বলে লাথি কষিয়ে খানিক খোশগল্প, খানিক তামাক! যেভাবে চলত আদ্যিকালের ফুটবল

World Cup Football 2022: ১৮৭২-এ প্রকট হল রেফারি অবতার। তার আগে পর্যন্ত খেলোয়াড়রা নিজেরাই নিজেদের জজিয়তি করত, ফাউল-টাউল হলে নিজেরাই শাস্তি দিত।

বল

চিনদেশের লোকেরা প্রাচীনকালে চামড়ার খোলের মধ্যে শন ভরে বল বানিয়ে খেলত। মিশরে ফারাওদের সময় রংবেরঙের কাপড়ের গেলাপে খড় কিংবা বিভিন্ন বীজের ভুষি ঠেসে নিয়ে খেলা চলত। গ্রিক আর রোমানরা ষাঁড়ের মূত্রাশয় হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে নিয়ে মুখটা সেলাই করে খেলত। মধ্যযুগে বা রেনেসাঁসের সময়ে ইওরোপে ঘোড়ার চুল ভরা খানিকটা ডিম্বাকৃতির বল নিয়ে খেলা চলত। আমেরিকায় বল বানানো হতো রবার দিয়ে আর সে বল এমন লাফাত, যেন সোজা দিকশূন্যপুরে পৌঁছে যাবে। হিস্পানি দেশের দরবারি ঐতিহাসিকেরা বলেছেন অ্যাস্তেকদের হারিয়ে মেহিকোকে নিজেদের মুঠোয় আনা কনকিস্তাদোর এরনান করটেস নাকি এমনভাবে বল মেরেছিল যে রাজা চার্লসের চোখ ট্যারা হয়ে গিয়েছিল।

রবারের ব্লাডারকে বাতাস ভরে ফোলানোর পর চামড়ায় মুড়ে নেওয়ার রেওয়াজটা ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে চালু হয়, সেজন্য আমাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত আমেরিকার কানেকটিকাটের প্রতিভাশালী মানুষ চার্লস গুডইয়ারকে। এর অনেক পরে আরহেন্তিনার তোসোলিনি, ভ্যালবোনসি এবং পোলো কোরদোবা শহরের এই তিন আবিষ্কর্তা ব্লাডারের মুখ-বাঁধার ফিতেকে চিরতরে বিদায় দিয়ে আধুনিক বলের জন্ম দিলেন। তারা ব্লাডারের জন্য ভাল্ভ আবিষ্কার করলেন, যাতে ফিতে ছাড়াই বলে হাওয়া ভরে রাখা যায়। ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপ থেকে ফিতের ধাক্কায় চোট না-লাগিয়েই মনের সুখে ফুটবলে হেড করা চলছে।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বল হতো বাদামি রঙের। তারপর থেকে সাদা। আমরা যখন বড় হলাম তখন থেকেই সাদা জমির উপর কালো রঙের বিভিন্ন নকশা ফুটে উঠতে লাগল। আজকালকার বলের কটিদেশ ষাট সেন্টিমিটারের বেশি নয়, আর তার পেলব শরীর পলিইথিলিন ফোমের উপর পলিইউরেথেন সাজিয়ে গড়ে তোলা, জলনিরোধী, আধ কিলোরও কম ওজন এবং পুরনো দিনের বলের চেয়ে অনেক বেশি জোরে যায়। আগে বল যেমন বৃষ্টির দিনে নড়তেই চাইত না, এগুলো তেমন নয়।

এর নানা নাম- গোল্লা, গোলু, যন্তর, পৃথিবী, বেলুন, গোলা। ব্রাজিলে যেমন কারও মনে এ ব্যাপারে কোনও সংশয়ই নেই যে, বল প্রকৃতপক্ষে এক মোহময়ী রমণী। ব্রাজিলীয়রা বলকে গাবলুগুবলুও বলে, একেবারে ‘ওলে বাবালে’ গোছের, নয়তো নাদুসনুদুস কিংবা আহ্লাদি খুকি। তারা বলের রকমারি নামও দেয়- মারিকোতা, লিওনোর অথবা মার্গারিতা।

