জয়নগর না বহড়ু? বিতর্ক ভুলে শীতকালে ফের শতবর্ষপ্রাচীন মোয়ার প্রেমে বাঙালি
Jaynagarer Moa: শীতকালের কারিগরদের মোটা টাকার বিনিময়ে মোয়া তৈরির কাজে নিয়োগ করা হয়। ওই কয়েক মাসের জন্য হেড কারিগরের মজুরি প্রায় এক লক্ষাধিক টাকা!
কথায় বলে, 'ছেলের হাতের মোয়া'। এ কথার মানে অনেকেই জানেন। এই দুনিয়ায় যা কিছু মনে হয় সহজেই প্রাপ্ত, আসলে সেও সহজে মেলে না। পেতে গেলে দিতে হয়। একমাত্র দিলেই পাওয়া যায়। মোয়া আসলে এমন এক মিষ্টান্ন যা বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। মোয়া অতি প্রাচীন মিষ্টি। সে তুলনায় জয়নগরের মোয়া শতবর্ষ পেরিয়েও এখনও নবীন। আর যত দিন যাচ্ছে চাহিদা বাড়ছে জয়নগরের মোয়ার। মোয়া ব্যবসায়ীরাও স্বাভাবিকভাবেই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছেন না। ওঁরা ছড়িয়ে পড়তে চাইছেন বিশ্বজুড়েই। কিন্তু সরকারি পরিকল্পনা বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে।
জয়নগরের গঞ্জের বাজারে কয়েক বছর আগে দু'হাজার স্কোয়ার ফুটের জায়গা বাছা হয়। সেখানে মোয়া হাব তৈরির কথা ঘটা করে প্রচারে এলেও উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। হাব তৈরি হলে 'মডিফায়েড অ্যাটমোস্ফিয়ার প্যাকেজিং' করে ভূ-ভারত তো বটেই, সসাগরা পৃথিবীজুড়ে মোয়ার চালান দেওয়া যেত। জয়নগরের মোয়া ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
জয়নগর স্টেশন লাগোয়া এলাকায় রাস্তার দু'ধারে সার দেওয়া মিষ্টির দোকান। সবচেয়ে পুরনো মিষ্টির দোকানটির নাম শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এই দোকান ১৯২৯ সালে খোলা হয়েছিল। সেই থেকেই চলছে। শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্রতিষ্ঠাতা পূ্র্ণচন্দ্র ঘোষ এবং নিত্যগোপাল ঘোষ আসলে ছিলেন দুই বন্ধু। স্থানীয় মানুষ দু'জনের নাম এখনও মনে রেখেছেন। ওঁরাই প্রথম জয়নগরের দোকান খুলে মোয়া বিক্রি শুরু করেন। আগে শীতকাল এলে ঘরে ঘরে জয়নগরের মোয়া তৈরি করে তা ট্রেনে চাপিয়ে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করা হত। সেকালের ইতিহাসও জয়নগরের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের ঠোঁটস্থ।
আরও পড়ুন- চৈতন্যর প্রিয় মিষ্টি, আজও রসকদম্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলার এই জেলা
অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি প্রতি শীতে জয়নগরের মোয়া তৈরি করেন রাজেশ দাস। জয়নগর স্টেশন এলাকায় রাজেশের চালু দোকান আছে। বয়সে নবীন রাজেশ জানালেন, জয়নগরের মোয়া নিয়ে বিতর্কের কাহিনি। রাজেশের কথায়, বহড়ুর মানুষজন দাবি করেন জয়নগরের মোয়া ওঁদের আবিষ্কার। কিন্তু তথ্য অন্য কথা বলছে। ১৮৮২ সালে জয়নগর রেল স্টেশন তৈরি হয়। আর বহড়ু রেলস্টেশন তৈরি হয়েছে ১৮৮৭ সালে। সেকালে যাঁরা জয়নগরের মোয়া ফেরি করতে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় 'চাই জয়নগরের মোয়া' বলে হাঁক পাড়তেন তাঁদের রেলের টিকিট দেখে আসল-নকল সম্পর্কে ক্রেতারা নিশ্চিত হয়েই মোয়া কিনতেন। এই যুক্তিতে জয়নগরের মোয়া জয়নগরের আবিষ্কার বলে দাবি করেন এখানকার মোয়া প্রস্তুতকারক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের সকলেই।
