মেমসাহেবের আবদার! সুলেখার ফিরিঙ্গি কালির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বাংলার নাড়ির টান
Sulekha Firingi Kali History: মেমকে কালি বানিয়ে দিতে বেঁকে বসলেন ননী গোপাল ও শঙ্করাচার্য। শ্রেণিশত্রু ইংরেজকে কালি বেচবেন না তাঁরা।
সাল ১৯৩০। ইংরেজরা জাঁকিয়ে বসেছে দেশে। স্বাধীনতার খোয়াব দেখছে মানুষ, বুঝতে পারছে সংগ্রামের পথ সহজ না। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশজুড়েই চলছে পাড়ায় পাড়ায় লড়াই, প্রকাশ্য রাস্তায় হোক বা হেঁশেলের অন্দরে, বিপ্লবের আঁচে ফুটছেন সকলে। ইংরেজদের এই দেশছাড়া করতে চরম আন্দোলন দরকার, মারের বদলা পাল্টা মার- নীতিতেই আস্থা রেখেছেন কেউ, কেউ বা ইংরেজদের সঙ্গে বসে, আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে দেশ স্বাধীন করার ভাবনায় হিংসার পথ ছেড়ে আসছে নরমপন্থার দিকে। পন্থা যাই হোক না কেন, উদ্দেশ্য একটাই। ইংরেজদের বিদায় করতে হবে। এত অত্যাচার, এত রক্তপাত অনন্তকাল সয়ে যাওয়া যাবে না। অস্ত্র ধরছেন কেউ কেউ, কেউ ধরছেন কলম। স্বদেশির ডাক উঠেছে দেশজুড়ে। পণ্য বয়কটের মধ্যে দিয়েই উঠে আসছে দেশিয় সম্ভাবনারা। সেই পথ বেয়েই জন্মেছিল সুলেখা কালি। ইংরেজদের কলম, ইংরেজদের তৈরি কালিটুকুও গ্রহণ করতে চাননি স্বাধীনতার লড়াই করা প্রতিটি মানুষ। সেই প্রয়োজনই জন্ম দিল কালির, প্রায় ৯০ বছর পর সেই কালিই ফিরেছে আবার। ফিরেছে ইতিহাসের গন্ধ মেখে।
স্বদেশি আন্দোলনের আঁচেই জন্ম সুলেখা কালির। ব্রিটিশদের তৈরি পণ্য বয়কট করার ডাক উঠেছে। তাই প্রয়োজনীয় সবকিছুরই দরকার দেশি বিকল্প। সেই সময় চিঠিপত্র লেখা ও অন্যান্য লেখালিখির কাজে বিদেশি কালিই ব্যবহৃত হতো। গান্ধিজি চাইলেন দেশি বিকল্প। সেই সময়ই রাজশাহীর স্বাধীনতা সংগ্রামী অম্বিকা চরণ মৈত্র এবং সত্যবতী মৈত্রের দুই সন্তান, ননীগোপাল এবং শঙ্করাচার্য মৈত্র গান্ধিজির সঙ্গে যোগ দেন স্বদেশি আন্দোলনে। গান্ধিজির অনুপ্রেরণাতেই স্বদেশি জিনিস তৈরির ব্যবসায় যুক্ত হন এবং ১৯৩৪ সালে রাজশাহীতে সূচনা হয় ‘সুলেখা ওয়ার্কস’-এর। ননীগোপাল পেশায় ছিলেন অবশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। সারাদিনের কাজকর্ম সেরে, রাতে এসে কালি তৈরির সমীকরণ গড়তেন ননীগোপাল। লক্ষ্য একটাই, দেশি কালি সাহেবদের কালি থেকে ভালো করতেই হবে। এই কালি বিক্রি করতেন ভাই শঙ্করাচার্য। ব্রিটিশ কালির বিরুদ্ধে সুলেখা কালিই হয়ে ওঠে স্বদেশি আন্দোলনের অস্ত্র। হাতে কলমে এই কালি কিন্তু মৈত্র পরিবারের মেয়েরাই মূলত তৈরি করেছেন। যে পুরুষ বিপ্লবীদের কথা আমরা জানি, বইয়ে পড়ি, ছবিতে দেখি, তার উল্টোপিঠেই রয়েছে স্বাধীনতার বারুদ বুকে জ্বলে ওঠা মেয়েরা। ইতিহাস তাঁদের ভুলিয়ে দিতে পারলেই রক্ষা পায়। স্বাধীনতার আন্দোলনে মেয়েরা অস্ত্রও যেমন ধরেছেন, তলে তলে সমস্ত নজরদারি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সাহায্য করে গিয়েছেন বিপ্লবীদের। তা সে অস্ত্র লুকিয়েই হোক, বোমা পাচার করেই হোক, নিষিদ্ধ ইস্তাহার লুকিয়ে, বিপ্লবীদের ঠাঁই দিয়েই হোক না কেন। অবিভক্ত বাংলার মৈত্র পরিবারে ছিলেন এমনই তিন বিপ্লবী কন্যা। এই মেয়েদেরই হাতে সেই পরাধীন দেশে জন্ম নিয়েছিল 'ফিরিঙ্গী কালি'। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সুবাদে বউবাজারের ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির কথা নয় কলকাতাবাসীরা কিছুটা জেনেইছেন, কিন্তু কালি কীভাবে হলো ফিরিঙ্গি?
