জঙ্গলে ঘেরা চৌরঙ্গি ছিল ডাকাতদের আখড়া!কলকাতার হাড়হিম সেই ইতিহাস অনেকের অজানা
Fancy Lane: জানেন কি, রাস্তার এই নামের আড়ালে আসলে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর ইতিহাস?
আজব শহর কলকাতা। এর অলিতে-গলিতে কত গল্প, ইতিহাস যে জমে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। যেমন ধরা যাক, রাজভবনের কাছের নিশ্চুপ গলিটা, যার নাম ফ্যান্সি লেন। শুনলেই মনে হয়, আহা, কী শৌখিন নাম! কলকাতার নতুন ম্যাপ দেখলে পান্নালাল ব্যানার্জি লেন নামে যে সরু রাস্তাটা খুঁজে পাবেন, এককালে তার নামই ছিল ফ্যান্সি লেন। কলকাতার সব রাস্তার নামকরণেরই প্রায় কোনও না কোনও গল্প রয়েছে। কিছু কিছু রাস্তার নাম হয়েছে সাহেব শাসকদের নামের অনুসরণে, কিংবা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মনীষীদের নামে। কিন্তু যেসব রাস্তার নামে এর কোনওটাই মেলে না, সেখানেই জমে ওঠে গল্প। ফ্যান্সি লেনও সেই রাস্তাদের অন্যতম। কিন্তু জানেন কি, এই নামের আড়ালে আসলে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর ইতিহাস?
ফ্যান্সি লেনের ইতিহাস
ফ্যান্সি নামটার সঙ্গে আদতে বাহার বা শৌখিনতার কোনও সম্পর্ক দূর-দূরান্তেও নেই। তবু কেন এর এমন নাম হলো, সেই কারণ খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অন্তত শ-দুয়েক বছর। এমন এক সময়, যখন কলকাতায় জাঁকিয়ে বসেছে ব্রিটিশ শাসন। তাদের মূল কেন্দ্র এই শহরটাই। তবে শুধু এই শহর নয়, তারা তখন প্রায় গোটা দেশেরই হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়ে উঠছে। আগেকার দিনে ছোটখাটো বিচার বসত গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে। আরেকটু বড়সড় গোলমাল হলে তা গড়াত স্থানীয় জমিদারের সেরেস্তায়। কিন্তু ইংরেজরা প্রথম থেকেই আইনশৃঙ্খলার রাশ ধরেছিল শক্ত হাতে। বিলিতি ধাঁচে আদালত গড়ে ওঠে এই সময়েই। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয় সুপ্রিম কোর্টের। আর এই আইনের জোর খাটাতে গিয়ে অনেক সময়ই কড়া শাস্তির পথেই হাঁটত ইংরেজ শাসকেরা। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় শাস্তিটা ছিল মৃত্যুদণ্ড। আর সাধারণত এই শাস্তি কার্যকর করা হতো অভিযুক্তকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। ইংরেজদের উচ্চারণে সেই ‘ফাঁসি’-ই হয়ে গেল ‘ফ্যান্সি’। আর আজকের ফ্যান্সি লেনের নামকরণ হয়েছিল এই ফাঁসি থেকেই।
আরও পড়ুন: তিলোত্তমা কলকাতাকে নাকি বলা হত ‘ব্ল্যাক টাউন’! নেপথ্যে কোন কারণ
কীভাবে এল ফ্যান্সি লেনের নাম
এই রাস্তার নাম হালে না হয় পান্নালাল ব্যানার্জি লেন হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগেও তো এর নাম ফাঁসি লেন ছিল। বিবাদি বাগ অঞ্চলে যাঁদের নিত্য যাতায়াত, তাঁদের অনেকেই 'ফাঁসি লেন' চিনবেন। এইটুকু পড়ে যাঁরা ভুরু কোঁচকাচ্ছেন, তাঁদের জানাই, গোরাদের গেরোতে এদেশের অনেককিছুর নামই পাল্টে গিয়েছিল। ‘কলকাতা’ হয়েছিল ‘ক্যালকাটা’, ‘বর্ধমান’ থেকে ‘বার্ডোয়ান’, ‘মেদিনীপুর’ হয়েছিল ‘মিডনাপুর’, ‘কাঁথি’ থেকে ‘কন্টাই’- সবই ব্রিটিশদের জিভের গুণে পাল্টে যাওয়া নমুনা। ‘ফাঁসি’ লেনও এভাবেই ‘ফ্যান্সি’ লেন হয়ে গিয়েছিল।