পেলে যখন মারাকানায় নিজের সহস্রতম গোলটি করলেন তখন বলে একটি চুমু খেয়েছিলেন। দি স্তেফানো নিজের বসতবাড়ির সামনে বলের একটি ভাস্কর্য তৈরি করিয়েছিলেন একটা ব্রোঞ্জের বল আর তার সামনে ধাতব পাতে লেখা, ‘ধন্যবাদ, বুড়ি’।

বল আবার প্রেমে পাগলিনী রাধার মতো, কানু বিনে গীত নাই। ১৯৩০-এ প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলই নিজেদের বলে খেলার গোঁ ধরে বসে। বাইবেলের জ্ঞানী সলোমন যেমন একই শিশুর মাতৃত্বের দুই দাবিদারের মধ্যে সত্যিকারের মাকে সহজ প্রজ্ঞায় চিনে নিয়েছিলেন, রেফারিও তেমনই সেবার নির্দেশ দেয় খেলার প্রথম অর্ধে আরহেন্তিনার বলে খেলা হবে আর দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ের বলে। মজার ব্যাপার হল আরহেন্তিনা প্রথম অর্ধে জিতেছিল, উরুগুয়ে দ্বিতীয়ার্ধে। বল আবার কখনও কখনও রহস্যময় আচরণও করে, বিশেষ করে গোলে ঢোকার সময়। অনেক ক্ষেত্রেই সে উড়ালের মাঝপথে মত বদলে বাঁক ফিরে অন্য দিকে চলে যায়। আর জানেনই তো মেয়েরা অল্পে চটে যায়। ক্রমাগত তাকে পায়ে ঠেললে বা আঘাত করলে তা মেনে নেবেই বা কেন? সে আদর চায়, চায় চুম্বন, খেলোয়াড়ের প্রশস্ত বুকে আশ্রয় চায়, কিংবা পায়ের পাতায় স্থির হয়ে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিতে চায়। সে গর্বিতা নারী, যদিও গর্ব করার সত্যিকারের কোনও কারণ নেই, তবু নিজের জায়গাটা বুঝে নেওয়ার ব্যাপারে তার অসামান্য পারদর্শিতা। সে খুব ভালো করে জানে, যখন লাবণ্যের বিভা ছড়িয়ে সে উড়ে যায়, তখন বহু মানুষের বুকে বসন্তের হিল্লোল বয়ে যায়। আর যদি তেমন সুন্দর না হয় তার গতি, শত মানুষের বুক দুমড়ে মুচড়ে যায়।

আরও পড়ুন- বাপের আবেগ বর্তায় ছেলের উপরে! ফুটবল আসলে যুদ্ধের পরম্পরা?

উৎপত্তি

আমাদের চেনা জানা আর পাঁচটা জিনিসের মতো ফুটবলের ব্যাপারেও চিন সব্বার থেকে এগিয়ে। পাঁচ হাজার বছর আগে চৈনিক বাজিকর পায়ে বল নাচিয়ে কেরামতি দেখাত, প্রথম ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করতেও তারা খুব বেশি দেরি করেনি। তখন মাঠের মধ্যিখানে জাল খাটানো হত, খেলোয়াড়দের হাত না লাগিয়ে শুধু পায়ে পায়ে বল নিয়ে খেলতে হত, মাটিতে বল ঠেকে গেলেই সব বরবাদ। এই খেলা সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য ধরে বংশানুক্রমে চলে। যিশুর জন্মের আগেকার কোনও কোনও প্রত্ন বাস-রিলিফের কাজে এর নমুনা দেখতেও পাওয়া যায়। আবার মিং সাম্রাজ্যের শেষের দিকে নির্মিত কয়েকটি খোদাইয়ের কাজে দেখা যায় একটা বল নিয়ে কেউ খেলছে। বলটা এমন চমৎকার যে মনে হয় বুঝি অ্যাডিডাসই বানিয়েছে!

