর সবচেয়ে প্রাচীন। বইপাড়ায় যবে থেকে পুরনো বইয়ের ব্যবসার সূত্রপাত সেই সময়েই গঠিত হয়েছিল এই ইউনিয়ন। মইনুদ্দিনের পুরনো বইয়ের ব্যবসা তিন পুরুষের। মইনুদ্দিন জানালেন, কলেজস্ট্রিট চত্বরে একসময়ে পুরনো বইয়ের ব্যবসাটি চালাতেন বিহারি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রায় ৬০ বছর আগে তাঁদের পরিচালিত পুরনো বইয়ের স্টলগুলি বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা মুলুকে ফিরে গিয়েছেন। স্টলগুলি কিনে নিয়েছিলেন যে বাঙালি মুসলিমরা তাঁরা সেখানেই আগে দোকানি হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে কলেজস্ট্রিটের পুরনো বইয়ের ব্যবসার মালিক অবশ্য দুই সম্প্রদায়ের মানুষই। পুরনো বই ব্যবসায়ীদের ইউনিয়নগুলি সূত্রে জানা গেল, ৬০ শতাংশ পুরনো বইয়ের স্টল এখন হিন্দু বাঙালি পরিচালিত। আর ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরনো বইয়ের ব্যবসা এখন মুসলিম বাঙালি পরিচালিত।

More Articles