তাজমহল নয়, বিরিয়ানির জন্য বাঙালি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে মুমতাজের কাছে! কেন?
History of Biriyani: সেই সময় মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে থাকতে শুরু করেছিলেন মেটিয়াবুরুজের একটি বাড়িতে যা ছিল তখনকার দিনে বর্ধমানের রাজার সম্পত্তি।
আহা চমৎকার চমৎকার! বলতে বলতেই সুড়ুৎ করে হাড়ের থেকে বোনম্যারোটা টেনে নিল প্রীতম। তুলতুলে মাংস সমেত সুগন্ধি দাদা বৌদির বিরিয়ানির তুলনা কীসের সঙ্গে করা যেতে পারে সেই কথাই বোধহয় ভাবছিল! হঠাৎই অপ্রত্যাশিত এক প্রশ্ন, “বল তো মুমতাজকে কেন আমাদের মনে রাখা উচিৎ?" কোথায় বিরিয়ানির পাত, কোথায় মমতাজ! কীসের সঙ্গে কী? উত্তরটা তো সকলেরই জানা, তাঁর স্মৃতিতেই তো আজও রাজধানী শহরে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট তাজমহল। তবে তাজমহলের জন্য নয়, খাদ্য রসিক বাঙালির সম্রাজ্ঞী মুমতাজকে মনে রাখার অন্য কারণও আছে। ইতিহাস বলছে বিরিয়ানির সঙ্গে মমতাজের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একবার মুঘল সম্রাজ্ঞী সৈন্যদের ব্যারাকে গিয়েছিলেন তাঁদের খোঁজ খবর নিতে। সেখানে গিয়ে সেনাদের স্বাস্থ্যের খারাপ অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন তাঁদের খাওয়া দাওয়া ঠিকভাবে হচ্ছে না। তৎক্ষণাৎ বাবুর্চিকে ডেকে নির্দেশ দিলেন চাল এবং মাংস দিয়ে এমন একটা খাবার তৈরি করতে হবে যাতে শুধু পেটই ভরবে না বরং পুষ্টিগুণ থাকবে এবং সেনাদের স্বাস্থ্যও ফিরিয়ে দেবে। মমতাজের সেই আদেশকেই মান্যতা দিতে বাবুর্চি যে সুস্বাদু খাবার তৈরি করেছিলেন সে খাবারই আজ সকলের প্রিয় বিরিয়ানি। মুঘলদের খাবারের টেবিলে এই সুস্বাদু খাবারের জায়গা করে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শুধু তাই নয় ভারতের যে প্রান্তেই মুঘলরা গেছে সেখানেই ছড়িয়ে দিয়ে এসেছে বিরিয়ানির স্বাদ। পরবর্তী কালে এই পদ স্থানীয়দের হাতে গিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন স্বাদের।
যদিও বিরিয়ানির গল্প এখানেই শেষ নয়। এই খাবারকে কেন্দ্র করেই রয়েছে আরও দু'টি বিখ্যাত গল্প। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ভারতবর্ষে বিরিয়ানি এসেছে আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। বিশেষ করে মালাবারের দক্ষিণ উপকূলে তুরস্ক ও আরবদের বেশ আনাগোনা ছিল। তাদেরই একটি পছন্দের খাবার ছিল এই বিরিয়ানি। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই খাবারের রেওয়াজ।
এছাড়াও মনে করা হয় ১৩৯৮ সালে মোঙ্গল বিজয়ী তৈমুর ভারতবর্ষের সীমানার কাছে বিরিয়ানির আবিষ্কার করেন। একটি বিশাল মাটির হাঁড়িতে মশলা মাখানো মাংস, ঘি , চাল সব একসঙ্গে মিশিয়ে ভালো করে হাঁড়ির মুখ আটকে দেওয়া হতো। তারপরেই অল্প আঁচে কিন্তু গনগনে গরমে বসিয়ে দেওয়া হতো এই হাঁড়ি। সেদ্ধ হয়ে গেলেই সেই খাবার পরিবেশন করা হতো তৈমুরের সেনাবাহিনীকে।
আরও পড়ুন- বিরিয়ানির হাঁড়িতে লাল শালু বাঁধা থাকে কেন জানেন ?