একথা নতুন নয় যে প্রাচীনকালে মিশরীয়রা যেমন, তেমনই জাপানিরাও বল পিটিয়ে বেজায় সুখ পেত! খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এক গ্রিক সৌধে মার্বেলের মেঝেতে একজনকে দেখা যায় বলের সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকতে। আন্তিফানেসের গ্রিক কমেডিতে ‘লম্বা বল’, ‘ছোটো পাস’, ‘সামনের দিকে পাস’ এইসব শব্দবন্ধও দিব্যি জায়গা পেয়েছে। গ্রিকরা বলে, সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নাকি দারুণ পা চলত, অন্যদিকে নিরো জীবনে গোল করতে পারেনি। আর এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই স্বয়ং যিশু যখন ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, তখন রোমানরা ফুটবলের মতোই একটা কিছু খেলছিল।

রোম সাম্রাজ্যের সৈন্যবাহিনী তো পায়ে বল নাচাতে নাচাতেই ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে এসে হাজির হয়। এক শতাব্দী পরে, ১৩১৪-য় রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড অবশ্য এই খেলা বন্ধ করতে রীতিমতো ডিক্রি জারি করেন। রাজার সিলমোহর দেওয়া ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্য ছিল, ফুটবল প্রাচীন রোমের হীনকুলোদ্ভবদের খেলা এবং দাঙ্গা ছড়ায়। "নগরে যদি একটা বলকে ঘিরে প্রবল হল্লাহাটি চলে, ঈশ্বর না করুন, অশুভ আত্মারা সব জেগে উঠতে পারে"। ফুটবল, ততদিনে খেলাটা এই নাম পেয়ে গেছে, বহু প্রাণহানির কারণ হয়ে উঠেছিল। দু' দল গুণ্ডার মধ্যে খেলা চালু হয়ে গিয়েছিল, প্রতি দলে ক'জন করে খেলোয়াড় থাকবে তার কোনও নিয়ম ছিল না। কতক্ষণ খেলা চলবে ইত্যাদি নিয়ম কানুনের কেউ ধারও ধারত না। একটা গোটা শহর অন্য একটা শহরের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে যেত, বলে লাথি-গুঁতো মারতে মারতে গোলের দিকে এগিয়ে যেত। সে গোল হয়তো বহুদূরের সৈকতে হাওয়াকলের কাছে। খেলা চলত বেশ কয়েকদিন ধরে, বিস্তৃত ভূখণ্ড জুড়ে, আর প্রাণও যেত অনেকের। রাজারা বারবার এই খতরনাক খেলা নিষিদ্ধ করেছে। ১৩৪৯ সালে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড ফুটবলকে ‘বেহুদা হাস্যকর খেলা’ বলে দেগে দেন। এমনকী রাজা চতুর্থ হেনরি আর ষষ্ঠ হেনরির আমলে যথাক্রমে ১৪১০ আর ১৪৪০ সালের শিলালিপিতেও ফুটবল বিরোধী মন্তব্য খোদাই করা আছে। তবে শাসকের লাল চোখ মানুষের মনে ফুটবলের খিদে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। যত তাকে আটকানোর চেষ্টা হয়েছে, ততই মানুষ ফুটবলের দিকে ঝুঁকেছে।

১৫৯২-য় শেক্সপিয়র ‘কমেডি অফ এররসে’র ভ্রান্তিবিলাসে ফুটবলকে ব্যবহার করলেন এক চরিত্রের অভিযোগ সাজাতে,

"আমি কি এতই গোল আপনার চোখে/ যে হাঁকাবেন এমনভাবে ফুটবলের মতো?/ আপনি এখান থেকে ওখানে আর উনি ওখান থেকে এখানে হাঁকাবেন এভাবে?/এ চাকরিতে টিকে গেলে মুড়বেন আমায় চমড়ায়।"