জয়নগরের মোয়া ব্যবসায়ীদের কাছে জানা গেল এখানকার মোয়ার বৈশিষ্ট্য। জয়নগরের মোয়া তৈরির প্রধান উপকরণ খই, নলেন গুড়, কনকচূড় ধান। এছাড়াও লাগে ঘি, এলাচ, কাজু, কিশমিশ, ক্ষীর। জয়নগরের মোয়ার জিআই বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন সার্টিফিকেটে এই উপকরণগুলির উল্লেখ রয়েছে। একইসঙ্গে বহড়ুর বাসিন্দাদের দাবিও খারিজ হয়ে গিয়েছে। জয়নগরের মোয়া আবিষ্কর্তার স্বীকৃতি পাননি তাঁরা। জয়নগর থেকে সারা বাংলা তো বটেই, ভারতে নানা প্রান্তেও শীতকাল এলে জয়নগরের মোয়া চালান যায়। বেঙ্গালুরুতে ব্যাপক চাহিদা এখানকার মোয়ার। এছাড়া দিল্লি, মুম্বইয়েও চাহিদা বেশ ভালো বলেই জানান ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় মানুষজনের মতে, ১৮৮৫ সালেও জয়নগর থেকে প্রকাশিত পত্রিকাতে জয়নগরের মোয়ার উল্লেখ রয়েছে। মোয়া ব্যবসায়ীরা এও জানান, প্রতি বছর শীতের মরসুমে জয়নগরের মোয়া অন্তত ৪০-৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে জয়নগরের মোয়ার ভেজাল মোয়াও বাজারে এসেছে। অভিযোগ উঠছে, নলেন গুড়ে পরিবর্তে চিনি, নলেন গুড় দিয়ে জয়নগরের মোয়া তৈরি করা হচ্ছে। ব্যাপারটা বন্ধও করা যাচ্ছে না। এতে ক্রেতারাও ঠকছেন।
জয়নগরের মোয়ার চাহিদা থাকলেও আরেক সঙ্কট দেখা দিয়েছে উপকরণ হিসেবে কনকচূড় ধানের ফলন কমে যাওয়ায়। কনকচূড় ধান উঁচু জমিতে চাষ হয়। কনকচূড় ধানের চাষিরা গত কয়েক বছরে কয়েকটি ভয়াবহ ঘূৰ্ণঝড়ের ফলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই ধান চাষ ছেড়ে চাষিরা অন্যান্য পেশায় চলে গিয়েছেন। চাষিদের মধ্যে অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে ভিনরাজ্যে কর্মরত। সুদূর অতীতে এলাকার বাসিন্দা দত্ত, মিত্র, রায়চৌধুরীরা জমি ইজারা নিয়ে কনকচূড় ধান চাষ করাতেন। সেই পাটও উঠে গিয়েছে বহু বছর আগেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের ১ এবং ২ ব্লকের বহু গ্রামেও জয়নগরের মোয়া তৈরি হয়। মোয়া ব্যবসায়ী খোকন দাসের কথায়, ক্রমশ শিউলির সংখ্যাও কমছে। শিউলিরা প্রধানত এলাকার বাসিন্দা মুসলমান সম্প্রদায়ের অতি দরিদ্র মানুষজন। খেজুরগাছে ওঠার কাজ ছেড়ে শিউলিদের মধ্যে অনেকেই ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী খোকন দাস আরও জানান, ওঁর বাবা-ঠাকুর্দাও জয়নগরের মোয়ার ব্যবসায়ী ছিলেন। শতাধিক বছরের পুরনো সেই ব্যবসা এখন তিনি সামলাচ্ছেন।
আরও পড়ুন- মিষ্টির জন্য ট্রেন দাঁড়াত এক ঘণ্টা! লেডিকেনির ইতিহাস আজও অবাক করে
জয়নগরের মোয়া তৈরির কারিগরদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু। শীতকালের যে কয়েকটি মাস জয়নগরের মোয়া তৈরি হয়, সেইসময়ে কারিগরদের মোটা টাকার বিনিময়ে মোয়া তৈরির কাজে নিয়োগ করা হয়। ওই কয়েক মাসের জন্য হেড কারিগরের মজুরি প্রায় এক লক্ষাধিক টাকা! এছাড়া সাধারণ কারিগরদের মজুরি মাসে ১০ হাজার অথবা তার চেয়ে খানিকটা বেশিই। মোয়া হাবের কাজ শেষ হলে জয়নগরের মোয়া ব্যবসায়ীরা মোয়া চালান দিতে পারবেন বিদেশেও। এমনভাবে প্যাকেজিং করা হবে যাতে দূরের পথ পাড়ি দিতে মোয়া না পচে যায়। কিন্তু হাব কবে বাস্তবায়িত হবে সে প্রসঙ্গ এখন বিশ বাঁও জলে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জয়নগরের দু'টি ব্লকের গ্রামাঞ্চল তো বটেই জয়নগর শহরের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের কারখানায় মোয়া তৈরির হিড়িক পড়ে। এছাড়া বহড়ুতেও তৈরি করা হয় মোয়া। শতাধিক বছর আগে জয়নগরের মোয়া ট্রেনে চাপিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে আনা হত যেমন, একইসঙ্গে স্থানীয় গঞ্জের হাটেও মোয়ার দেদার চাহিদা ছিল ক্রেতাদের কাছে। প্রতি শুক্রবার সেই হাট আজও বসে। হাটে মিলবে একশো শতাংশ খাঁটি জয়নগরের মোয়া। গঞ্জের হাটে দূরদূরান্ত থেকে মোয়া কিনতে আসেন রসিকরা। কলকাতা থেকেও হাটে থেকে মোয়া কিনতে আসেন অনেকেই।
যে কোনও বিষয় পুরনো হলে তার মাহাত্ম্য বাড়ে। বাজারে ভেজাল জয়নগরের মোয়ার রমরমা সত্ত্বেও খাঁটি জয়নগরের মোয়ার রাজ সিংহাসন আজও অটুট।