সবুজ রামের পুজো হয় এই জেলাতে! বাংলার রামবিজয়ার যে ঐতিহ্য অনেকেরই অজানা
Howrah Ramrajatala Mandir: রামের গায়ের রং সবুজ, যা পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতের অনেক অংশেই দেখা যায়।
বাংলা ক্যালেন্ডার থেকে শ্রাবণ বিদায় নিয়েছে সদ্য। আর দু'মাসের মাথায় দুর্গাপুজো। অত্যুৎসাহী অনেকেই কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিয়েছেন। তবে দুর্গোৎসব ছাড়াও রয়েছে বিবিধ উৎসব যা বহরে এবং ঐতিহ্যে দুর্গাপুজোর মতোই বিশেষ। এই রাজ্যেই হাওড়ার মানুষ অপেক্ষা করে থাকেন শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার হতে চলা হাওড়ার স্থানীয় কার্নিভাল ‘রাম বিজয়া’-র। যদিও তথাকথিত উৎসবের খবরে এই অদ্ভুত শোভাযাত্রা নিয়ে আলোচনা খুবই কম হয়। সারা দেশে রামের তৈরি করা নয়া প্রতিচ্ছবির ভিড়ে হাওড়ার রাম, বাঙালির নিজস্ব রাম। পেশিহীন, উগ্রতাহীন একেবারে নিখাদ বাঙালি পুরুষ রাম। রামনবমী থেকেই শুরু হয় হাওড়ার রামরাজাতলায় অবস্থিত রাম মন্দিরে রামের পুজো। বিশাল আকৃতির মৃন্ময় প্রতিমায় পূজিত হন রাজারাম। তবে এই মূর্তির বেশ কিছু বিশেষত্ব আছে, প্রথমত রামের গায়ের রং সবুজ, যা পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতের অনেক অংশেই দেখা যায়। মনে করা হয়, রাম কামদেবের মতোই আকর্ষণীর ছিলেন, কামদেবের গাত্রবর্ণ যেহেতু সবুজ, সেই জন্য রামও সবুজ। দ্বিতীয়ত, প্রায় ৩০ টির কাছাকাছি ছোট বড় প্রতিমা থাকে মূল কাঠামোয়। মূল কাঠামোকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। উপরের সিঁড়ির ধাপের মতো একটি অংশ, মাঝে তিনটি মূল প্যানেল এবং একদম নীচে আরও একটি অংশ। একদম উপরে থাকেন বসুদেব, তারপরে পঞ্চ সরস্বতী ও দু'টি সিংহবাহিনীর মূর্তি। মাঝের মূল প্যানেলে থাকেন রাম ও সীতা। রামের ডানদিকের অংশে থাকেন শিব এবং বাঁ দিকের অংশে থাকেন ব্রহ্মা। কাঠামোর নীচের অংশে থাকে বিশ্বামিত্র, বাল্মীকি, জাম্বুবান, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, লব, কুশ প্রমুখের মূর্তি। আলাদা করে একই মন্দিরের অন্য মণ্ডপে পূজিত হন হনুমান, বামন অবতার, সাবিত্রী ও সত্যবান এবং যমরাজ। শ্রাবণের শেষ রবিবার অন্যান্য ছোট মূর্তিগুলি সমেত মূল বড় কাঠামোটি বিসর্জনের পথে অগ্রসর হয়। তবে একমাত্র রাম মন্দিরের প্রতিমা নয়, আরও তিনটি বৃহৎ প্রতিমা ও তার আনুসঙ্গিক অন্যান্য প্রতিমাও নিরঞ্জন হয়, ইছাপুরের শমীচণ্ডী, পুরোনো নবনারীকুঞ্জের প্রতিমা এবং নতুন নবনারীকুঞ্জের প্রতিমা।
আসা যাক শমীচণ্ডীর কথায়। এ এক অদ্ভুত ইতিহাস। হাওড়ার ইছাপুর অঞ্চলে পানের চাষ হতো। সেই পানের বরজে একসময় শমী পোকার আক্রমণ হয়। শমী পোকার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য শুরু হয় শমীচণ্ডীর পুজো। শমীচণ্ডীর মূর্তির মূল কাঠামোটিও তিনটি মূল প্যানেলে বিভক্ত। মাঝে থাকেন চতুর্ভুজা চণ্ডী। চণ্ডীমূর্তির ডানদিকে শিব এবং বাঁদিকে পুরন্দর ইন্দ্র। তাছাড়া রামচন্দ্রর প্রতিমার মতো অনেক মাঝারি ও ছোট প্রতিমাও থাকে কাঠামোয়।