আবার কয়েক বছর বছর পর ‘কিং লিয়রে’ আর্ল অফ কেন্ট টিটকিরি মেরে বলবে, "হে নিকৃষ্ট ফুটবলার, ল্যাংও তো কেউ মারেনি তোমায়!" ফ্লোরেন্সে ফুটবলকে বলে কালচিও, গোটা ইতালিতেই তাই বলে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফুটবলের উগ্র সমর্থক ছিলেন, ম্যাকিয়াভেলি নিজে ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। মাঠে তিনটে রেখা টেনে প্রত্যেক দলের সাতাশজন করে খোলোয়াড়কে তিন ভাগে ভাগ করে নিয়ে কালচিও খেলা চলত। সে সময় বল মারা আর প্রতিপক্ষের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য পায়ের সঙ্গে হাত ব্যবহার করারও নিয়ম ছিল। ফ্লোরেন্সে ম্যাচ দেখতে ভিড় উপচে পড়ত, খেলা হতো বড় বড় বাজারে কিংবা ঠান্ডায় জমে যাওয়া আরনো নদীর উপর। ওদিকে ফ্লোরেন্স থেকে বহুদূরে ভাটিকানের রম্য উদ্যানে পোপ সপ্তম ক্লেমেন্ত, নবম লিও এবং অষ্টম আরবান দিব্যি কাপড় গুটিয়ে প্রাণভরে কালচিও খেলতেন।

আমেরিকার মধ্যভাগে এবং মেহিকোয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালেরও আগে থেকে সূর্যোপাসনার মতো পবিত্র ধর্মীয় সমারোহে রবারের বল ফুলিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু আমরা জানি না, এই মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কবে থেকে ফুটবলের প্রচলন হল। আমাজনের তীরে বসবাসকারী বলিভিয়ার আদি বাসিন্দেরা বলে থাকে, তারা নাকি স্মরণাতীত কাল থেকে দুই পোস্টের মাঝে নাদুসনুদুস রবারের বল নিয়ে খেলে আসছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জেসুইট ঘরানার এক হিস্পানি পাদ্রি পারানা নদীর উত্তরাংশের ওয়াহ্‌রানি জনজাতির মধ্যে প্রচলিত এক প্রাচীন প্রথার কথা বলেছেন,

"ওরা আমাদের মতো হাতে করে বল ছোঁড়ে না, বরং খালি পায়ে বলটাকে পায়ের পাতায় নিয়ে প্রবল বেগে উড়িয়ে দেয়"।

মেহিকো এবং মধ্য আমেরিকার আদি বাসিন্দেদের মধ্যে প্রচলন ছিল নিতম্ব কিংবা হাতের কনুই থেকে মুঠো পর্যন্ত অংশ দিয়ে বল মারার। অবশ্য মেহিকোর তেওতিউয়াখান এবং চিচেনইৎজার প্রাচীন চিত্রকলায় কিন্তু পা আর হাঁটু দিয়ে বল মারতে দেখা যায়। মেহিকোরই তেপাতিতলানের একটা ম্যুরালে আমাদের কালের হুগো স্যাঞ্চেজের ঠাকুর্দাকে বাঁ পায়ে বল নিয়ে কসরৎ করতে দেখা যায়! খেলা তো শেষ হবে বল গন্তব্যে পৌঁছলে, সারারাত অর্কদেব মৃত্যুপুরীতে ঘুরপাক খাওয়ার পর অন্ধকার ফিকে হয়ে ভোর হবে। তারপর অনন্ত সূর্যোদয়, আবার রক্ত বইবে ধমনী-শিরায়। অনেকের মতে, অ্যাস্তেকদের অভ্যেস ছিল বিজয়ীদের কুরবানি দেওয়ার। মুণ্ডু কেটে নেওয়ার আগে তাদের গায়ে লাল রঙের ডোরা-ডোরা দাগ দেওয়া হত। ঈশ্বরে বলিপ্রদত্তরা নিজেরদের রক্ত দিয়ে পৃথিবীকে উর্বর করত, করুণাময়ের অশেষ কৃপা বর্ষিত হত।

আরও পড়ুন- দর্শক তো তার মুণ্ডু চায়, যন্ত্রণার বিনিময়ে কী পায় রেফারি?