ডালহৌসির কাছে এখন যেখানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, বিলিতি আমলে একেবারেই লালদিঘির প্রায় গা-ঘেঁষা সাহেবপাড়া, তারই খুব কাছে এই ফ্যান্সি লেন। নবাবি আমলের ইতিহাস বলছে, ওই গোটা জায়গাটাই ছিল জঙ্গুলে জমি। লোকজন বিশেষ ছিল না বললেই চলে। একটু পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে গঙ্গা। বেশ কিছু চোর-ডাকাত, মাঝে মাঝে নবাবের সেপাই-সান্ত্রী আর কিছু তীর্থযাত্রী, যারা প্রাণ হাতে নিয়ে পার হতো ওই এলাকা। মনে রাখবেন, যখনকার কথা হচ্ছে, তখনও কিন্তু পলাশির যুদ্ধ হয়নি, ফলে গোরা সাহেবের রাজত্বও শুরু হয়নি এদেশে। সেই সময় হালিশহর থেকে কালীঘাটের মন্দির পর্যন্ত বিরাট লম্বা একটা রাস্তা ছিল। সেটাই ছিল ওই তীর্থযাত্রীদের পথ। কালীভক্তদের দল ওই পথ দিয়েই মন্দিরে যাতায়াত করতেন। রাস্তাটা চৌরঙ্গির জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে আদিগঙ্গার পাশ ছুঁয়ে কালীঘাটে গিয়ে পড়ত। তবে, তীর্থযাত্রী ছাড়াও অনেক ছোটখাটো ব্যবসায়ীর দলও ওই একই পথ দিয়ে ব্যবসা করতে যেত, সঙ্গে থাকত নানা জিনিসপত্র। অথচ, চৌরঙ্গির ওই জঙ্গল ছিল চোর-ডাকাতদের আস্তানা। তক্কে তক্কে থাকত তারা, সুযোগ পেলেই তীর্থযাত্রী বা ব্যবসায়ীদের মেরেধরে সবকিছু কেড়ে নিত। বাধা দিতে গেলে প্রাণ যাওয়াটাও বিচিত্র ছিল না। প্রচুর ডাকাতি হতো বলে নবাবি কোতোয়ালি বা সেপাইদের চৌকি ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডাকাতি বন্ধ করা যায়নি কিছুতেই। তখন নবাবি সেপাইরা ডাকাতদের মনে ভয় ধরানোর জন্য একটা বিচিত্র রাস্তা নিল। মাঝে মাঝে হাতেনাতে ডাকাত ধরে ফেলতে পারলে, দ্রুত বিচার করে ওখানেই ফাঁসি। সরাসরি ওই রাস্তার ওপরেই গলায় দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া, ব্যস! কেউ কেউ বলেছেন, ওখানে নাকি একটা ফাঁসির মঞ্চও ছিল, যেখানে চোর-ডাকাতদের ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। কীসের ফ্যান্সি লেন মশায়, এ তো ফাঁসির রাস্তা! সিরাজদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের সময়েও নাকি ফ্যান্সি লেন ছিল। ওই রাস্তার কাছাকাছি সিরাজের কামান বসানো হয়েছিল ইংরেজদের দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম ধ্বংস করার জন্য।
একটা সময় জোব চার্নক সুতানুটিতে পা রাখলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি তৈরি হলো। সেসময় থেকেই দূর-দূরান্তর থেকে মানুষজন এই অঞ্চলে আসতে আরম্ভ করে। উদ্দেশ্য ছিল মূলত দুটো। হয় ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করা, নয়তো তাদের কাছে চাকরি পাওয়ার আশা। চার্নক অবশ্য বেশিদিন বাঁচলেন না। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর জামাই চার্লস আয়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-র হয়ে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছ থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা নামের তিনটে গ্রামের জমিদারি স্বত্ব কিনে ফেললেন। এবার চৌরঙ্গি অঞ্চলের ডাকাতি বন্ধ করার দায়িত্ব তাঁদের ওপর বর্তাল। কোম্পানিও চৌকি বসাল সেখানে। শোনা যায়, কোম্পানির সিপাইরাও নাকি ডাকাতদের শায়েস্তা করতে ওই একই পথ নিত- ধরো আর ফাঁসিতে লটকে দাও!
