টিকিট কেটে থিয়েটার দেখার শুরু জাতীয় রঙ্গালয়ে, দেড়শ বছর পেরিয়েও যে ইতিহাস রয়েছে অজানাই
Theatre : জাতীয় রঙ্গালয়ের ১৫০ : কিছু গল্প, বাকিটা ইতিহাস
২০২২-এর ডিসেম্বর মাসটা এক বিশেষ কারণে বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ এবছর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় রঙ্গালয় বা ন্যাশনাল থিয়েটারের সার্ধশতবর্ষ। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটার তার পথ চলা শুরু করে। এই সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে কলকাতা শহরে ৭ তারিখ এখনকার প্রধান প্রধান নাট্যব্যক্তিত্বরা মিছিল বের করলেন, ‘নীলদর্পণ’ আবার অভিনয় হল, মোদ্দা কথা একটা আড়ম্বরপূর্ণ প্রতিষ্ঠাদিবস পালন হল। তবে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়, ন্যাশনাল থিয়েটার ঠিক কতটা ন্যাশনাল ছিল এবং এর পিছনের প্রকৃত ইতিহাসটা ঠিক কীরকম?
জাতীয় রঙ্গালয়ের প্রসঙ্গে আসার আগে ২ টি সংগঠনের কথা বলতেই হয়, একটি বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার এবং অন্যটি শ্যামবাজার নাট্যসমাজ।
১৮৬০ এর দশকের শেষ দিকে বাগবাজার অঞ্চলের কিছু যুবকের মধ্যে নাট্যকলা চর্চার প্রয়াস দেখা যায়। এঁরা হলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাধামাধব কর, ধর্মদাস শূর ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। প্রথমে মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের মহরা শুরু হলেও পরবর্তীতে দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাটকের মহরা শুরু হয় এবং ১৮৬৮ সালের সপ্তমী পুজোর রাত্রে বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখার্জি পাড়ায় প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে এই নাটকের প্রথম অভিনয় হয়। পরবর্তীতে এ নাটক কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে শ্যামপুকুরের নবীনচন্দ্র বাড়িতে ও শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রায় রামপ্রসাদ মিত্রের বাড়িতে অভিনীত হয়। শোনা যায়, রামপ্রসাদ বাবুর বাড়িতে অভিনয়ের সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং নাটককার দীনবন্ধু মিত্র।
আরও পড়ুন - অতিমারীর পরেও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ! বাংলা থিয়েটারে ‘স্টার’ নয়, ‘কনটেন্ট’-ই আসল রাজা
বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার এর পরে পরিণত হয় শ্যামবাজার নাট্যসমাজে। মূল উদ্যোক্তারা একই থাকেন, তবে গোষ্ঠীর নাম পরিবর্তন হয় মাত্র। শ্যামবাজার নাট্যসমাজ কলাকুশলীরা দীনবন্ধু রচিত ‘লীলাবতী’ নাটক অভিনয় করে ১৮৭২-এর মে মাসে। সেই প্রথম তারা প্রতি সপ্তাহে নাট্যাভিনয় শুরু করলেন। তার সঙ্গে চালু হল সাধারণদের জন্য টিকিট কেটে নাটক দেখার বন্দোবস্ত। আর এই ঘটনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে জাতীয় রঙ্গালয়ের বীজ যা চারাগাছে পরিণত হবে সেই বছরেরই শেষে।
কলকাতায় ও ঢাকায় সেকালের সমসাময়িক সময়ে টিকিট বিক্রি করে থিয়েটার দেখার একটা বন্দোবস্ত করা হলেও সেটা সাফল্য পায়নি। এমনই এক সময় শ্যামবাজার নাট্যসমাজের লোকজন ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করার চিন্তাভাবনা শুরু করলেন। শুরু হল ‘নীলদর্পন’ (দীনবন্ধু মিত্র)-র রিহার্সাল।
এই যে নতুন থিয়েটার খোলার পরিকল্পনা হচ্ছে, এর নাম নিয়ে একটা গোলযোগ বাঁধল শুরুতেই। ইংলিশম্যান পত্রিকা ‘A new native theatrical society’ র আত্মপ্রকাশের খবর প্রকাশ করে (১৮৭২, ২০ নভেম্বর)। এই সোসাইটির নামকরণের ক্ষেত্রে অনেকেই ‘ন্যাশনাল’ শব্দটি প্রয়োগের পক্ষে সওয়াল করেন। নবগোপাল মিত্র নাম প্রস্তাব করেন ‘The Calcutta National Theatre’, মতিলাল শূর আবার Calcutta শব্দটি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন। এই বিন্দুতেই বাকিদের সঙ্গে গিরিশচন্দ্র ঘোষের বিরোধ বাঁধে, তিনি এই অভাবে ভরা থিয়েটারকে কিছুতেই মন থেকে ‘ন্যাশনাল’ থিয়েটার হিসাবে গ্রহণ করতে সম্মত হতে পারছিলেন না। ফলস্বরূপ গিরিশ দল ছেড়ে বেরিয়ে যান। গিরিশের অনুপস্থিতিতেই অর্ধেন্দু সহ আরও বেশ কিছু গুণীজনের নেতৃত্বে ‘The National Theatrical Society’ বা ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নাম নিয়ে এই থিয়েটারের পথ চলে শুরু হয়। ১৮৭২ এর ৭ ডিসেম্বর চিৎপুরের ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’ নামে পরিচিত মধুসূদন সান্যালের অট্টালিকায় স্টেজ বেঁধে প্রথম অভিনয় হয় ‘নীলদর্পণ’। ন্যাশনাল থিয়েটারের সম্পাদক ছিলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্টেজ ম্যানেজার ছিলেন ধর্মদাস শূর। টিকিটের মূল্য ছিল প্রথম শ্রেণীতে ১টাকা ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ১০ আনা।