ফুটবলের আইন-কানুন

কয়েক শতাব্দীর রাষ্ট্রীয় অস্বীকৃতির পর, ফুটবল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভাগ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলে ফুটবলকে আর হীনকুলোদ্ভবদের খেলা হিসেব না দেখে আভিজাত্যের পরাকাষ্ঠা হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়। দেশের ভবিষ্যতের নেতারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠোনে ফুটবল খেলে নিজেদের জিগীষায় শান দিতে শেখে। এভাবেই লাট-বেলাটের ছানাদের নতুন যৌবনের আকুতি ভাষা পায়, ক্ষুরধার হয় তাদের চারিত্র্য, তারা ক্রোধ সংবরণ করতে শেখে, বুদ্ধি ধারালো হয়ে ওঠে। এই সামাজিক বৃত্তের বাইরে, খেটে খাওয়া মানুষের অবিশ্যি মেহনত করার ক্ষমতা নতুন করে আর মেপে নেওয়ার কোনও প্রয়োজনই ছিল না, তার জন্য কারখানায় মজদুরিই যথেষ্ট। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের আঁতুড়ঘর এবং পুঁজিবাদের পিতৃভূমি ইংল্যান্ড ফুটবলের মধ্যে আবিষ্কার করে জনতার উষ্ণ অনুরাগ যা বিনোদনের চূড়ান্ত, গরিবের সান্ত্বনা এবং অবশ্যই কারখানায় ধর্মঘটের মতো যত অশুভ চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য খুবই উপযোগী।

আধুনিক ফুটবলের জন্ম ১৮৬৫ সালে, ইংল্যান্ডের বারোটি ক্লাবের মধ্যে লন্ডনের কোনও সরাইখানায় হওয়া এক ভদ্দরলোকের চুক্তির মাধ্যমে। ক্লাবগুলি ১৮৪৬ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত ফুটবলের আইন-কানুন মেনে চলার ব্যাপারে একমত হয়। কেমব্রিজে ততদিনে ফুটবলের সঙ্গে রাগবির আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ফুটবলে হাতে করে বল নিয়ে দৌড় মারা নিষিদ্ধ হয়েছে, যদিও বল ছোঁয়ায় কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না, কিন্তু প্রতিপক্ষকে লাথি মারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। "কেবলমাত্র বলেই লাথি মারা যাবে", আইন করে সাবধান করে দেওয়া হয়। দেড় শতক বাদে আজও অবিশ্যি খেলোয়াড়রা মাঝেমাঝেই বলের সঙ্গে প্রতিপক্ষের মাথার খুলিটাকে গুলিয়ে ফেলে, দুটোরই আকার একই রকম কিনা!

লন্ডন চুক্তিতে কিন্তু প্রতি দলে ক'জন করে খেলোয়াড় থাকবে তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি, অথবা মাঠের আকার-আয়তন নিয়ে বা গোলপোস্টের উচ্চতা নিয়ে কিংবা সবথেকে বড় যে বিষয়টা, খেলাটা চলবে কতক্ষণ, সে বিষয়েও কোনও নীতি প্রণয়ন করা যায়নি। তখন খেলা হত দু' তিন ঘণ্টা ধরে, কুশীলবরা লম্বা বল মেরে খানিক খোশগল্প করে নিত, একটু তামাক খেত। একটাই আধুনিক নিয়ম প্রণীত হয়েছিল, অফসাইডের নিয়ম। তখনকার দিনেও প্রতিপক্ষের ব্যাকের পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে গোল করাটাকে বেইমানি বলে মনে করা হত।

সে সময় মাঠে নেমে কেউ নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় খেলত না, সবাই মনের সুখে বলের পেছনে দৌড়ত। যে যেভাবে পারে দৌড়তে দৌড়তে নিজের ইচ্ছেমতো জায়গা বদলে নিত। আনুমানিক ১৮৭০-এ স্কটল্যান্ডে প্রথম রক্ষণ, মাঝমাঠ, আক্রমণভাগে দল সাজিয়ে খেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হল। ততদিনে প্রতি দলে এগারো জন করে খেলার নিয়ম সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৮৬৯ থেকে কেউ আর হাত দিয়ে বল ছুঁতে পারে না, বল লুফে নেওয়া বা হাত থেকে আলতো করে পায়ের কাছে ছেড়ে দিয়ে শট মারাও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ১৮৭১ সালে এই নিয়মের খানিকটা ব্যতিক্রম ঘটানো হল, বল আটকানোর জন্য গোলকিপারকে শরীরের সমস্তটা ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হল।