তবে এ তো গেল ইতিহাসের কথা কিন্তু কলকাতার মানুষের কাছে বিরিয়ানি এসে পৌঁছলো কীভাবে?
১৮৫৬ সালে লখনউয়ের নবাব ছিলেন ওয়াজেদ আলি শাহ। সিপাহী বিদ্রোহের আগে সেই বছরই ৬ মে কলকাতায় এসে পৌঁছন তিনি। আসলে সেই সময় ব্রিটিশ সরকার নবাবের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। সেই কারণেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কলকাতা হয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবেন রানির কাছে আবেদন নিয়ে। তবে অসুস্থতার কারণে শেষ পর্যন্ত আর লন্ডন যাওয়া হলো না। খুব বেশি চলাফেরা করতে অসুবিধের কারণে কলকাতার মেটিয়াবুরুজেই পাকাপাকিভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তবে কথাতেই আছে, কারও পৌষ মাস তো কারও সর্বনাশ! এক্ষেত্রে সর্বনাশ নবাবের হলেও পৌষ মাস কিন্তু আজও তৃপ্তি দিয়ে চলেছে কলকাতা সহ বঙ্গবাসীকে।
আরও পড়ুন- Karim’s vs Kareem’s: এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়! পুজোয় কোথায় কোন বিরিয়ানি সেরা?
সেই সময় মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে থাকতে শুরু করেছিলেন মেটিয়াবুরুজের একটি বাড়িতে যা ছিল তখনকার দিনে বর্ধমানের রাজার সম্পত্তি। তবে থাকার ব্যবস্থা হলেও এখানকার রাঁধুনিদের খাবারে মোটেও তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না লখনউয়ের নবাব। সেই কারণেই লখনউ থেকে তাঁর রাঁধুনিদের কলকাতায় আসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁরাই তৈরি করতেন নবাবের জন্য খাস লখনউ বিরিয়ানি। স্বাদে গন্ধে মাতোয়ারা এই খাবারকে একেবারেই হেলায় ফিরিয়ে দিতে পারেননি কলকাতার রাঁধুনিরাও। শিখতে শুরু করেন লখনউ বিরিয়ানি। এরপরই রান্নার ধরনের নিয়ে আসেন বাঙালি আনার ছোঁয়া। ব্যাস সেখান থেকেই তৈরি হয়ে গেল নতুন স্বাদে গন্ধে কলকাতার বিরিয়ানি।
কলকাতার বিরিয়ানির ইতিহাসের গল্পটা ফুরালেও নটে গাছটি কিন্তু এখানেই মুড়িয়ে যায়নি। পাশের টেবিলে হঠাৎ কান গেল "দু' প্লেট বিরিয়ানি উইথ এক্সট্রা আলু।" ব্যাস আবার প্রশ্ন! কলকাতার বিরিয়ানিতেই কেন আলু ব্যবহার করা হয়? কই দেশের অন্য কোথাও তো তা হয় না। এখানেও লুকিয়ে আছে বেশ কিছু যুক্তি। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ যখন কলকাতায় থাকতে শুরু করলেন সেই সময় আর্থিক দিক থেকে তিনি বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। বিরিয়ানি তৈরি করতে গেলে প্রয়োজন হয় ভালো চাল এবং মাংসের। চালের ব্যবস্থা করা গেলেও মাংসের দাম নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিলেন নবাব। সেই সময় তিনি তাঁর হেঁসেলের রাঁধুনিদের খরচ বাঁচানোর জন্য মাংসের পরিবর্তে বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার কথা বলেন। ফলে স্বাদও মিটে গেল আর আর্থিক সাশ্রয়ও হয়েছিল কিছুটা। তবে নবাব যা শুরু করেছিলেন খরচ বাঁচাতে কলকাতা শহরে আজ সেটাই ট্র্যাডিশন। হাজি বিরিয়ানী থেকে শুরু করে দাদা বৌদি সবেতেই বিরিয়ানির সঙ্গে আলু না পেলে বাঙালি খুব চটে যায় আজও।