দিনে রাজা, রাতে লুটেরা! পশ্চিমবঙ্গের ডাকাত-কালীর সঙ্গে জড়িয়ে গা ছমছমে ইতিহাস
Kalipuja history: পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি ডাকাত কালীপুজোর কথা জানা যাক আজকে।
বাংলার ডাকাতদের সঙ্গে কালীর সংযোগ রয়েছে বহুকাল ধরেই। বাংলার বহু প্রসিদ্ধ কালীপুজোর নেপথ্যে ছিলেন বাংলার কিংবদন্তি ডাকাতরা। শুধু তাই নয়, বহু সুপরিচিত পীঠস্থান নির্মাণ-ও করেছেন তাঁরা। বীরভূম, মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি বর্ধমান, বাঁকুড়া-সহ বাংলার বহু কালীপুজো শুরু করে ছিলেন সে-যুগের অন্ধকারের সাধকরা। রাঢ়বঙ্গের মহাপরাক্রমী রঘু ডাকাত ছিলেন মাতৃসাধক। ডাকাত মনসুর, ডাকাত সর্দার চাঁদ, জেবনা ডাকাত, ডাকাত ভৈরবরাও মা কালীর উপাসক ছিলেন। এঁরা যত বড়ই ডাকাত হয়ে যান না কেন, কালীর আশীর্বাদ ছাড়া কোনও ডাকাতি করতে যেতেনই না। এর থেকে বোঝা যায়, বাংলায় জাঁকজমকপূর্ণ শক্তিসাধনার মূলে ছিলেন এই বাংলার ডাকাতরাই। আজও বাংলার গ্রামে গ্রামে খোঁজ করলে জানা যায়, অমুক গ্রামে অমুক ডাকাত শুরু করেছিলেন এক ঐতিহ্যবাহী কালীপুজো। একটা সময় সমস্ত বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপদ্রব ছিল ডাকাতের। আজ সেই ডাকাতরা না থাকলেও সেইসব স্থানে রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের ডাকাত-কালীরা। পশ্চিমবঙ্গের এমনই কয়েকটি ডাকাত কালীপুজোর কথা জানা যাক আজকে।
রঘু ডাকাতের ডাকাত-কালী
তবে শুরু হোক এক কিংবদন্তিকে দিয়েই, শুরু হোক দোর্দণ্ডপ্রতাপ রঘু ডাকাতের কালীপুজো দিয়ে। চারদিকে গা ছমছমে একটি জঙ্গল, এবং তার মাঝে এক জায়গায় রটন্তি কালীমন্দির। মাঘ চতুর্দশীতে ধুমধাম করে হয় রটন্তি কালীর পুজো। ভূত চতুর্দশীতেও পুজো হয় এখানে। স্থানীয়দের কাছে এই মন্দির এখনও এক কিংবদন্তির সমান। কেননা কেতুগ্রামের এই মন্দিরে কালীপুজো শুরু করেছিলেন রঘু ডাকাত। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ পুলিশের থেকে বাঁচতে নদিয়ার কেতুগ্রামে দলবল-সমেত আশ্রয় নিয়েছিলেন রঘু ডাকাত। শাস্ত্রমতে, এখানে সতীর ওষ্ঠ পড়েছিল। তাই এই সতীপীঠের নাম অট্টহাস। জানা যায়, এই জঙ্গলেই রঘু ডাকাত শুরু করেছিলেন কালীপুজো। সেই থেকেই রঘু ডাকাতের কালী বলে পরিচিত দেবী। আজও প্রতি বছর কালীপুজো উপলক্ষে ধুমধাম করে পুজো হয় এখানে।
বাংলার নানা ইতিহাসে অনেক জায়গাতেই রঘু ডাকাতের নাম এবং তার প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দিরের কথা পাওয়া যায়। বর্ধমান হোক বা হুগলি, অথবা মুর্শিদাবাদ, এরকম নানা জেলাতেই পাওয়া যায় রঘু ডাকাত এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের সন্ধান। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না কলকাতাতেও একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল রঘু ডাকাত। উত্তর কলকাতার কাশীপুর রোড এবং খগেন চ্যাটার্জি রোড ছিল তৎকালীন ভাগীরথী নদীর তীরে এক জঙ্গলময় এলাকা। আর এই জঙ্গলে ভরা এলাকাই ছিল রঘু ডাকাতের ডেরা। এই রঘু ডাকাতের হাতেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলা কালী। রঘু ডাকাত ছিলেন পরম বৈষ্ণব, তবে তিনি শাক্ত মতেই করতেন মা কালীর পুজো। কথিত আছে, মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন রঘু ডাকাত। মনে করা হয়, মা কালীর আদেশেই ধীরে ধীরে ডাকাতির পথ থেকেও সরে আসেন তিনি।
আরও পড়ুন: ডালে দোল খাওয়া বালিকাই আসলে কালী! কিংবদন্তি কথা বলে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের মন্দিরে
ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ মেটের বামা কালীপুজো
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের নিকটবর্তী পাণ্ডুক গ্রামের ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ মেটের প্রতিষ্ঠিত সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো বামা কালী। এই পুজোয় মায়ের মূর্তির বাঁ পা-টি সামান্য এগিয়ে থাকে। প্রতিবছর কার্তিক মাসের আমাবস্যায় ২২ ফুট উচ্চতার মৃন্ময়ী মায়ের মূর্তি তৈরি করে মহা সমারোহে পুজো হয়। এই পাণ্ডুক গ্রামের মেটে পরিবারের পূর্বপুরুষ ছিলেন বিখ্যাত ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ মেটে। শোনা যায়, মেটলি গ্রামের 'রাম-সীতা' মন্দিরের স্বর্ণ অলঙ্কার ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ মেটে। ফেরার পথে বীরভূমের কাছাকাছি এসে তারা এক অপরূপ সুন্দর নারীর মূর্তি দেখতে পায়। সেই সময় ডাকাতদের নিয়ম ছিল যাই হয়ে যাক না কেন পথে শিশু বা নারীর গায়ে হাত তোলা যাবে না। কিন্তু সেই দলের এক সদস্য সেই নিয়ম ভুলে সেই নারীর দিকে এগোতে গেলে তাকে তলোয়ারের কোপে দু'টুকরো করে দেন প্রহ্লাদ সর্দার। সেই অপরিচিতা নারীর কাছে ক্ষমা চেয়ে সর্দার জানতে চান কে তিনি। তখন সেই নারী জানান, যে তিনি কালী বামা।
ডাকাতি করতে যাওয়ার পথে দলটি দেখে মা মৃন্ময়ী মূর্তি থেকে চিন্ময়ী মূর্তি ধরে জানান, "আমাকে এখান থেকে নিয়ে না গেলে তোদের সর্বনাশ হবে।" ডাকাতরা তখন দেবীকে বলেন, এবারের ডাকাতিতে সাফল্য পেলেই মা-কে তারা সঙ্গে নিয়ে যাবে। দেবীর আশীর্বাদে সফল হয় ডাকাতরা। তাই ডাকাতি করে ফেরার পথে বামা মায়ের ছোট শিলা মূর্তিকে সঙ্গে নিয়ে ফেরেন ডাকাত দলটি। পাণ্ডুক গ্রাম ঢোকার পথে মায়ের নির্দেশ মতো তির ছোড়েন এবং সেই তির এসে পাণ্ডুক গ্রামের মাঝখানে পড়ে। সেখানেই মা বামাকে স্থাপন করেন সাধক ডাকাত প্রহ্লাদ। এরপর থেকে প্রতি বছর কার্তিক মাসে অমাবস্যার গভীর রাতে, ঢাক ঢোল বাজিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে ডাকাত দলের সদস্যরা মায়ের ঘট এনে পুজো করতেন। বর্তমানে সেই স্থানে দেবীর বিশাল মন্দির তৈরি হয়েছে এবং আজও সেখানে ধুমধাম করে পুজো হয়। তবে একটি মজার নিয়ম আছে, এই বামা কালীর পুজোতে ডাকাত পরিবারের বংশধররা আজও কোনও না কোনও জিনিস চুরি করে নিয়ে আসেন।
কেলে ডাকাতের ডাকাত-কালী
শোনা যায়, হুগলির জিরাটের জমিদার কালাচাঁদ ছিলেন মা কালীর বড় ভক্ত এবং নিয়ম করে ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মায়ের পুজো দিতেন তিনি। যদিও জমিদার পরিবারের সদস্যরা একথাকে স্রেফ রটনা বলেই উড়িয়ে দেন। যাই হোক, ক্রমে কেলে ডাকাতের দৌরাত্ম্যের জন্য জিরাটের নাম বদলে হয়ে গেল কালীগড় বা কেলেগড়। এই কেলে ডাকাতের দল পশুবলি এবং নরবলি উভয়ই দিত। জমিদার কালাচাঁদ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং উদার মানুষ। গরিব-দুঃখিদের মুক্ত হস্তে দান করতেন তিনি। অথচ রাতের অন্ধকারে তিনিই হয়ে উঠতেন কেলে ডাকাত। স্থল ও জলপথে ডাকাতি করতেন। শুধু লুটপাট নয়, ডাকাতি করতে গিয়ে কাউকে কাউকে ধরে এনে গোপন কুঠুরিতে আটকে রাখতেন। রাতে তাদের মা কালীর কাছে এনে নিজেই বলি করতেন। অনেকে বলেন কোনও নিষ্পাপ বা নির্দোষ মানুষের গায়ে হাত তুলতেন না কেলে ডাকাত। যাদের বলি দেওয়া হয়েছে তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও গর্হিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কেলে ডাকাতের শুরু করে যাওয়া সেই কেলেগড়ের ডাকাত কালীপুজো দেখতে আজও ভিড় জমান মানুষ।