গোলকিপার তার চৌকো দুর্গ সামলাত, তখন অবিশ্যি সেটা আজকের চেয়ে ছোটো ছিল, কিন্তু উচ্চতা ছিল বেশি। দু'খানি পোস্ট একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা থাকত, মাটি থেকে বেল্টের উচ্চতা নির্দিষ্ট থাকত সাড়ে পাঁচ মিটার। ১৮৭৫ সালে বেল্টের বদলে কাঠের ক্রসবারের প্রচলন হল। গোল হত পোস্টের মধ্যে দিয়ে সামান্য বাঁকিয়ে বল ঢুকিয়ে। ইদানিং ক'টা গোল হল, বৈদ্যুতিন স্কোরবোর্ডে সেটা লেখা হয়। কিন্তু ‘গোল মারা’ কথাটা রয়েই গেছে। কোনও কোনও দেশে গোলমুখের অংশটাকে আরকো, মানে ধনুক বলা হয়। আর যারা গোল আটকায় সেই গোলকিপারকে বলে আরকেরো। যদিও গোলের সামনে যে আঁক কাটা তা সমকোণ, আদৌ ধনুকের মতো নয়। মনে হয় এসবই ইংরেজ ছাত্রদের দৌলতে, যারা কলেজের উঠোনে খিলানের মধ্যে দিয়ে গোল করে বড়ো হয়।
১৮৭২-এ প্রকট হল রেফারি অবতার। তার আগে পর্যন্ত খেলোয়াড়রা নিজেরাই নিজেদের জজিয়তি করত, ফাউল-টাউল হলে নিজেরাই শাস্তি দিত। ১৮৮০-তে হাতে ক্রনোমিটার নিয়ে রেফারি হয়ে বসল সর্বময় কর্তা। কখন খেলা শেষ হবে, কাকে মাঠের বাইরে নির্বাসিত করা হবে- সব সিদ্ধান্ত সেই নিতে শুরু করল। যদিও তখনও পর্যন্ত রেফারি মাঠের সাইড লাইন ধরে দৌড়ত। ১৮৯১-এ সে প্রথমবার মাঠে পা রাখার অনুমতি পেল, বাঁশি বাজিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার পেনাল্টি কিক দিল, রাগে গজগজ করতে করতে দেখিয়ে দিল বলটা ঠিক কোথায় বসাতে হবে। একসময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বেশ কিছুদিন পেনাল্টির পক্ষে জোরদার সওয়াল করে, কেননা তাদের মনে হয়েছিল গোলের সামনে খেলোয়াড়দের কিছুটা সুরক্ষা থাকা প্রয়োজন, ওখানে যেরকম কসাইয়ের কারবার চলে তার থেকে খেলোয়াড়দের খানিকটা আড়াল করা দরকার। গোলমুখে কত খেলোয়াড় খুন হয়েছে আর কতজনের পায়ের হাড় ভেঙেছে তার একটা লোম খাড়া করা তালিকা ছেপেছিল ওয়েস্টমিনস্টার গেজেট।

১৮৮২-তে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা খেলায় থ্রো-ইন চালু করে। এর আট বছর বাদে মাঠের সীমানা বোঝাতে চুনের দাগ দেওয়া শুরু হল আর ঠিক মধ্যিখানে একটা বৃত্ত আঁকা হল। ওই বছরই গোলে জাল খাটানো শুরু হল, যাতে বলটা আনায়াসে তাতে জড়িয়ে যেতে পারে। ফলে গোল হওয়া না-হওয়া নিয়ে সংশয় দূর হল।
এভাবেই খেলায় ব্রিটিশের একচেটিয়া দাপট রেখে ঊনবিংশ শতাব্দীর মৃত্যু হল। ১৯০৪-এ জন্ম হল ফিফা-র, ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনস। তারপর থেকে ফিফাই বল আর পায়ের মধ্যেকার যাবতীয় সমীকরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যদিও এরপর যতগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হয়েছে তাতে ব্রিটিশদের তৈরি করা আইন-কানুনের সামান্যই বদলেছে।

 

কৃতজ্ঞতা : শেক্সপিয়রের পংক্তিগুলি সুনন্দন চক্রবর্তীর অনুবাদ

 

More Articles