ছিল বাগান, হলো স্টেডিয়াম! বিশ্ব ক্রিকেটের পীঠস্থান ইডেন গার্ডেনের যে ইতিহাস অনেকের অজানা

শুধুমাত্র বাগান থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের যাত্রায় তার সঞ্চয় করা বহু গল্প নিয়ে ইডেন শহরের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ইডেন গার্ডেন- নামটা শুনলেই আমাদের মনে প্রথমেই আসে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বহু অসাধারণ ম্যাচের সাক্ষী এই স্টেডিয়াম। যদিও ইডেন গার্ডেন মানে শুধু স্টেডিয়াম না, এই কথাটা অনেকেই জানে না। স্টেডিয়ামের সংলগ্ন সত্যিকারের গার্ডেন অথবা বাগান খেলায় উৎসাহী জনতার চোখের আড়ালে থেকে যায়। তার সঙ্গে লুকিয়ে থাকে ইডেন গার্ডেনসের দীর্ঘ ইতিহাস। বাগানের ইতিহাস থেকে ক্রিকেট খেলার বিভিন্ন রোমাঞ্চকর মুহূর্তের সাক্ষী আমাদের প্রিয় ইডেন গার্ডেন।

ইডেন গার্ডেন শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলার জন্য তৈরি করা হয়নি। ১৮৩৬ সালের মার্চ মাসে চাঁদপাল ঘাটে এসে ভিড়েছিল নব-নির্বাচিত গভর্নর জেনারেলের জাহাজ। গভর্নর জেনারেল জর্জ ইডেনের সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর দুই বোন ফ্যানি এবং এমিলি ইডেন। তাঁদের বাসস্থান ছিল রাজভবন। কলকাতায় এসে ফ্যানি এবং এমিলি রাজভবনে বহু পশু-পাখি পুষেছিলেন। দীর্ঘ পরিকল্পনার পরে ১৮৪১ সালে গঙ্গার কাছেই তাঁরা এক সুদৃশ্য বাগান তৈরি করেছিলেন। এই বাগানে বিভিন্নরকম ফুল, ফলের গাছ, পুকুর এবং বসার জায়গা ছিল। যদিও এই বাগানের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বাগানের মধ্যে এক বিশাল প্যাগোডা।বর্তমান মায়ানমারের প্রোম থেকে জাহাজে করে ভাগে ভাগে নিয়ে এসে বাগানের মধ্যে জোড়া লাগিয়ে বানানো হয়েছিল এই প্যাগোডা।

সুদৃশ্য এই বাগানে ইংরেজরা বিকেলবেলায় হাঁটতে যেতেন। এই বাগানের পশ্চিমদিকে একটা ব্যান্ড স্ট্যান্ড ছিল, যেখানে প্রতিদিন বিকেলে ফোর্ট উইলিয়ামের বাজনাদাররা বাজনা বাজাত। কথিত আছে যে, সন্ধ্যার পরে আলোর মালা পরে সেজে উঠত এই বাগান। ফ্যানি এবং এমিলি ইডেনের নাম থেকেই তাঁদের তৈরি এই বাগানের নাম হয় ইডেন গার্ডেন।

আরও পড়ুন: জেনে অবাক হয়েছিল ইউরোপের কর্তারা! কলকাতাতে রয়েছে এশিয়ার একমাত্র মার্সিডিজ ১৩০ এইচ

১৮৬৪ সালে বাগানের কিছুটা এবং বাগান-সংলগ্ন এলাকা নিয়ে তৈরি হয় দেশের প্রাচীনতম ক্রিকেট স্টেডিয়াম ইডেন গার্ডেনস। সেই সময়ে এই খেলার মাঠের নাম ছিল লর্ড অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন। জর্জ ইডেনের পদের নাম থেকেই এই নাম এসেছিল। পরবর্তীকালে বাগান এবং স্টেডিয়াম দুটোই ইডেন গার্ডেন নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে সেই বাগানের খুব অল্প অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়াম থেকে গঙ্গার দিকে হাঁটলে এই বাগানের কিছুটা দেখা যায়। বাগানে প্রবেশ করার নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। বাগানের ভেতরে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ, পুকুর এবং বসার জায়গা রয়েছে। ফ্যানি এবং এমিলি ইডেনের তৈরি বাগানের মূল আকর্ষণ সেই বার্মিজ প্যাগোডা আজও বাগানের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদিও প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার কারণে খুব বেশি মানুষ এই বাগানের অস্তিত্বের কথা জানেন না। যাঁরা জানেন, তাঁদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষ এই বাগান দেখতে যান। বাগানে প্রবেশের সময়, স্টেডিয়ামের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া অবস্থানের কারণে এই বাগান ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাচ্ছে।

