আজ যিশু কলকাতার, আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা গির্জার সুলুকসন্ধান...

এ শহর দেখেছে ঔপনিবেশিকতার দুই শতক। তার স্থাপত্যের নিদর্শনও ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। রোদ, ধুলোলাগা প্রাচীন ইমারত বোঝাই কলকাতার আদ্যিকালের প্রার্থনাস্থলের হিসেবনিকেশে করতে বসলে রাত কাবার হয়ে যাওয়ার কথা। এত প্রাচুর্য। মন্দির, মসজিদ, চার্চ, গুরুদ্বারা, সিনেগগ মিলিয়ে সে এক জমজমাট ব্যাপার। কিছু তার অল্পশ্রুত, কিছু তার প্রায় অজানা। গল্প শুনিয়ে বা পড়িয়েদের আসরে এ সকল গির্জার কথা বলতে গেলে গোড়া থেকেই শুরু করতে হয়।

আর্মেনিয়ান চার্চ: কোম্পানির আগমনের আগেও খ্রিষ্টধর্মের উপস্থিতি এ দেশে ছিল। পর্তুগিজ বা আর্মেনিয়ানদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে  বিদেশ থেকে এ দেশে এই বিশ্বাস প্রচারিত হতে থাকে। গড়ে ওঠে উপাসনাস্থলও। প্রাচীনত্বের বিচারে এ সমস্ত উপাসনাস্থলকে ফেলতে গেলে প্রথমেই নাম করতে হয়, আর্মেনিয়ান চার্চের। কলকাতার চিনেবাজার ও ব্রেবোর্ন রোড অঞ্চলে ছিল আর্মেনিয়ানদের ভরপুর বসবাস। নানান বাণিজ্যিক লেনদেনের কারণে সুদূর আর্মেনিয়া থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছোয় এ সকল বিদেশি বণিকরা। অবশেষে ১৭২৪ সালে তাদের গোরস্থানের পার্শ্ববর্তী এলাকায় নির্মিত হয় গির্জাটি। ইতিপূর্বে সপ্তদশ শতাব্দীতে চুঁচুড়াতে প্রথম গির্জা স্থাপনের মধ্যে দিয়ে তারা রেখে এসেছে তাদের স্থাপত্যের নিদর্শন।

আর্মেনিয়ান গির্জা।

মিশন চার্চ: আপামর বাঙালির কাছে ‘লাল গির্জা’ নামে পরিচিত এই চার্চটি স্থাপিত হয় ১৭৭০ সালে, নির্মাণকর্তার নাম রেভারেন্ড জোহান কির্ন্যান্ডার। এই প্রার্থনাগৃহকেই তাত্ত্বিকরা আখ্যা দিয়েছেন কলকাতার প্রাচীনতম প্রোটেস্টান্ট গির্জার। যদিও, জানা যায়, এর আগে ১৭০৯ সালে ইংরেজদের  গড়ে উঠেছিল সেন্ট অ্যান’স চার্চ। ১৭৩৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে গির্জাটির ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়, কালক্রমে ১৭৫৬ সালে সিরাজের কলকাতা আক্রমণের প্রকোপে তার সম্পূর্ণ পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লর্ড ক্লাইভের আমন্ত্রণে কির্ন্যান্ডার দক্ষিণ ভারত থেকে পাকাপাকিভাবে এসে বাস করা শুরু করেন কলকাতায়। অতঃপর ১৭৬৭ সালে জমি কিনে তার উপর নির্মাণ করেন গির্জাখানা। কির্ন্যান্ডার তাঁর সাধের গির্জার হিব্রু নামকরণ করেছিলেন ‘বেথ তেপিল্লাহ’, যার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় ‘উপাসনগৃহ’। অনেকের মতে, ‘লাল দিঘির’ নামকরণের মূলে রয়েছে এই মিশন চার্চ বা ‘লাল গির্জা’। তৎকালীন ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের জলে এ গির্জার ছায়া এসে পড়ত, সেখান থেকেই তার নাম হয়ে ওঠে ‘লাল দিঘি’। ১৮৯৭ সালে আসামে একটি ভূমিকম্প ঘটে, যার ফলে শহরাঙ্গনের উচ্চতম এ গির্জার কারুকার্য খানিক ধ্বসে পড়ে।

সেন্ট জন্স চার্চ: নির্মাণকাল ১৭৮৭। স্থানীয় বাসিন্দারা এ উপাসনালয়কে চেনে ‘পাথুরে গির্জা’ নামে। এ গির্জাটি গড়ে উঠেছিল মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের জমিতে। ইংরেজদের খুশি করতে তিনি জমিখানা তাঁদের উপহার দেন। অবশেষে গৌড়ের ধ্বংসস্তুপ থেকে মার্বেল পাথর এনে তা দিয়ে চাকচিক্যপূর্ণ কারুকার্যে তৈরি করা হয় গির্জাটি। ১৭৮৪ সালে গির্জাটি উদ্বোধন করেন স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংস। লন্ডনের ‘সেন্ট মার্টিন্স ইন দ্য ফিল্ডস’ এর আদলে তৈরি এই চার্চের একাধিক উল্লেখ পাওয়া যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘ফ্যাতাড়ু’ সিরিজের উপন্যাসগুলিতে। এ গির্জাপ্রাঙ্গন, চোক্তারদের আদিপুরুষ দণ্ডবায়সের এক অন্যতম প্রিয় রমণস্থল।

সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ: এবারে এসে পড়া যাক সরাসরি ঊনবিংশ শতাব্দীতে। স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের কাজিয়া কলহের ফল ভুগতে হয়েছিল মহারাজা নন্দকুমারকে। ইংরেজ আইনের বিচারে প্রকাশ্যে ফাঁসি হয় তাঁর। সে ফাঁসির সিদ্ধান্ত যে বিচারসভা থেকে নেওয়া হয়েছিল তার খাসজমির উপরেই পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ। ১৮১৫ সালে গির্জা নির্মাণে সাহায্য করতে স্কটিশদের জমি দান করা হয় এবং সেই জমিতেই ১৮৩৫ সালে গির্জাটির দ্বার উদ্বোধন হয়। তৎকালীন ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে স্থাপিত এ গির্জার মাথায় আজও যে ঘড়িটি সগৌরবে বিরাজমান, তা বসানো হয় আরও কিছু পরে, অর্থাৎ, ১৮৩৫ সালে।

সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ

সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল: ধরুন আপনি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে গিএছেন, নাটক বা আঁকার প্রদর্শনী দেখতে। শিল্পগৃহের পেছনের রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যান, কলা কুশলীদের গাড়ি রাখার পরিচ্ছন্ন জায়গা, রোল চাউমিনের বহু পুরনো দোকান, এরই মাঝখানে যে গির্জার চূড়োটি অবধারিতভাবে আপনার চোখে পড়বে, তার নাম সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। ১৮১৯ সালে তৈরি। এ চার্চ তৈরির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিশপ মিডলটন। গির্জা তৈরির জায়গা খুঁজতে খুঁজতে পাদ্রী সম্প্রদায় বর্তমানের বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামের পাশে আবিষ্কার করেন এক বিস্তৃত জংলা জমি। সেখানেই তাঁরা তৈরি করেন এ গির্জা। ১৮৪৭ সাল থেকে এই গির্জার দ্বার সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত করা হয়।

সেন্ট জেমস চার্চ: বহুল পরিচিত অফিস যাত্রীদের নিত্য স্টপেজ ‘জোড়া গির্জা’ নামে। গথিক ধাঁচায় নির্মিত এ গির্জার একপাশে প্র্যাট মেমোরিয়াল স্কুল, অন্য পাশে সেন্ট জেমস। ১৮৬৮ সালে নির্মিত এ গির্জার নকশা ওয়াল্টার বি গ্র্যানভিলে নামক এক মিস্ত্রীর মস্তিস্কপ্রসূত। এই গ্র্যানভিলের শৈল্পিক মুন্সিয়ানাতেই গড়ে উঠেছিল জিপিও এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলের মতো বাড়িঘর। ১৫৫ বছর ধরে কলকাতার ব্যাস্ততম রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট জেমস চার্চ।

সেন্ট জেমস চার্চ

সেন্ট মেরিজ চার্চ: এ গির্জার ইতিহাসও বেশ আকর্ষণীয়। সাধারণ মানুষ ‘বাঙালি ক্যাথিড্রাল’ হিসেবেও এর নামকরণ করেছে, কারণ এর সিংভাগ উপাসকরা বাঙালি প্রোটেস্টান্ট সমাজের অন্তর্ভুক্ত। রেভারেন্ড হরিহর স্যান্ডেল (বা সান্যাল) নামক এক ভদ্রলোকের হাত ধরেই ১৮৮৫ সালে এ গির্জার উত্থান। হরিহরবাবু নানান জায়গা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে এনে পরম যত্নে গড়ে তোলেন গির্জাটি। যদিও এর দ্বার উন্মোচন তিনি দেখে যেতে পারেননি, তার আগেই ১৮৮৭ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর স্বপ্নের উপাসনাগৃহটির যাত্রা রেভারেন্ড অঘোরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে।

গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ: কালীঘাট মন্দিরের সোজাসুজি যে রস্তাটি উইমেন্স খ্রিষ্টান কলেজে এসে মিশেছে, তার মুখেই দেখা মিলবে গ্রিক প্যান্থেননের ছাঁচে তৈরি এ গির্জার। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে গ্রীক অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের উপাসনার সুবিধার্থে গড়ে তোলা হয় এ চার্চটি। যদিও, অষ্টদশ শতাব্দীতে কলকাতায় নির্মিত প্রথম গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় চার দশক রমরমিয়ে চলার পর, অবশেষে ১৯৬০ সালে গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিষ্টানের অভাবে চার্চটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও ১৯৯০ সালে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফের খোলা হয় এই গির্জার দ্বার।

গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ

এভাবেই যিশুপুজোর ধারা বয়ে চলেছে বাংলার মাটিতে, অনাবিল। ২৫ ডিসেম্বরকে বলা চলে বাঙালির শীতকালীন উদযাপনের শুভ মহরতের দিন। অতীতের শীতঘুম ভাঙিয়ে স্মৃতির দালান ছুঁয়ে দেখার দিন। কিন্তু এ কথাও ঠিক গোটা বছরের একটা বড় সময়ে এই চার্চগুলি শুনশান থাকে। একদিন বড়দিন, যিশু বারোমাস কলকাতার নন কেন!

 

More Articles