অন্যদিকে, এইসময় গিরিশ দল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে কিছু অনভিপ্রেত কাজকর্ম শুরু করলেন। সেই মুহূর্তে যারা ন্যাশনালে ছিল, যেমন বেণী মিত্র, কিরণচন্দ্র মতিলাল, নগেন্দ্রনাথ, ধর্মদাস, ক্ষেত্রমোহন, ভুবনমোহন, শশিভূষণ, অমৃতলাল, অর্ধেন্দুশেখর প্রমুখকে বিদ্রুপ করে কবিতা লেখা বা বেশ কিছু সংবাদপত্রকে দিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটারের বিপক্ষে খবর প্রকাশ করানো ইত্যাদি কাজে হাত লাগলেন। তবে এসব করে গিরিশ খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি, বরং কবিতায় ‘হাঁড়ি শুড়ি’-র মতো শব্দ ব্যবহার ও তাদের ছোট করার ফলে গিরিশের নিজের ভাবমূর্তি কোথাও গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
৭ তারিখের অভিনয়ের পর থেকেই প্রতি সপ্তাহে ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনয়ের খবর পাওয়া যেতে লাগল। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ অভিনয় হল ‘জামাই বারিক’ নাটক (দীনবন্ধু মিত্র), ঠিক তার পরের সপ্তাহে অর্থাৎ ২১ তারিখ আবারও অভিনয় হল ‘নীলদর্পণ’। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় যে তাদের মধ্যে এই থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু তা কতটা সাফল্য পেয়েছিল? দেখে নেওয়া যাক…
যখন ন্যাশনাল থিয়েটার নিজের জায়গা পোক্ত করছে, সেই সময়ে গিরিশ আবার ফিরে আসেন ন্যাশনালে। গিরিশ বাইরে থেকে যে কাজটি করতে পারেননি, ভিতরে এসে সেই কাজটি করে ফেললেন। গিরিশর সঙ্গে কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতানৈক্য তৈরি হয়। এরই মধ্যে ৮ মার্চ ১৮৭৩, ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকের অভিনয় হয়। এটাই শেষ। এর পরবর্তীতে আর অখণ্ড ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয় হয়নি। ন্যাশনাল দুটি ভাগে ভেঙে যায়। যথা - এক ন্যাশনাল থিয়েটার ও দুই হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার (যা পরবর্তীতে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নাম গ্রহণ করে)। প্রথম দলে ছিলেন গিরিশ, ধর্মদাস, মতিলাল প্রমুখ এবং দ্বিতীয় দলে ছিলেন অর্ধেন্দু, কেদারনাথ, অমৃতলাল, ক্ষেত্রমোহন প্রমুখ।
আরও পড়ুন - ডায়লগ মাথায়! নলিনকাকু স্টেজেই চেঁচিয়ে উঠল, “এই ছুরি ফেরত দে, খেলিস না…”
এর পরবর্তী পর্যায়ের ইতিহাস অনেক উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, দুটি দলই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পূর্ব বাংলা সফর করে, ন্যাশনাল দল ব্যর্থ হয় ও গ্রেট ন্যাশনাল ‘রামাভিষেক’ নাটকের জোরে সফল হয়। কলকাতায় ফিরে এসে অর্ধেন্দুশেখর গ্রামে গ্রামে গিয়ে থিয়েটার বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করেন (যার মধ্যে অনেকে গণনাট্যর লক্ষণ খুঁজে পান), যার ফলে অর্ধেন্দুর নাম হয়ে যায় ‘মিশনারি অফ বেঙ্গলি স্টেজ’। বিডন স্ট্রিটে ‘গ্রেট ন্যাশনালে’র কাঠের বাড়ির থিয়েটার প্রথম অভিনয়ের রাত্রেই আগুন লেগে পুড়ে যায়। আবার এতকিছুর মধ্যেও দু-দল একত্রে হয়ে ১৮৭৩ সালের ৭ ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রথম বর্ষপূর্তিও পালন করে।
যদি এখন ন্যাশনাল থিয়েটারের সময়কাল দেখি, তাহলে তা কাঁটায় কাঁটায় তিন মাস। এই তিন মাসেই এসেছে হাজারও গোলযোগ ও গোঁজামিল। গিরিশ যে কাজগুলি করেছিলেন তা ঠিক না ভুল সে বিচার করার আমরা কেউ নই, তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, এই নড়বড়ে ৩ মাসের থিয়েটারকে কি এই দেড়শো বছর পরেও ‘জাতীয় রঙ্গালয়’ নাম দিয়ে মহিমান্বিত করা যায়? এ উত্তর হয়তো সময়ই দিয়ে দেবে।