শুধুমাত্র বাগান নয়, ইডেন গার্ডেনস স্টেডিয়াম বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। ১৯৮৩ সাল অবধি ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুধুমাত্র ইংল্যান্ডে আয়োজিত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে প্রথমবার ইংল্যান্ডের বাইরে কোথাও বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা হয়েছিল ইডেন গার্ডেনস স্টেডিয়ামে। ২০০১ সালের বর্ডার গাভাসকার ট্রফির সেই বিখ্যাত টেস্ট ম্যাচ আজও বহু মানুষের মনে রয়েছে। হারের মুখ থেকে ফিরে এসে ম্যাচ জিতে নেওয়া এবং ভারতীয় ক্রিকেটের এক নতুন যুগের সূচনার কারণে বহু মানুষের মুখে মুখে আজও সেই টেস্ট ম্যাচ ইডেন টেস্ট নামে পরিচিত। এই টেস্ট ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়া দলের খেলোয়াড় অ্যাডাম গিলক্রিস্ট বলেছিলেন যে, তাদের এক সতীর্থ চতুর্থ দিনের খেলা শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন যে, আজ বিকেলের মধ্যে তাঁরা জয়ের স্বাদ পেয়ে পার্টি করবেন। তাঁর এই কথা বলা যুক্তিযুক্ত ছিল, কারণ ভারতীয় টিম ম্যাচ বাঁচানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাটার আউট হয়ে গিয়েছিলেন। শচীন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় প্যাভিলিয়নে ফেরার পরে ম্যাচ বাঁচানোর দায়িত্ব ছিল ভি.ভি.এস. লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড়ের কাঁধে। খেলোয়াড়দের সবাই জানতেন যে, এই দুই জন অসুস্থ শরীরে খেলছেন। তাই এই উক্তি করা হয়েছিল। যদিও সব হিসেব উল্টোপাল্টা করে দিয়ে চতুর্থ দিনে সারাদিন দু'জন খেলোয়াড় অসুস্থ শরীরে খেলে গিয়েছিলেন। তৃতীয় দিনে কোনওমতে ম্যাচ বাঁচানোর চেষ্টা করা একটা দল পঞ্চম দিনে ম্যাচ নিজের হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেছিল।

২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর একদিনের ক্রিকেটের একটা ঐতিহাসিক দিন। ভারতীয় ব্যাটার রোহিত শর্মা সেইদিন ইডেন গার্ডেনসে ১৭৩ বলে ২৬৪ রান করেছিলেন, যা একদিনের ক্রিকেটের ব্যাটারদের মধ্যে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান। ইডেন গার্ডেনস স্টেডিয়ামে ভারতের মধ্যে প্রথম দিন রাতের টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়েছিল।

শুধু ভালো নয়, ইডেন গার্ডেনস বিভিন্ন খারাপ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। ১৯৯৬ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল বিশৃঙ্খলার কারণে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। ২০০৫ সালে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দল থেকে বাদ পড়ার ফলে বিরোধিতা করা একদল মানুষের দিকে তৎকালীন ভারতীয় কোচ গ্রেগ চ্যাপেল অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন।

সময়ের সঙ্গে অন্য সবকিছুর মতোই ইডেন গার্ডেন অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছে। শুধুমাত্র বাগান থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের যাত্রায় তার সঞ্চয় করা বহু গল্প নিয়ে সে শহরের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

More Articles