ফিরিঙ্গি মানে গোদা অর্থে ধরতে গেলে বিদেশি, সাদা চামড়ার মানুষ। ফারসি শব্দ 'ফিরাঙ্গি' থেকেই এসেছে এই শব্দ। ইওরোপিয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম এসেছিল এই বাংলায়। তাই বাংলায় কিন্তু মূলত পর্তুগিজদেরই ফিরিঙ্গি বলা হয়। যদিও বাংলা ভাষায় ফিরিঙ্গি শব্দ দিয়ে কেবল আর পর্তুগিজদেরই বোঝানো হলো না। কালে কালে এই পরাধীন পোড়া দেশে শাসন করতে আসা, ব্যবসা করতে আসা সমস্ত সাদা চামড়ার মানুষকেই বলা হতে থাকলো ফিরিঙ্গি। আমাদের সুপরিচিত অ্যান্টনিও কিন্তু ছিলেন আদতে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত। কালিতে ফেরা যাক। ঝর্না কলম সংগ্রাহক এবং মৈত্র পরিবারের ঘনিষ্ঠ শুভব্রত গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, সুলেখার কর্ণধাররা সকলেই ছিলেন মহাত্মা গান্ধির আদর্শে অনুপ্রাণিত। এই মৈত্রবাড়ির মহিলারা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য জেলেও গিয়েছেন। পূর্ণিমা মৈত্র, উর্মিলা মৈত্র এবং কল্পনা মৈত্র ছিলেন সেই তিন স্বাধীনতা সংগ্রামী। বাড়িতে কালি তৈরির কাজটা করতেন তাঁরাই। ১৯৩৪-৩৫ সাল নাগাদ রাজশাহীতে এক মেমসাহেবের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁদের। বলা ভালো, কালি তৈরির কথা জানতে পেরে ওই বিদেশিনীই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন তিনি। মৈত্র পরিবারের বিপ্লবী মেয়েদের সেই আঁকার জন্য বিশেষ কালি বানিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
মেম সাহেব ধবধবে ফর্সা, মাখনের মতো ত্বক। পরিবারে ধীরে ধীরে 'মোম মেমসাহেব' নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন তিনি। বাড়িতে হামেশাই যাতায়াত, ধীরে ধীরে অল্প অল্প বাংলাও শিখলেন মোম মেমসাহেব। কিন্তু মেমকে কালি বানিয়ে দিতে বেঁকে বসলেন ননী গোপাল ও শঙ্করাচার্য। শ্রেণিশত্রু ইংরেজকে কালি বেচবেন না তাঁরা। তাছাড়া, মোম মেমহসাহে ইংরেজদের চর কিনা তাই বা কে জানে! পূর্ণিমা মৈত্র মনে করিয়ে দিলেন গান্ধিজির কথা। ব্রিটিশরা অত্যাচারী সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্রিটিশদের সঙ্গে জড়িত সকলেই তো শত্রু নন! আসলে ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার কম। প্যাস্টেল শেডের দিকেই ঝোঁক বেশি। মোম মেমসাহেবের তাই বাজার চলতি উজ্জ্বল কালি দিয়ে এঁকে পোষাচ্ছিল না। তবে, সেই সময় আদৌ মোম মেমসাহেবের জন্য কালি তৈরি হয়েছিল কিনা তার নথি নেই কোনও। বহুকাল পরে, এই ননীগোপাল মৈত্রর খাতা থেকেই মেলে মোম মেমসাহেবের জন্য তৈরি করা বিশেষ কালির ফর্মুলা! তবে ফিরিঙ্গি মেমের জন্য তৈরি হওয়া সেই ৬ টি বিশেষ কালিই পরিচিত হয়ে গেল ফিরিঙ্গি কালি নামে। ২০২২ সালে ননীগোপালের খাতা থেকে মেলা সেই কালির ফর্মুলা দিয়ে নতুন করে তৈরি হলো ফিরিঙ্গি কালি!