সিঙ্গুরের পুরুষোত্তমপুরের ডাকাত-কালী
সিঙ্গুরের পুরুষোত্তমপুরের এই ডাকাত কালীর প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানা মত রয়েছে। অনেকের মতে এই কালীর প্রতিষ্ঠা করেন রঘু ডাকাত। আবার অনেকের মতে এই কালী ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন ইংরেজদের অতিষ্ঠ করে তোলা বিপ্লবী ডাকাত বিশু সর্দার। ইতিহাসবিদদের মতে, নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হাতে অস্ত্র তুলে নেন বিশু। শোনা যায়, বহু নীলকর সাহেবকে খুন করে নীলকুঠিসমেত তাদের জ্বালিয়ে দিয়েছিল এই বিশু ডাকাত। অনেকের মতে, চালকেবাটির মোড়ল দেবীর স্বপ্ন পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় এই মন্দিরটি জঙ্গলের মধ্যে হওয়ায় ডাকাতি করতে যাওয়া ও ফেরার পথে মায়ের পুজো দিত ডাকাতরা। এখানে নরবলি হত বলেও শোনা যায়। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদটি গগন সর্দারকে নিয়ে। জমিদারদের কাছে ত্রাসের আরেক নাম ছিল গগন ডাকাত। শোনা যায়, এক সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ দেবকে হুগলিতে দেখতে যাচ্ছিলেন মা সারদা। সেই সময় গগন ডাকাতের দলের খপ্পরে পড়েন তাঁরা। তখনই নাকি আশ্চর্য ভাবে সারদা মায়ের মধ্যে মা কালীকে দেখতে পান গগন ডাকাত। ভয় পেয়েই নাকি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এই জাগ্রত কালীমন্দির।
মনোহর ডাকাতের ছানা কালী
অনেকেই জানেন দক্ষিণ কলকাতার মনোহরপুকুর রোডের নাম আসলে বিখ্যাত ডাকাত সর্দার মনোহর বাগদির নামে। তিনি মনোহর সর্দার নামেই বেশি খ্যাত। সেই সময় কলকাতার দক্ষিণের অংশটি ছিল সম্পূর্ণ গভীর জঙ্গলে ভরা। মাঝ দিয়ে বয়ে যায় আদিগঙ্গা। সেখানেই দলবল নিয়ে ডেরা দিয়েছিলেন মনোহর সর্দার। শোনা যায়, একদা ডাকাতি করে ফেরার পথে একটি শিশুকে বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন মনোহর সর্দার। অনেক খোঁজ করেও শিশুটির পরিবার সম্পর্কে কোন খবর না পাওয়ায় শেষমেষ সন্তানহীন মনোহর তাকে নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বাচ্চাটির নামকরণ করে হারাধন। হারাধন পড়াশোনায় ছিল অত্যন্ত মেধাবী। জীবনে নিজের সঞ্চিত সব অর্থ পুত্র হারাধনের হাতে দিয়ে যান মনোহর। নির্দেশ দেন দক্ষিণ কলকাতার মানুষের জন্য পুকুরের নির্মাণ করতে যাতে জলকষ্ট ঘোচে। সেই থেকেই ওই এলাকার নাম হয়ে যায় মনোহরপুকুর।
যাই হোক, মনোহর সর্দার ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে একটি কষ্টিপাথরের মূর্তিকে কালীজ্ঞানে পুজো করতেন। কথিত আছে যে প্রতিদিন ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মনোহর এই মূর্তিটি দড়ি বেঁধে ডেরার পাশের একটি পাতকুয়োতে ফেলে দিতেন। মনোহর সর্দার মারা যাওয়ার পর স্থানীয় এক বাসিন্দা কামাখ্যা চরণ মুখোপাধ্যায় একদিন দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, যে দেবী দীর্ঘদিন পাতকুয়োয় পড়ে আছেন। কামাখ্যাবাবু যেন দেবীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে তাঁর নিত্য পুজোর ব্যবস্থা করেন। এরপর তিনি বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু যেহেতু এই দেবীর প্রকৃত পুজারি ছিলেন মনোহর সর্দার, তাই তার নামেই মন্দিরটির নাম হয় মনোহর ডাকাতের কালী মন্দির। মা কালীর এই রূপটিকে বলা হত ছানা কালী কারণ মূর্তিটির আকৃতি খুবই ছোট। আজও সেই মূর্তিটিই এই কালীমন্দিরের প্রধান বিগ্রহ হিসেবে পূজিত হয়।