পুরোনো এবং নতুন নবনারীকুঞ্জের প্রতিমা দু'টি সবথেকে আকর্ষণীয়। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে নবরসের ভাবনা। প্রাচীন ভারতীয় মন্দির ভাস্কর্যে এবং মিনিয়েচার পেইন্টিং ধারার বেশ কিছু ছবিতে এইরকম চিত্র দেখা যায় যে ন’টি নারীশরীর মিলে একটি হাতির গড়ন তৈরি করেছে এবং তার পিঠে বসে আছেন রাম বা কৃষ্ণ। হাওড়ার নবনারী মূর্তি অনেকটা এইরকম। তবে এখানে একা শ্রীকৃষ্ণ থাকেন না, তাঁর সঙ্গে থাকেন রাধারানী। এই পুরোনো আর নতুন দু'টি মূর্তিই আপাতভাবে অনেকটা কাছাকাছি, তবে এই দু'টির মধ্যে মূল পার্থক্য পুরোনো নবনারীরকুঞ্জের প্রতিমাগুলির ধাঁচ মানুষের কাছাকাছি এবং নতুন নবনারীরকুঞ্জের প্রতিমাগুলির ধাঁচ বাংলা ঘরানার।
আরও পড়ুন- পাহাড়ের কোলে রয়েছে বিশাল মনসা মন্দির, ২০০ বছরের এই ঐতিহ্য অনেকেরই অজানা
শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার এই চারটি মূল প্রতিমা এবং তার সঙ্গে অজস্র ছোট বড় পার্শ্বপ্রতিমা নিজ নিজ মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে কিছুটা রাস্তা অতিক্রম করে আসার পর সাঁতরাগাছি মোড় থেকে হাওড়া চিন্তামণি ঘাটের দিকে রওনা হয়। এখানে বলে রাখার, এই সাঁতরাগাছি কিন্তু রেলস্টেশন বা ঝিলের জন্য বিখ্যাত সাঁতরাগাছি নয়। এটি ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’র লেখক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি সংলগ্ন সাঁতরাগাছি মোড়। মূল প্রতিমাগুলি যেহেতু আকারে অনেকটাই বড়, সেই জন্য মূল প্রতিমাগুলিকে ট্রলির উপরে বসিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করতেই হয়। একসময় হাওড়া ময়দান এলাকায় ট্রাম চলাচল করত। জনশ্রুতি আছে, রাম বিসর্জনের সময় ট্রামের তার ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য ইংরেজ সরকার এই শোভাযাত্রার রাস্তা পরিবর্তনের কথা বলে, তবে জনতা তা কোনওভাবেই তা মেনে না নেওয়ায় ইংরেজ সরকার সেই তার খুলে ফেলতে বাধ্য হয়।
এই শোভাযাত্রার আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইংলিশ ব্যান্ড। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে কলেজস্ট্রিটে যাওয়ার রাস্তায় যে ধুঁকতে থাকা ইংলিশ ব্যান্ডের দোকানগুলো দেখা যায়, তারা নিজেদের সব স্বপ্ন ও আশা নিয়ে বাজাতে আসেন এই রামবিজয়াতে। নিরঞ্জন শোভাযাত্রার মরশুমের প্রথম শোভাযাত্রা যেহেতু রামবিজয়া, সেইজন্য অনেক বাজনদাররা এই উপলক্ষ্যে বাজাতে কোনও পারিশ্রমিক নেন না। এই শোভাযাত্রায় আরও দু'টি জিনিস দেখা যায়। প্রথমটি হলো লুপ্তপ্রায় কিছু হস্তশিল্প, যেমন ট্যামটেমি, তালপাতার সেপাই, কাগজের চরকি, সবুজ ফোম দিয়ে তৈরি টিয়াপাখি প্রভৃতি এবং দ্বিতীয়টি সং ও বহুরূপী, যাদের এখন প্রায় দেখাই যায় না সেভাবে।
আজকের ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ আর ‘আদিপুরুষ’-এর বাজারেও হাওড়ার রামরাজাতলা এক বিকল্প রামের খোঁজ দেয়। রামনবমীর মিছিলে প্রতিবার যে হিংসা-দ্বেষের চিত্র দেখা যাচ্ছে হাল আমলে, তেমন কোনও ছবিই কিন্তু এই শোভাযাত্রায় দেখা যায়নি কোনওদিন। অযোধ্যারাম চৌধুরীর হাত ধরে যে রামপুজোর সূচনা হয়, যে প্রতিমা দর্শন করতে আসতেন স্বয়ং মা সারদা সেই ঐতিহ্য বাংলার নিজস্ব রামের। শ্রাবণের বৃষ্টি মেখে রাম বিদায় নিলেন, না সরযু তে নয়, গঙ্গাতেই। রাম বিদায় নিলেই দুর্গা চলে আসেন। বাংলার স্থানীয় ঐতিহ্যে কোনও উগ্রতা নেই, বৈচিত্র্য আছে। এই বৈচিত্র্যেরই ঐক্য হয়ে ওঠার কথা ছিল।