আরও পড়ুন- সবুজ পৃথিবীর দিকে এক পা, কালি কলমে পথ দেখাচ্ছে সুলেখা-মান্দাস
এই ৬ টি রঙের কালির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। ফিরিঙ্গি কালি এখন পাওয়া যায় পিতলের হাতলওয়ালা কাঠের একটি বাক্সে। ভিতরে থাকে ছয়টি বোতল, খানিক আলতার শিশির মতো দেখতে। ফিরিঙ্গি কালির যে ছয়টি রং এখন মেলে তা হলো:
ফ্যাকাশে লাল (কালী 'মায়ের পায়ে'-র লাল রংকেই নির্দেশ করে এই কালি),
হালকা কমলা (ভক্তি বা বিশ্বাসের প্রতীক),
ধূসর (সন্ধাবেলার পুজো বা প্রার্থনার প্রতীক),
পবিত্র সবুজ (কালীর পুজোয় ব্যবহৃত 'বেল পাতা'-র রং)
খয়েরি (কালীর চরণ ধূলি বা আশীর্বাদের প্রতীক) এবং
ল্যাভেন্ডার (সুগন্ধি আশীর্বাদ বা পবিত্র সুগন্ধের প্রতীক)
সুলেখার এই ফিরিঙ্গি কালির চাহিদা যে ভাবনাতীত, তা জানালেন মান্দাস প্রকাশনার কর্ণধার সুকল্প চট্টোপাধ্যায়। মান্দাসের ঠিকানায় গেলেই ১০ শতাংশ ছাড়ে মেলে এই কালি। তবে ১৫ অগাস্ট উপলক্ষ্যে, স্বাধীনতা দিবস এবং এই সুলেখা কালির ঐতিহ্যকে মাথায় রেখেই ২০ শতাংশ ছাড়ে মিলছে এই কালি। ৬,০০০ টাকা দামের এই কালির সংগ্রহের দাম পড়বে ৪,৮০০ টাকা। স্বাধীনতার এই গোটা মাস জুড়েই মান্দাসে মিলবে ফিরিঙ্গি কালি দামে ছাড়! এত দাম দিয়ে কালি কেনার মতো কি পৃথক কোনও আবেদন মানুষের মনে গড়ে তুলতে পেরেছে সুলেখা? মান্দাসে এই কালি বিক্রির বাজার কেমন? সুকল্প জানালেন, যারা এই কালি কিনছেন তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে মান্দাস। তাঁদের সঙ্গে কথা বলা, তাঁদের মনকে, ভাবনাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। তবে হ্যাঁ, সাধারণ মানুষের থেকেও বেশি সংগ্রাহকরা এই ফিরিঙ্গি কালি কেনেন বেশি। তারা আসলে ইতিহাসের, স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অভিজ্ঞান হিসেবে রেখে দিতে চান এই কালিকে। এখন চিত্রশিল্পীরা সুলেখা কালি দিয়ে ছবি আঁকছেন। ফিরিঙ্গি কালির যে শেডগুলো রয়েছে, তা সচরাচর বাজারে পাওয়া যায় না। তাই এই অনন্য রংয়ের কদর আছে শিল্পীদের কাছে। আর্ট কলেজ থেকে অনেক শিল্পীরাই এই কালি সংগ্রহ করে নিয়ে যান। আর যারা ঝর্না কলম ভালোবাসেন তাঁদের তো অনেকেই এই কালি সংগ্রহে রাখতে চান।
ফিরিঙ্গি কালির দাম অনেকখানি, একথা সত্য। তবে এটি যে সংগ্রাহকদেরই বিশেষ আকর্ষণের তা অনস্বীকার্য। সেগুন কাঠের বাক্সে, পুরোনো দিনের আলতার শিশির মধ্যে এই যে প্যাকেজিং, তা অবশ্যই নান্দনিকতার কথা, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ভেবেই করা হয়েছে। সুলেখা সবার কালি, তবে ফিরিঙ্গি কালি একেবারেই সংগ্রাহকদের জন্য।