কাদের ফাঁসি
ইংরেজরা নিজেদের যতই সুসভ্য বলে দাবি করুক, বিভিন্ন সময়ে তাদের কীর্তির যে ধরনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে কিন্তু বর্বরতার প্রকাশই ঘটেছে। যেমন, ব্রিটিশ যুগের প্রাথমিক পর্বে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার রীতি চালু ছিল। তখনও দেশে সুপ্রিম কোর্ট চালু হয়নি। জমিদারদের করা বিচারকেই নিম্ন আদালতের রায় বলে মান্যতা দেওয়া হতো। আর তাতে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া ছিল জলভাতের মতো ব্যাপার। আর এই নির্মম শাস্তি যে সবসময় কঠোর অপরাধের জন্য দেওয়া হতো, তা কিন্তু নয়, নানা হালকা অপরাধেও প্রকাশ্যে এই শাস্তি দেওয়ার কথা শোনা গিয়েছে। বলে রাখা ভাল, এই ভয়াবহতার প্রকাশ মোটেই গোপনে হতো না। কারণ, তা হলে তো নিজেদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেখানোর সুযোগটাই চলে যাবে। ফাঁসি দেওয়া হতো রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে। ফলে লোকে জানতে পারত যে, অমুক দিন অমুকের ফাঁসি হবে তমুক অপরাধের কারণে। আর সে ফাঁসি দেওয়া হতো আজকের এই পান্নালাল ব্যানার্জি লেন বা ফ্যান্সি লেনে। দিনের আলোয় এই শাস্তিদানের প্রক্রিয়া দেখতে অনেকেই ভিড় করতেন।
সুপ্রিম কোর্ট প্রথম যাঁকে ফাঁসি দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল, তিনি একে ব্রাহ্মণ, তায় রাজা। মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি ‘ব্রহ্মহত্যা’ বলে কলকাতাজুড়েই রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। আলিপুরের মাঠে সেই প্রথম ফাঁসির সাক্ষী হয়েছিল অনেক সাধারণ মানুষও। আসলে সেকালে এমন ভয়ানক দৃশ্যকেও লোকচক্ষু থেকে লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি ইংরেজরা। উল্টে পরবর্তী ফাঁসিগুলির ক্ষেত্রে তারা চেয়েছিল এমন ব্যবস্থা করতে, যাতে ব্রিটিশরাজের আইনের শাসনের ভয়ে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। সুতরাং বড় বড় গাছওয়ালা একটি রাস্তা বেছে নিয়েছিল তারা। যেখানে প্রকাশ্যে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া যাবে অপরাধীদের। মৃত্যুর পরেও দেহগুলিকে ওভাবেই রেখে দেওয়া হতো, দর্শকদের মনে ভয় জাগানোর জন্য। একটি ফাঁসির মঞ্চও তৈরি করা হয়েছিল ওই রাস্তাটিতে।
১৮০০ সালে এই রাস্তায় ফাঁসি হয় ব্রজমোহনের। সে একটি ঘড়ি চুরি করেছিল যার দাম ২৫ টাকা। মানছি প্রায় সোয়া দুশো বছর আগের ২৫ টাকা আজকের বিচারে অনেক টাকা। তবে এটা কিন্তু মানা যায় না যে, এই অপরাধের জন্য সুসভ্য ব্রিটিশরা একজন মানুষকে ফাঁসিতে চরাবে। বলাই বাহুল্য, সেই রাস্তাটিই ফ্যান্সি লেন। যা আজও নিজের নামের সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে ওই অভিশপ্ত ইতিহাস।
সেই রাস্তাকেই কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল
মোদ্দাকথা, যাতে মানুষ দেখতে পায় ও শিক্ষা অর্জন করে, সেই কারণে ফাঁসির স্থান হিসেবে ব্রিটিশদের প্রথম পছন্দ ছিল বড় বড় গাছযুক্ত রাস্তা। আজকের ফ্যান্সি লেন বা জঙ্গলঘেরা তখনকার সেই মেঠো পথের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল একটি খাল (হেস্টিংস নদী)। সেই খাল বুজে গিয়ে আজ কিরণশঙ্কর রায় রোড তৈরি হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, এক সময়ের হেস্টিংস নদী আজকের হেস্টিংস রোড। যাই হোক, সেই খাল বা নদীর ধার ধরে বেশ কিছু লম্বা গাছ ছিল। ফাঁসি দেওয়ার স্থান হিসেবে এগুলিকেই বেছে নেওয়া হতো।
সেই রাজাও নেই, সেই রাজপাটও নেই। শুধু তার চিহ্নগুলিই ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। আর হয়তো তেমন কিছু নেই এখানে, শুধু রয়ে গেছে কিছু অজানা মানুষের অতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস এবং মানবসভ্যতার কিছু বর্বর ইতিহাস। আজ ফ্যান্সি লেনে দাঁড়ালে কোনও ফাঁসির মঞ্চ দেখা যাবে না। রাস্তার ধারে গাছে ঝুলন্ত দেহও দেখা যাবে না। কিন্তু সেই নামটি একই থেকে গেছে।